স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নব্যবস্থা কেমন হতে পারে

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের মডেলটি কেমন হওয়া উচিত, সেই ধারণা নীতিনির্ধারণী মহলের কাছে আজও অনেকটা অস্পষ্ট। স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন কেমন হবে, তা নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ আব্দুল হামিদ

বর্তমানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়ন মূলত ব্যক্তির পকেটনির্ভর; সরকারি হিসাবমতে, যার অংশ প্রায় ৬৯ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে, এটা ৭৪ শতাংশ। বর্তমান বাস্তবতায় এই অংশ হয়তো ৮০ শতাংশের কাছাকাছি হবে। ব্যক্তির পকেটখরচের বিশাল এই অংশের প্রায় ৬৪ শতাংশ ব্যয় হয় ওষুধের জন্য।

সরকার যে পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ দেয়, তা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নের মাত্র ২৩ শতাংশ। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বৈশ্বিক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) স্বাস্থ্যবিষয়ক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ব্যক্তির পকেটখরচ ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়ন কেমন হওয়া উচিত, তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নের মডেল

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়নের প্রধানত দুটি ধারা প্রচলিত আছে। একটি হলো সাধারণ করভিত্তিক অর্থায়ন, যেটা ‘বেভারিজ মডেল’ নামে পরিচিত। উইলিয়াম বেভারিজের হাত ধরে যার যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনে। অন্যটি হলো ‘সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা’, যা ‘বিসমার্ক মডেল’ নামে পরিচিত। জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর অটো ভন বিসমার্কের নামে ১৮৮৩ সালে জার্মানিতে সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের অর্থায়নের সূচনা হয়। পরবর্তী সময়ে এ দুটি ধারাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত হয়েছে। বাংলাদেশের সরকারি স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়ন করভিত্তিক হওয়ায় বেভারিজ মডেলের কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের মডেলটি কেমন হওয়া উচিত, সেই ধারণা নীতিনির্ধারণী মহলের কাছে আজও অনেকটা অস্পষ্ট। বাংলাদেশে সরকারি অর্থায়নের ব্যবস্থা শক্তিশালী করা উচিত, নাকি সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা প্রচলনের দিকে যাওয়া উচিত, এ বিষয়ের সুরাহা এখনো হয়নি।

বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যেসব দেশে সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়ন করা হয়, সেসব দেশে জনগণের একটা বড় অংশ ‘ফরমাল সেক্টরে’ (আনুষ্ঠানিক) কর্মে নিয়োজিত। বাংলাদেশে ফরমাল সেক্টরে মাত্র ১২ থেকে ১৩ শতাংশ লোক নিয়োজিত। অর্থাৎ আমাদের জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮৭ শতাংশ ইনফরমাল সেক্টরে নিয়োজিত, যাদের কাছ থেকে নিয়মিত ভিত্তিতে বিমার প্রিমিয়াম সংগ্রহ করা অত্যন্ত কঠিন। অন্যদিকে কর-জিডিপির অনুপাত কম হওয়ায় ইনফরমাল সেক্টরে (অনানুষ্ঠানিক) নিয়োজিত এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক স্বাস্থ্যবিমায় সরকারের প্রিমিয়াম ভর্তুকি দেওয়ার সামর্থ্য নেই।

তা ছাড়া সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে হলে অবশ্যই সরকারি হাসপাতালকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কেননা, সরকারি হাসপাতালের বিস্তৃতি দেশের সর্বত্র বিরাজমান। কিন্তু সরকারি হাসপাতালকে স্বাস্থ্যবিমায় সেবাদানকারী হিসেবে বিবেচনা করতে গেলে বাংলাদেশের পাবলিক ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট রুলে একটা বড় পরিবর্তন দরকার। তা হলো, সরকারি হাসপাতালগুলোকে সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রদত্ত সেবার বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ, অর্থ ধারণ ও অর্থ খরচের অনুমতি প্রদান।

বাংলাদেশের পাবলিক ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট রুলে এ ধরনের পরিবর্তনের কথা বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হলেও তা আর অগ্রসর হয়নি। তাই এ পরিবর্তন যদি সম্ভব না হয়, তাহলে সরকারি হাসপাতাল সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার অধীন এলেও সেখান থেকে বর্তমানে যে ধরনের সেবা পাওয়া যায়, তার চেয়ে ভালো সেবা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে যে সেবা পাওয়া যায়, প্রিমিয়াম দিয়ে সামাজিক স্বাস্থ্যবিমায় অংশগ্রহণ করলে একই রকম সেবা পেলে জনগণ নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হবে না।

বিকল্প হলো, বেসরকারি হাসপাতালের মাধ্যমে সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা। এ ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে। একদিকে যেমন দেশের সর্বত্র গুণগত মানের বেসরকারি হাসপাতাল নেই। অন্যদিকে যদি শুধু বেসরকারি হাসপাতালের মাধ্যমে সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার অধীনে সব জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়, তাহলে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার এই বিশাল নেটওয়ার্ক চালু রাখার বিষয়ে প্রশ্নের উঠবে। তা ছাড়া বিমা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের ভীতি আছে। এসব কারণে ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে সব মানুষের জন্য ‘কম্প্রিহেনসিভ’ বেনিফিট প্যাকেজভিত্তিক সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা প্রচলনের সুযোগ নেই।

তবে যাঁরা ফরমাল সেক্টরে নিয়োজিত, তাঁদের জন্য এ ধরনের বিমা প্রচলনের সুযোগ আছে। যেসব ক্ষেত্রে দলভিত্তিক স্বাস্থ্যবিমা প্রচলনের সুযোগ আছে, তা প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ১০ লাখের অধিক শিক্ষার্থী আছেন। তাঁদের বিমার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে একদিকে যেভাবে তাঁদের স্বাস্থ্যের খরচ নির্বাহ করা সহজ হবে, অন্যদিকে বিমা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলে তাঁরা ভবিষ্যতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যবিমা প্রচলনে উদ্বুদ্ধ হবেন।

উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিমার যাত্রা শুরু হয়। এরই সূত্র ধরে ২০২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আসেন। পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিমা চালু হয়। আশা করি, ভবিষ্যতে সব বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে সব শিক্ষার্থীর জন্য এ বিমা প্রচলন করা হবে।

সব দিক বিবেচনায়, বাংলাদেশে আপাতত করভিত্তিক স্বাস্থ্য অর্থায়নব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু এ ব্যবস্থার অধীন যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। অন্যদিকে বরাদ্দকৃত অর্থ পুরোপুরি খরচ হয় না, আবার যতটুকু খরচ হয়, তা–ও কার্যকরভাবে খরচ করা হয় না। এর জন্য একদিকে যেমন নিয়মানুগ বাধা আছে, অন্যদিকে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ খরচের সামর্থ্যেরও অভাব আছে।

এই নিয়মানুগ বাধার সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সহ শীর্ষ মন্ত্রণালয়গুলো জড়িত। আবার স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবালয়ভিত্তিক প্রশাসন এবং অধিদপ্তরভিত্তিক প্রশাসনও জড়িত। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন দপ্তর (যেমন স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ) এবং স্বাস্থ্য খাতের বাইরের বিভিন্ন দপ্তরও (যেমন গণপূর্ত) জড়িত। এককথায় পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছোট-বড় বিভিন্ন ‘শিকলে বন্দী’।

রূপরেখা

বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যের অর্থায়নপদ্ধতি কেমন হতে পারে, তার একটি রূপরেখা দেওয়া যেতে পারে। গ্রাম ও শহরের জনগণের জন্য প্রমোটিভ, প্রিভেনটিভ, সাধারণ কিউরেটিভসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা করভিত্তিক সরকারি অর্থায়নে হবে। এ জন্য গ্রামীণ স্বাস্থ্যব্যবস্থার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার মাধ্যমে শক্তিশালী করতে হবে। শহরে জনগণের জন্য একটি যুগোপযোগী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা মডেল চালু করতে হবে।

বহির্বিভাগীয় রেফারেল সেবা ও সাধারণ অন্তর্বিভাগীয় সেবার জন্য একটি পারিবারিক স্বাস্থ্য কার্ড প্রবর্তন করা এবং প্রতিটি পরিবারের জন্য বছরে প্রাথমিকভাবে এক লাখ টাকা মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা। এ ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালের সেবাগুলোকে ডায়াগনস্টিক রিলেটেড গ্রুপের (ডিআরজি) ভিত্তিতে বান্ডলিং করে মূল্য নির্ধারণ করা দরকার।

উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ১১০ ক্যাটাগরির সেবা প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করা আছে। প্রয়োজনে এগুলোয় সংশোধনী আনা যেতে পারে। আর যেসব সেবার মূল্য নির্ধারণ করা নেই, সেগুলোকে ডিআরজির ভিত্তিতে বান্ডলিং করে সেবা প্যাকেজের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।

এ প্রক্রিয়া চালু হলে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণ ক্ষমতায়িত হবে। কেননা, তার প্রাপ্য অধিকার আদায়ে এই কার্ড ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। বর্তমান অবস্থায় হাসপাতালের কোনো সেবা থেকে বঞ্চিত হলে বা অবহেলার শিকার হলে রোগীর কাছে কোনো প্রমাণ থাকে না এবং অভিযোগও করতে পারে না। এ ব্যবস্থায় সে কত মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা পেল, তা জানার সুযোগ তৈরি হবে। ফলে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার প্রতি তার আগ্রহ বাড়বে এবং স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ জন্মাবে। আবার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানেরও জানার সুযোগ হবে, কোন রোগীকে কত মূল্যের সেবা প্রদান করছে এবং সেই সঙ্গে বছরে কত মূল্যের সেবা উৎপাদন করছে। সরকারও জানতে পারবে সরকারি খাত থেকে জনগণকে যে সেবা দেওয়া হয়, তার সর্বমোট মূল্য কত।

সরকার এ বছর প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করেছে। কিন্তু সরকারের জানা নেই, এ টাকা ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান কত মূল্যের সেবা উৎপাদন করছে। হয়তো সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ করা বাজেটের ১০ গুণ মূল্যের সেবা উৎপাদন করছে। ফলে সরকার রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে, যা স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারকে আগ্রহী করে তুলবে। এর ফলে হাসপাতালের বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ অন্য যেসব চ্যালেঞ্জ আছে, তা মোকাবিলায় এগিয়ে আসবে।

এ পদ্ধতির আরেকটি সুবিধা হলো, রেফারেল সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে। কেননা, জনগণকে যখন বলা হবে যে এ সুবিধা পেতে হলে তাদের প্রথমে সরকার নির্ধারিত হাসপাতালে যেতে হবে। যদি তারা রেফারেল ছাড়া বাইপাস করে সরাসরি উচ্চতর হাসপাতালে চলে যায়, তাহলে তাদের ওপর সেবামূল্য ধার্য করা হবে। তখন তারা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হাসপাতালে এ সেবা নিতে আগ্রহী হবে।

এ ব্যবস্থা চালু হলে বর্তমানের তুলনায় কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়ার দাবি জোরালো হবে। ফলে হাসপাতালের ব্যবস্থাপকদের অর্থ ও অন্যান্য রিসোর্স পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করার তাড়না সৃষ্টি হবে। তাই হাসপাতালের কোনো রিসোর্স অব্যবহৃত রাখার সুযোগ থাকবে না; বরং রিসোর্সের প্রচণ্ড সংকট তৈরি হবে। এ অবস্থা নিরসনের জন্য প্রতিটি হাসপাতালের জন্য কিছু থোক বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

তা ছাড়া হাসপাতালের জন্য কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে রোগীর সংখ্যা, হাসপাতালের শয্যা ব্যবহার, রোগীর সন্তুষ্টির মাত্রাসহ বিভিন্ন নির্দেশকের ভিত্তিতে হাসপাতালগুলোর সেবার স্কোর তৈরি করতে হবে। এ স্কোরের ফলাফলের ভিত্তিতে উচ্চ-মধ্যম-ন্যূনতম স্কোর অর্জনকারী হাসপাতালকে বিভিন্ন মাত্রার প্রণোদনা দেওয়া, যা চিকিৎসক, ব্যবস্থাপক ও অন্যান্য জনবলের মধ্যে ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভাগ করে দেওয়া।

যারা এ পদ্ধতির মাধ্যমে সেবা নিতে আগ্রহী হবে না, তাদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত খরচে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সুযোগ থাকবে। প্রয়োজনে তারা ঐচ্ছিক স্বাস্থ্যবিমা গ্রহণের মাধ্যমে সেবা নেবে। অন্তর্বিভাগীয় রেফারেল সেবা, জটিল–কঠিন রোগের সেবা, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা এবং জরুরি অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য একটি ‘জাতীয় স্বাস্থ্য তহবিল’ গঠন করা যেতে পারে। এ তহবিলে সরকারের পাশাপাশি জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

বর্তমানে দেশে প্রায় ১৯ কোটি সক্রিয় মুঠোফোন গ্রাহক রয়েছে। এসব সেবা প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিদিন ১ টাকা করে, অর্থাৎ মাসে ৩০ টাকা বা বছরে ৩৬০ টাকা—প্রতিটি মুঠোফোন গ্রাহকের কাছ থেকে সংগ্রহ করলে বছরে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা যাবে। সরকার তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর বৃদ্ধি করে এই তহবিলে জমা দিলে আরও ৩ হাজার কোটি টাকা যোগ হবে। তা ছাড়া ওষুধশিল্পসহ সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির (সিএসআর) ১০ থেকে ২০ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে এ তহবিলে জমা দেওয়ার নিয়ম করলে সেখান থেকে একটি মোটা অঙ্কের টাকা এই তহবিলে জমা হতে পারে।

এসব উৎস থেকে বছরে ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করা সম্ভব হলে তা দিয়ে অন্তর্বিভাগীয় রেফারেল সেবা, ক্যানসারসহ জটিল-কঠিন সেবা এবং জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যক্তিপ্রতি ন্যূনতম ৫ লাখ টাকার সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে। এ সুবিধা শুধু তারাই পাবে, যারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা গ্রহণ করবে। কেউ বিদেশে গিয়ে সেবা নিতে চাইলে এ তহবিল থেকে কোনো অর্থ পাবে না। ফলে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বিদেশমুখিতা কমানো সম্ভব হবে।

এ ক্ষেত্রে কেউ ইচ্ছা করলে ব্যক্তিগতভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঐচ্ছিক স্বাস্থ্যবিমায় অংশগ্রহণ করতে পারে। আবার যারা এ ব্যবস্থার অধীন সেবা নিতে আগ্রহী না, তারাও ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঐচ্ছিক স্বাস্থ্যবিমায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা গ্রহণ করতে পারবে।

সংক্ষেপে বলা যায়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং বহির্বিভাগীয় রেফারেল সেবা ও অন্তর্বিভাগীয় সেবা সাধারণ করভিত্তিক অর্থায়নের মাধ্যমে প্রদান করা হবে। অন্যদিকে অন্তর্বিভাগীয় রেফারেল সেবা, জটিল-কঠিন রোগের সেবা, জরুরি সেবা ও জরুরি অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য একটি জাতীয় তহবিল গঠন করতে হবে।

এ ব্যবস্থা চালুর জন্য স্বাস্থ্য খাতে একটি শক্তিশালী ও স্থায়ী স্বাস্থ্য কমিশন বা ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি গঠন করতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঐচ্ছিক স্বাস্থ্যবিমা গ্রহণের সুযোগ রাখতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এসব ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিরাজমান চ্যালেঞ্জগুলো অনেকাংশেই দূর করা সম্ভব হবে।

  • ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং আহ্বায়ক, অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি)