প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বছরটা শুরুই করেছিলেন কঠিন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে। দুই দশক ধরে তুরস্কের ক্ষমতার শীর্ষে থাকার পরও এবার পরিস্থিতি তাঁর পক্ষে ছিল না।
দেশের মানুষ দীর্ঘদিনের উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ক্ষুব্ধ। তার দল জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। বিরোধীরা একজোট হয়েছিল ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুর পেছনে, যিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে নামছেন।
তারপর বুধবার, ঠিক যখন ইমামোগলুকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার কথা, তখনই পুলিশ তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকা।
এরদোয়ানের বিরোধীরা বলছেন, এটি ইমামোগলুর প্রচারণা শুরুর আগেই তাঁকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক নেতাদের মতে, এখানে শুধু প্রেসিডেন্ট পদের প্রশ্ন নয়, বরং বিষয়টা আরও বড়।
তুরস্ক বিশ্বের ২০টি বৃহত্তম অর্থনীতির একটি এবং ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সেই তুরস্ক কি আদৌ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন। কারণ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্বাচন প্রতিযোগিতার পথ রুদ্ধ করা মানে, দেশকে পুরোপুরি স্বৈরাচারী শাসনের দিকে নিয়ে যাওয়া।
২০০৩ সাল থেকে এরদোয়ান তুরস্কের রাজনীতিতে কর্তৃত্ব ধরে রেখেছেন—প্রথমে প্রধানমন্ত্রী, পরে ২০১৪ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে। তাঁর শাসনামলে তুরস্ক অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক উন্নতি করেছে। একাধিকবার তার দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি নির্বাচনে জয়ী হয়েছে।
কিন্তু গত এক দশকে, সমালোচকদের মতে, তিনি ক্ষমতা দৃঢ় করতে গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগে নিজের অনুগতদের বসিয়েছেন, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে এনেছেন, বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রসিকিউটর ও বিচারকদের ব্যবহার করেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এখন কি গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মিশ্রণে তুরস্ক চলবে, নাকি মূলত স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠবে? একরাম ইমামোগলুকে এ রকমভাবে নির্বাচনে দাঁড়াতে না দিলে তুরস্ক পড়ে যাবে রাশিয়া বা বেলারুশের মতো দেশের কাতারে। এই দেশগুলোতে নির্বাচন হয়, কিন্তু নির্বাচনে কে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন, তা ঠিক করেন প্রেসিডেন্ট নিজে।
এদিকে ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে বিরোধী দলগুলোর বিক্ষোভ আহ্বানকে ‘নাটক’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তুরস্ক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশটির সমর্থিত একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী এখন সিরিয়ার নতুন সরকার পরিচালনা করছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন তাদের মিত্রদেশগুলোর গণতান্ত্রিক মান বজায় রাখার বিষয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ ছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ইউরোপীয় দেশগুলো প্রতিরক্ষা খাতে তুরস্কের ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।
এসব কৌশলগত কারণে এরদোয়ানের শাসনব্যবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল থেকে খুব বেশি সমালোচনা না–ও আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ইমামোগলুর গ্রেপ্তার নিয়ে এখন পর্যন্ত খুব বেশি মন্তব্য করেননি। তবে ইউরোপীয় নেতারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এরদোয়ানের বর্তমান দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হবে ২০২৮ সালে। তুরস্কের সংবিধান অনুযায়ী, একজন প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তবে পার্লামেন্ট আগাম নির্বাচন ডাকলে তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা প্রবল।
ইমামোগলুর গ্রেপ্তার এমন এক সময়ে এল, যখন সরকার তার সমালোচকদের বিরুদ্ধে খুব কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। গত জানুয়ারি থেকে শুরু করে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযোগ, তাঁরা এক দশক আগে দমন করা একটি সরকারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
গত মাসে একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের দুই কর্মকর্তা সরকারের অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনা করেন। পরিণতিতে তাঁদের বিরুদ্ধে ‘ভুয়া তথ্য’ প্রচারের অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। তাঁদের পাঁচ বছরের বেশি কারাদণ্ডের সুপারিশ করা হয়েছে।
এত বাধা সত্ত্বেও ইমামোগলুর জনপ্রিয়তা কমেনি। বরং তিনি এরদোয়ানের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক বার্ক এসেন বলছেন, ‘ইমামোগলু স্পষ্ট করে দিয়েছেন, পরিবর্তনের ট্রেন ছুটে আসছে। এরদোয়ান চাইলেও তা থামাতে পারবেন না।‘
অক্টোবর থেকে তিনটি জেলার মেয়রকে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির অভিযোগে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একজনের জায়গায় সরকার সরাসরি একজন প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে।
এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তুরস্ক দ্রুতই এক কঠোর নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, আন্তর্জাতিক মহল ও দেশটির জনগণ এর জবাব কীভাবে দেয়।
সরকার তার বিরোধীদের দমন করার ক্ষেত্রে যেন বেসামাল হয়ে গেছে। গত মাসে এক জ্যোতিষীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগ—তিনি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ও আরেকজন শীর্ষ রাজনীতিবিদকে অপমান করেছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক ফুড ভ্লগারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে। কারণ, তিনি এমন এক রেস্তোরাঁর ইতিবাচক রিভিউ দিয়েছিলেন, যা ইমামোগলুর নেতৃত্বাধীন সিটি করপোরেশনের সহায়তায় চালিত হয়।
একরেম ইমামোগলু ২০১৯ সালে সবাইকে চমকে দিয়ে ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। সরকার তখন ভোটের ফলাফল বাতিল করে। অভিযোগ ছিল যে নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে। কিন্তু সরকারকে চূড়ান্ত অপমান করে পুনর্নির্বাচনেও ইমামোগলু আরও বড় ব্যবধানে জয়ী হন। গত বছরও তিনি আবার মেয়র নির্বাচিত হন। বড় ব্যবধানে পরাজিত করেন এরদোয়ান-সমর্থিত প্রার্থীকে।
এর পর থেকে সরকার তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে ৪২টি প্রশাসনিক ও ৫১টি বিচারিক তদন্ত শুরু হয়েছে। এসব তদন্তের উদ্দেশ্য ইমামোগলুর প্রশাসনকে দুর্বল করা এবং তাঁর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ বন্ধ করা।
এ সপ্তাহে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎই ঘোষণা দেয়, ১৯৯০ সালে তিনি যে ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন, সেটি বাতিল করা হচ্ছে। কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় বলছে, তুরস্ক-নিয়ন্ত্রিত উত্তর সাইপ্রাস থেকে স্থানান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় নিয়ম মানা হয়নি।
ইমামোগলু বলেছেন, তিনি এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। কিন্তু যদি সিদ্ধান্ত বহাল থাকে, তাহলে তাঁর প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার পথ কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, তুরস্কের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য একজন প্রার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি থাকতে হয়।
তবে এত বাধা সত্ত্বেও ইমামোগলুর জনপ্রিয়তা কমেনি। বরং তিনি এরদোয়ানের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক বার্ক এসেন বলছেন, ‘ইমামোগলু স্পষ্ট করে দিয়েছেন, পরিবর্তনের ট্রেন ছুটে আসছে। এরদোয়ান চাইলেও তা থামাতে পারবেন না।‘
সরকারি কৌঁসুলিরা ইমামোগলুর বিরুদ্ধে অপরাধী চক্র পরিচালনা, ঘুষ লেনদেন, দরপত্র জালিয়াতি ও অন্যান্য অপরাধের অভিযোগ এনেছেন। আরেকটি মামলায় বলা হয়েছে, তিনি একটি কুর্দিশপন্থী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদে সমর্থন দিয়েছেন।
বিরোধী দল ঘোষণা করেছে, তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী রোববার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী চূড়ান্ত করবে এবং ইমামোগলুকেই তাদের মনোনীত প্রার্থী করবে। একই সঙ্গে তারা তার গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে।
কিন্তু সরকার যেকোনো প্রতিবাদ কঠোরভাবে দমন করতে চায়, এটা স্পষ্ট। ইস্তাম্বুল, আঙ্কারা ও ইজমিরে জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রধান সড়ক ও মেট্রো স্টেশন বন্ধ রাখা হয়েছে। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে, যাতে আন্দোলনকারীরা সংগঠিত হতে না পারেন।
এখন দেখার বিষয়, এরদোয়ানের কঠোর দমননীতি কতটা কাজে দেয়। তুরস্কের জনগণ কীভাবে এই দমননীতি বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানায়।
বেন হাবার্ড ইস্তাম্বুলের ব্যুরো চিফ, নিউইয়র্ক টাইমস
সাফাক তাইমুর তুরস্ক প্রতিনিধি, নিউইয়র্ক টাইমস
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ