মিয়ানমারে বিদ্রোহীরা জিততে চলেছে—কতটা সত্যি, কতটা কল্পনা

কাচিনে আরাকান আর্মির একটি প্রশিক্ষণশিবিরছবি: ভয়েস অব আমেরিকা

সামরিক অভ্যুত্থান–পরবর্তী মিয়ানমার যখন চতুর্থ বছরে পা দিতে চলেছে, তখন বিদ্রোহীদের আসন্ন বিজয়ের দাবি চারদিক থেকে উঠছে ব্যাপকভাবে।

আরাকান আর্মি (এএ) ও কাচিন ইনডিপেডেন্স আর্মি (কেআইএ) রাখাইন ও কাচিন রাজ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছে। এর আগে গত বছরের আগস্টে থ্রি ব্রাদারহুড আলায়েন্স (থ্রি বিএ) উত্তর শান রাজ্যের রাজধানী লাশিহোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর সশস্ত্র আক্রমণের মুখে জান্তার স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল (এসএসি) পরিষ্কারভাবে পিছু হটছে।

এ মাসের প্রথমদিকে নির্বাসিত জান্তাবিরোধী ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গত এক বছরের সামরিক অগ্রগতির একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রথম নজরে দেখলে, প্রতিবেদনটিকে একটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের চমকপ্রদ ঘটনাপঞ্জি বলে মনে হবে। তর্কাতীতভাবে মনে হবে, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা একটি সরকারের বিরুদ্ধে তারা জয়ী হতে চলেছে। কিন্তু এই দাবি বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

এনইউজি দাবি করেছে, ২০২১ সালে গঠনের পর তাদের তিনটি প্রধান অর্জন হলো—১. একাধিক জনপ্রতিরক্ষা বাহিনী (পিডিএফ) গঠন, ২. নিজেদের নিয়ন্ত্রিত ও মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং ৩. সামরিক শাসনের প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে ফেলা ও ‘জনগণের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা’।

আরও পড়ুন

‘নিয়ন্ত্রণ’ ও ‘শাসন’ শব্দ দুটির মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়, এমন পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এনইউজির সব কটি দাবির মধ্যে সত্যতা আছে।

এনইউজির প্রতিবেদনে, সামরিক বাহিনীকে হটিয়ে মিয়ানমারের কতটা ভূমি তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, সেই তথ্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে। পিপলস ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস এবং এথনিক রেভল্যুশনারি অর্গানাইজেশনস এখন মিয়ানমারের ৩৩০টি শহরের মধ্যে মোট ১৪৪টি শহরের নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে ৯৫টি শহর পুরোপুরি ‘মুক্ত’ হয়েছে এবং সেখানে বিপ্লবী সরকারের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এ ছাড়া ৭৯টি শহর ঘিরে বিপ্লবী যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, জান্তার নিয়ন্ত্রণ কমতে কমতে ১০৭টি শহরে এসে ঠেকেছে। শতাংশের হিসাবে বিপ্লবী বাহিনী মিয়ানমারের ৪৪ শতাংশ শহরের নিয়ন্ত্রণ করছে। বর্তমানে সক্রিয় সংঘাতময় অঞ্চল ২৪ শতাংশ। জান্তা কেবল ৩২ শতাংশ অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পেরেছে। এটা মিয়ানমারের বেশির ভাগ অঞ্চলের ওপর শাসন বজায় রাখতে জান্তা সরকারের অক্ষমতাই প্রকাশ করে।

যাহোক, এই প্রতিবেদন অনেকটা অতিরঞ্জিত বলেই মনে হয়। প্রতিবেদনে সব বিপ্লবী গোষ্ঠীকে একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট হিসেবে দেখানো হয়েছে। প্রতিবেদনে পিপলস ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস ও এথনিক রেভল্যুশনারি অর্গানাজেশনগুলোকে মিশ্রিত করে দেখানো হয়েছে। সেখানে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে ‘বিপ্লবী বাহিনী’ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

রাখাইন ও উত্তর শানে দুটি আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডসহ ১৭৩টি ঘাঁটি দখল করা হয়েছে। জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী ও তাদের মিত্ররা এসব সামরিক অর্জনের বেশির ভাগটা করেছে। ফলে এনইউজি যে সামরিক বিজয় অর্জনের দাবি করেছে, তার সামান্যটাই তারা করতে পেরেছে।

প্রতিবেদনে আরাকান আর্মি, কাচিন ইনডিপেডেনস আর্মি, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক আলায়েন্স আর্মি (এমএনডিএনএ), তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং অন্য অনেক গোষ্ঠীর নাম এখানে উল্লেখ করা হয়নি।

এই সব জাতিগত গোষ্ঠীর কারও কারও সঙ্গে এনইউজির ক্ষীণ একটা সংযোগ আছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এনইউজির সঙ্গে মিলে তৎপরতা চালাচ্ছে তারা।

প্রতিবেদনের আরেকটু নিচে এনইউজির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৯৫টি মুক্ত শহরের মধ্যে এনইউজি/ পিডিএফ মাত্র আটটির নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটা উল্লেখ করেছেন। চীন, বাংলাদেশ, ভারত ও থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী মুক্ত ১১টি শহরের মধ্যে একটির নিয়ন্ত্রণও এনইউজির হাতে নেই। জান্তা প্রশাসনের ৭৪১টি সেনাঘাঁটি ২০২৪ সালে দখল করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬২টি ঘঁটির দখল পিডিএফের হাতে রয়েছে।

রাখাইন ও উত্তর শানে দুটি আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডসহ ১৭৩টি ঘাঁটি দখল করা হয়েছে। জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী ও তাদের মিত্ররা এসব সামরিক অর্জনের বেশির ভাগটা করেছে। ফলে এনইউজি যে সামরিক বিজয় অর্জনের দাবি করেছে, তার সামান্যটাই তারা করতে পেরেছে।

আরও পড়ুন

প্রতিবেদনটির নিহতের সংখ্যা যেভাবে গণনা করা হয়েছে, সেটাও সমস্যাজনক। দাবি করা হয়েছে, ২০২৪ সালে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ১৪ হাজার ৯৩ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ৭ হাজার ৩৬৩ জন। যেকোনো যুদ্ধে ৩ জন আহতের বিপরীতে ১ জন নিহত হয়, সেটাকে মানসংখ্যা হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এনইউজির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা নেই হতাহতের সংখ্যা তারা কীভাবে গণনা করেছে কিংবা কোন সূত্র তারা ব্যবহার করেছে। অনেক জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী সাধারণত এ ধরনের তথ্য গোপন রাখে, শত্রুপক্ষের কজন নিহত হয়েছে, সেটা তারা প্রকাশ করতে ইচ্ছুক থাকে না।

সুতরাং, এইএনজি কীভাবে এই সংখ্যা দিল, সেটা স্পষ্ট নয়। আবার বিপ্লবীদের পক্ষে কতজন হতাহত হয়েছে, সেই তথ্য সেখানে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনের আরেকটি অংশ নিয়েও বড় প্রশ্ন আছে। সেটি হলো, পক্ষ ত্যাগ করে আসা জান্তা সেনাদের সংখ্যা। এনইউজির দাবি হলো, ‘জনগণকে আলিঙ্গন’ এই কর্মসূচির অধীন ১৪ হাজার ৭৬০ জন সদস্য পক্ষ ত্যাগ করে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পক্ষ ত্যাগ করে আসা লোকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হলো মিয়ানমার পুলিশের সদস্য। ২০২১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮৭২ জন সেনাসদস্য পক্ষ ত্যাগ করেছেন। ২০২৪ সালে পক্ষ ত্যাগ করা সেনাসদস্যদের সংখ্যা ৫৬৭।

এনইউজি দাবি করেছে, সামরিক বাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দেওয়ার জন্য জান্তা সরকারের প্রকল্পটি বড়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক আইনটি পাস হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে ২০ হাজার নতুন লোককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এনইউজির এই রিপোর্টে সাগাইং এবং মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলের বেশির ভাগটাতে মানুষের জীবনে যে প্রলয় নেমে এসেছে, সেটা তুলে আনতেও ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব বলছে, শুধু সাগাইং অঞ্চলে ৩৫ লাখ বাসিন্দার মধ্যে সাড়ে ১২ লাখের বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দ্য মিয়ানমার মনিটরিং গ্রুপের নথি থেকে জানা যাচ্ছে, অভ্যুত্থানের পর গত চার বছরে জান্তার বাহিনী ১ লাখ ৬ হাজার বাড়িঘর ভস্মীভূত করে দিয়েছে। এর মধ্যে শুধু সাগাইংয়ে ৭৪ হাজার বাড়ি রয়েছে।

যেকোনো বিচারেই ২০২১ সালে গঠিত হওয়া এনইউজির অর্জনগুলো চমকজাগানিয়া। কিন্তু ‘সামরিক অগ্রসরতা’র মতো প্রতিবেদনের তথ্য মানবিক বিবেচনায় ‘বাহাদুরির’ মতো হয়ে যায়।

  • ডেভিড স্কট ম্যাথিসন একজন স্বাধীন বিশ্লেষক, যিনি মিয়ানমারে সংঘাত, মানবিক এবং মানবাধিকার বিষয়ে কাজ করেন

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত