গত কয়েক দিনে ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনাবাহিনী তাদের হামলা তীব্র করেছে। তা সত্ত্বেও রুশ সেনারা ইউক্রেনীয় সেনাদের হাতে বড় ধরনের মার খাচ্ছেন। সামরিক রসদঘাটতির কারণেই এত ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও জি-৭-এর দেশগুলোর প্রতিনিধিরা ১১ অক্টোবর একটি জরুরি সভায় ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জন্য রাশিয়াকে দায়ী করেছে। ইউক্রেনের অনেকগুলো নগর ও বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ৯ অক্টোবর রাশিয়া প্রচণ্ড হামলা শুরু করে। এ হামলা থেকে ইঙ্গিত মিলছে যে সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের নৃশংস হামলা চালানো অব্যাহত থাকতে পারে।
সাম্প্রতিক আক্রমণ শুরুর আগে গত ২১ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তিন লাখ নতুন সেনা নিয়োগের একটি খসড়ায় স্বাক্ষর দেন। রাশিয়া যে সৈন্য ও সামরিক রসদের ঘাটতিতে পড়েছে, এটা তারই দৃষ্টান্ত। যাহোক, রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত দুই লাখ নতুন সেনা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। নতুন সেনা নিয়োগের এই পরিকল্পনা রাশিয়াজুড়ে ব্যাপক অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। রাশিয়ার বেশ কয়েকটি সেনা নিয়োগকেন্দ্রে সহিংস হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ দমাতে ক্রেমলিন প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। এ পর্যন্ত ২ হাজার ৪০০-এর বেশি প্রতিবাদকারীকে আটক করা হয়েছে।
এরই মধ্যে রাশিয়ার শীর্ষ জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থা লেভাদা সেন্টার পরিচালিত জরিপে উঠে এসেছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তাঁর বিশেষ সামরিক অভিযানের প্রতি বিশাল জনসমর্থন রয়েছে। রাশিয়া ও দেশটির জনমত বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমার কাছে মনে হচ্ছে, নতুন সেনা নিয়োগের ঘোষণার পর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনে হামলা নিয়ে রাশিয়ার জনগণের সমর্থন কমতে শুরু করেছে।
ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত বেশির ভাগ রুশ নাগরিক হয় যুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল অথবা উদাসীন। যুদ্ধ শুরুর পর সেখানকার জনগণ খুব দ্রুত পুতিনের পেছনে একত্র হয়েছেন। যুদ্ধ এখন রাশিয়ানদের প্রতিদিনকার জীবনের দৃশ্যপট হয়ে উঠেছে। জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, ৫০ শতাংশ রাশিয়ান ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক কর্মকাণ্ডকে স্পষ্টভাবে সমর্থন দিয়েছেন। ৩০ শতাংশ মোটামুটিভাবে সমর্থন দিয়েছেন। মাত্র ২০ শতাংশ যুদ্ধে সমর্থন দেননি।
নতুন জরিপ জনমত পরিবর্তনের ইঙ্গিত করছে। মনে হচ্ছে, রাশিয়ার জনমতের স্বাভাবিক প্রবণতা ভাঙতে শুরু করেছে। আরও বেশি রাশিয়ান তাঁদের মনস্তাত্ত্বিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধের জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এমন রাশিয়ানের সংখ্যা ২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে ধীরে ধীরে কমছিল। কিন্তু সম্প্রতি এই প্রবণতা পুরোপুরি পাল্টে গেছে।
রাশিয়ার জনগণ ক্রেমলিনের সঙ্গে অলিখিত একটি সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে পুতিনের শাসনকে সমর্থন করে আসছেন। তা হলো জীবনযাপনের ভালো মান ও ব্যক্তিগত জীবনে রাষ্ট্রের কম হস্তক্ষেপ। বাইরের গণমাধ্যমের নেতিবাচক সংবাদ ও তথ্যের চেয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম যুদ্ধের যে ভাষ্য তৈরি করছে, সেটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন রাশিয়ানরা। গত ৩০ সেপ্টেম্বর ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেওয়ার সময় পুতিন স্পষ্ট করে বলেছেন, রাশিয়ার পশ্চিমা শত্রু বলতে তিনি আসলে কী বোঝান। কিয়েভের সরকার টিকিয়ে রাখা ও দনবাসে অমানবিক সন্ত্রাসী হামলার জন্য তিনি পশ্চিমাদের দায়ী করেন। পুতিনের যুক্তি হলো, রাশিয়ানরা তাঁদের অস্তিত্বের জন্য লড়াই করছেন।
বেশির ভাগ রাশিয়ানের দৃঢ় বিশ্বাস হচ্ছে, পশ্চিমারা রাশিয়ার প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ এবং রাশিয়া নিজ দেশের প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধ করছে। আগস্ট মাসে পরিচালিত এক জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, ৭১ শতাংশ রাশিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ও ৬৬ শতাংশ রাশিয়ান ইউক্রেনের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। অনেক সমাজতাত্ত্বিক মনে করেন রাশিয়ায় যে জরিপ পরিচালিত হয়, সেগুলোর ওপর নানা কারণেই পূর্ণ আস্থা রাখা যায় না। জরিপের মূল প্রশ্ন, বেঠিক শব্দচয়ন কিংবা পুতিন ও সরকারের সমালোচনার ব্যাপারে সতর্কতা—এসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আবার অনেক বিশেষজ্ঞ বলতে চান, জরিপে অংশগ্রহণকারীরা মূলত জরিপকারীরা যা শুনতে চান, তা-ই বলেন। তাঁরা প্রকৃতপক্ষে কী ভাবেন, সেটা বলেন না।
নতুন জরিপ জনমত পরিবর্তনের ইঙ্গিত করছে। মনে হচ্ছে, রাশিয়ার জনমতের স্বাভাবিক প্রবণতা ভাঙতে শুরু করেছে। আরও বেশি রাশিয়ান তাঁদের মনস্তাত্ত্বিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধের জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এমন রাশিয়ানের সংখ্যা ২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে ধীরে ধীরে কমছিল। কিন্তু সম্প্রতি এই প্রবণতা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। আগস্ট মাসে যেখানে ২১ শতাংশ রাশিয়ান বলেছিলেন তাঁরা যুদ্ধে কী ঘটছে তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। সেপ্টেম্বর মাসে এই সংখ্যা ১১ শতাংশ বেড়ে ৩২ শতাংশ হয়েছে।
যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার জনসাধারণের মধ্যে সাধারণ যে আবেগ জন্ম হচ্ছে, সেটা জাতীয় গৌরবের জায়গা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে না; বরং সেই অনুভূতি উদ্বেগ, ভয়, রাগ, ধিক্কার থেকে উৎসারিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক জরিপে সেই চিত্রই উঠে এসেছে।
ঐতিহ্যগতভাবে সেনাবাহিনীর ওপর রাশিয়ানদের অগাধ আস্থা রয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে পরিচালিত এক জরিপে দেখা দিয়েছিল, রাষ্ট্রীয় অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠান, এমনকি প্রেসিডেন্টের চেয়ে সেনাবাহিনীকে বেশি বিশ্বাস করেন রাশিয়ানরা। রাশিয়ার আইন অনুযায়ী, ১৮-২৭ বছর বয়সী সব নাগরিককে সেনাবাহিনীকে এক বছরের জন্য সেবা প্রদান করতে হয়। ২০২১ সালের জুলাই মাসের এক জরিপে উঠে এসেছে, ৬১ শতাংশ রাশিয়ান মনে করেন, ‘সব আসল পুরুষ’-এর উচিত সেনাবাহিনীতে যাওয়া। পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে এ ধারণা আরও বেশি পোক্ত।
যাহোক, যুদ্ধ সেনাবাহিনীর প্রতি রাশিয়ানদের সেই আত্মবিশ্বাস অনেকটা ভেঙে দিয়েছে। রাশিয়ার সেনাবাহিনী নিয়োগের ক্ষেত্রে বরাবরই তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে এসেছে। কিন্তু এ বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ১ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ সেনা নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিলেও নিয়োগ করতে পেরেছে ৮৯ হাজার সেনাকে। ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ব্যর্থতার পর রাশিয়ার সেনাবাহিনীর প্রতি নতুন করে সমালোচনা বেড়েছে। এমনকি অন্ধ সমর্থকেরাও সমালোচনা করছেন। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অব্যবস্থাপনা ও ইউক্রেনে অধিকৃত ভূখণ্ড হারানোর বিষয়টি দেশটির অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
পুতিনের মতো কর্তৃত্ববাদী শাসকদের জন্য সামাজিক ভিত্তি ধরে রাখার সূত্র হলো জনপ্রিয়তা ধরে রাখা। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার মতো জনসমর্থন পুতিনের এখনো রয়েছে কি না, সে সম্পর্কে পূর্বধারণা করা খুব কঠিন। পুতিনের জনসমর্থন আগস্ট মাসে যেখান ৮৩ শতাংশ ছিল, সেপ্টেম্বর মাসে তা কমে ৭৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যদিও বেশির ভাগ রাশিয়ান এখনো মনে করেন, রাশিয়া ঠিক পথেই চলছে। কিন্তু সেনাবাহিনীতে আরও লোক নিয়োগ করা শুরু হলে জনসমর্থন আরও কমে আসতে পারে।
এর আগেও পুতিনের পতন-সম্পর্কিত অনেক পূর্বধারণা ব্যর্থ হয়েছে। এবারও রাশিয়ার জনগণ বড় আকারের সেনা নিয়োগের বিষয়টিও শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করে নিতে পারেন। বেশির ভাগ রাশিয়ান আশা করেন, আগামী ছয় মাসের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু যে রক্তক্ষয় হচ্ছে, তাতে আর কত দিন দেশটির জনগণ ধৈর্য ধরে থাকবে, সেটাও বিবেচ্য বিষয়।
আরিক বুরাকোভস্কি টুফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসির রাশিয়া ও ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের সহকারী পরিচালক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে