অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কত দিন, সে কথা আইনে লেখা নেই। উপদেষ্টা পরিষদ এ-সংক্রান্ত যে অধ্যাদেশটি চূড়ান্ত করেছে তাতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পর নতুন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার দিন পর্যন্ত।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের মতামত নিয়ে ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা কতজন হবেন, তা অধ্যাদেশের খসড়ায় সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। বলা হয়েছে, একজন প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টা যতজন নির্ধারণ করবেন, ততজন উপদেষ্টার সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি স্বনামধন্য এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন।
এতে আরও বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা পদে থাকার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ও কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না বলে সম্মত না হন। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারে প্রধান উপদেষ্টাসহ ২৪ জন সদস্য আছেন।
সেদিক থেকে আমরা ধরে নিতে পারি, বর্তমান সরকারের কোনো উপদেষ্টা পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যে ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের একাংশ নতুন রাজনৈতিক দল গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জাতীয় নাগরিক কমিটি তাঁদের কার্যক্রম সারা দেশে বিস্তৃত করছে। কমিটির একজন নেতা জানিয়েছেন, নাগরিক কমিটি একটি প্ল্যাটফর্ম হবে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে যারাই তাদের নীতি আদর্শ মানবেন, তাঁরা যুক্ত হতে পারবেন।
বাংলাদেশে এবারই প্রথম অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়নি। ১৯৯০ সালে এরশাদবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত প্রথম অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ছিল তিন মাসের মতো। যদিও ১৯৯১ সালের ৮ অক্টোবর নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন বিএনপির নেতা ও ৫ম জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুর রহমান বিশ্বাস।
বাংলাদেশে সব সরকারই জাতীয়। কোনো বিজাতীয় সরকার এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় এসেছে বলে আমাদের জানা নেই। অতীতে সেনাবাহিনী বন্দুকের জোরে ক্ষমতা নিয়েও বলেছে, এটা জাতীয় সরকার। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বও নিজের পছন্দসই দলকে জাতীয় সরকার বলে দাবি করে। কিন্তু তারা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করে বিদায় নেয়।
কিন্তু গোল বাঁধে ২০০৬-০৭ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে। আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন সব বিরোধী দল সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের বিষয়ে আপত্তি জানালে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ বাকি পাঁচ বিকল্পে না গিয়ে নিজেই তত্ত্বাবধায়ক প্রধান হন। এরপর ১ / ১১-এর পালাবদলে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থাকে। তারা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।
প্রশ্ন উঠেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার কত দিন দায়িত্বে থাকবে, কবে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে?
এ বিষয়ে রাজনৈতিক মহলেও প্রবল মতভেদ আছে। কেউ বলছেন, সরকারের উচিত দ্রুত নির্বাচন দিয়ে চলে যাওয়া। কেউ বলছেন, সংস্কারকাজ শেষ না করে নির্বাচন দিলে ফের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হবে। আবার কারও মতে, নির্বাচিত সরকার জনগণের জন্য কিছু করেনি। অন্তর্বর্তী সরকার যত দিন খুশি থাকুক।
এ প্রেক্ষাপটেই নির্বাচন কবে হবে—এ নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও কৌতূহল আছে। আমাদের ধারণা, সংস্কার ও নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়েও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। উপদেষ্টারাও একেকজন একেক কথা বলছেন।
নির্বাচনের দিন-তারিখ নিয়ে প্রথমে কথা বলেছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে এই সরকারকে সমর্থন দেওয়া হবে। রয়টার্সের সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে আমি বলব যে এই সময়সীমার মধ্যেই আমাদের একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করা উচিত।’
এরপর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ‘যদি ও কিন্তু’ দিয়ে জানালেন, ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব। ২১ নভেম্বর যুক্তরাজ্যে সফরে গিয়ে নৌপরিবহন ও শ্রম উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন জানালেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি নির্বাচন হতে পারে। আসিফ নজরুলের বক্তব্য নিয়ে সমালোচনা হলে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয় নির্বাচনের বিষয়ে দিনক্ষণ ঠিক করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ শনিবার বিআইডিস আয়োজিত সেমিনারে বলেছেন, ‘আমাদের এই সরকার খুবই স্বল্পকালীন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আগামী বছরই আমরা একটি রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার পাব। জানি না কী হবে।’
তিনজন উপদেষ্টার কথায় গরমিল আছে। দুজন বললেন, ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন হওয়া সম্ভব বা নির্বাচন দেখতে চাই। অপরজন ২০২৬ সালের মাঝামাঝি। নির্বাচনের দিন-তারিখ নিয়ে উপদেষ্টাদের মধ্যে মতভেদ থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে অভিন্ন অবস্থান আশা করা যাবে কীভাবে?
প্রধান উপদেষ্টা সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ‘অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার’ শেষে দেশ নির্বাচনী ট্রেনে চলবে বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন। তিনিও নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ওপর জোর দিয়েছেন।
নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলের মতভেদের পেছনে ভোটের হিসাব-নিকাশ কাজ করছে। কোনো কোনো দল মনে করে, যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে, ততই তাদের লাভ। আবার কোনো কোনো দল মনে করে নির্বাচন যত বিলম্বে হবে, ততই তাদের সুবিধা। অন্যদিকে দু-একটি দল নির্বাচন না করে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বেই রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের আওয়াজ তুলছে।
বাংলাদেশে সব সরকারই জাতীয়। কোনো বিজাতীয় সরকার এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় এসেছে বলে আমাদের জানা নেই। অতীতে সেনাবাহিনী বন্দুকের জোরে ক্ষমতা নিয়েও বলেছে, এটা জাতীয় সরকার। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বও নিজের পছন্দসই দলকে জাতীয় সরকার বলে দাবি করে। কিন্তু তারা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি