‘যথা পূর্বং তথা পরং’—সংস্কৃত শ্লোকটির বাংলা তর্জমা হতে পারে, ‘আগের হাল যেভাবে যায়, পিছের হালও সেভাবে যায়।’
ভারতে ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত অটল বিহারি বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে বিজেপি ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে হেরে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, ‘গ্রামে-গঞ্জে বিরাজমান নীরব গরিবি (তথা দারিদ্র্য)।’
বাজপেয়ীর আমলের মতো নরেন্দ্র মোদির আমলেও জনগণকে সীমাহীন বেকারত্বের ও দারিদ্র্যের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়েছে।
করপোরেট মালিকদের অকুণ্ঠ অনুদান ও সব ধরনের সহযোগিতা, প্রায় সব কটি মিডিয়ার ক্রমাগত প্রচার, প্রচুর অর্থব্যয়, দলীয় স্বার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহার, বিভিন্নভাবে বিরোধী দলকে হয়রানি ও দলগুলোর অ্যাকাউন্ট জব্দ করা, ভয়ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদি সব ধরনের কৌশল অবলম্বন করার পরও জনগণের কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া পায়নি বিজেপি।
সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যার বেশ নিচে তাদের অবস্থান। ওই সব অন্যায় কৌশল অবলম্বন না করলে হয়তো বিরোধী পক্ষ, অর্থাৎ ইন্ডিয়া জোটই সরকার গঠন করত।
জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য, নির্বাচনের সময় বিজেপি-সমর্থিত ‘করপোরেট বাহিনী’ শেয়ার মার্কেটে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করে কৃত্রিমভাবে সূচক বড় করে দেখিয়েছে।
বুথফেরত জরিপেও কারসাজি করে বিজেপির পক্ষে বিপুল জয় দেখিয়েছে বিজেপি সমর্থক গবেষণা সংস্থাগুলো। কিন্তু বিধি বাম। শেষ রক্ষা হলো না।
‘কেন হলো না’ এর উত্তর খুঁজে পেলে আমাদের সবার জন্য তা হবে একটি প্রয়োজনীয় বিরাট শিক্ষা।
বিজেপির হাতে হিন্দুত্ববাদের পতাকা উড্ডীয়মান। বিজেপি শুধু হিন্দুত্ববাদীই নয়, উগ্র পুঁজিবাদীও বটে। তার প্রতিফলন দেখা যায় দলের ও নেতাদের জীবনাচরণে ও কর্মকাণ্ডে। স্বয়ং নরেন্দ্র মোদির পোশাকপরিচ্ছদে এর ছাপ স্পষ্ট।
হিন্দুস্তান টাইমস ও ইন্ডিয়া টুডে জানায়, ট্রয় কস্তা নামের যে ফ্যাশন ডিজাইনার মুম্বাই চিত্রজগতের পুরুষ তারকাদের পোশাক তৈরি করেন, নরেন্দ্র মোদির পোশাকও তিনি তৈরি করেন।
প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ৯ লাখ রুপি মূল্যের স্বর্ণখচিত স্যুট বানিয়েছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে তাঁর বেশভূষার ও চালচলনের জন্য মানুষ ‘ইংল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট’ বলে কটাক্ষ করতেন।
নরেন্দ্র মোদির বা টনি ব্লেয়ারের এই যে রোগ, এর নাম হলো পুঁজিবাদ।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে, ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কথা। একটি ঘটনার উল্লেখ করি। নেহরুর কেবিনেটে শাস্ত্রী শেষ দিকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী ছিলেন। নেহরু তাঁকে একবার আসামে পাঠাতে চাইলেন।
সবকিছু বুঝে নিয়ে শাস্ত্রী বেরিয়ে গেলেন। নেহরু ভাবলেন, আসামে তো এখন অনেক শীত, কিন্তু শাস্ত্রীর তো শীত নিবারণের জন্য কোনো কোট নেই। ডেকে পাঠালেন শাস্ত্রীকে। বললেন, ‘তুমি যে আসামে যাবে, তোমার কি কোট আছে?’
শাস্ত্রী আমতা-আমতা করায় নেহরুর কাছে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হলো। তখন নেহরু তাঁকে নিজের কোটটা দিয়ে বললেন, ‘এবার যাও। আসাম থেকে ঘুরে এসো।’
দীর্ঘদেহী নেহরুর কোট তাঁর গায়ে খুব বেমানান ছিল বটে; কিন্তু আর কোনো উপায় ছিল না।
নরেন্দ্র মোদিও লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মতো দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন। কিন্তু আজকের নরেন্দ্র মোদির বেশভূষা দেখে তা বোঝার উপায় নেই।
মোদি কীভাবে করপোরেট মালিকদের ঋণ মওকুফ, বিভিন্ন ধরনের ছাড় ও বিশেষ সুবিধা দিয়ে এসেছেন, তার একটি দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। দিয়েছেন যোগেন্দ্র যাদব, শশী থারুরের মতো আরও অনেক ভারতীয় রাজনীতিক ও অর্থনীতিবিদ।
কিন্তু অন্যদিকে ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দরিদ্র কৃষককে দিল্লি যেতে হয় খালি পায়ে, গুলি খেয়ে মরতে হয়, কাউকে কাউকে আত্মহননের পথও বেছে নিতে হয়।
এই যে ধনীর প্রতি পক্ষপাত আর গরিবের প্রতি অবিচার—এ হলো উগ্র পুঁজিবাদী উপসর্গ।
একাধিক কারণে বিজেপি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয়েছে। ভারতবর্ষে খ্রিষ্টান মিশনারিদের মধ্যে দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে মানুষকে ধর্মান্তরিত করার এক ন্যক্কারজনক প্রবণতা ছিল।
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁদের উদ্দেশ্য বলেছিলেন, ‘উই হ্যাভ এনাফ রিলিজিয়ন। উই নিড ফুড। জাস্ট গিভ আস ফুড।’
এটা পুরো ভারতীবাসীরই প্রাণের কথা। এর অর্থ হলো, জীবন বাঁচানোর জন্য আগে চাই খাদ্য, তারপর ধর্ম।
বিজেপি জনগণের জন্য খাদ্যের ব্যবস্থা না করে, অর্থাৎ চাকরির ব্যবস্থা না করে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে। তাতে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছে। তার প্রমাণ, খোদ অযোধ্যায় যেখানে তারা রামমন্দির নির্মাণ করেছে, সেই আসনেই বিজেপি হেরেছে।
ক্ষোভ আরও বেড়েছে, যখন উপলব্ধি করেছে, দলটি তাঁদের জমি কেড়ে নিয়ে করপোরেট মালিকদের দিতে চাইছে। উপলব্ধি করেছে, দলটি তাঁদের বন্ধু নয়, বন্ধু সে ধনীদের।
দলিত, আদিবাসী, অনগ্রসর শ্রেণি ইত্যাদি মিলিয়ে ভারতে এদের সংখ্যা ৫২ শতাংশ।
চাকরিতে ও স্কুল-কলেজে ভর্তিতে তাদের কোটা সংরক্ষণের প্রস্তাব করেন প্রথমে ১৯৫৫ সালে কাললেলকার কমিশন ২৫-৪০ শতাংশ ও পরে ১৯৮০ সালে মণ্ডল কমিশন ২৭ শতাংশ।
বিজেপি জনগণকে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে জয় লাভ করার সুযোগ দিতে আহ্বান করেছিল, যাতে তারা সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে। তাদের খায়েশ ছিল, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর ও সংরক্ষণ তুলে দেওয়ার।
রাহুল নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ও অন্যান্য দল এই বিষয়টি জনগণকে বুঝিয়েছে। সে প্রচার জনগণ বিশ্বাস করেছে ও বিজেপির এমন বিজয় রুখে দিয়েছে।
হিন্দু রাষ্ট্রের নমুনা আমরা কিছুটা দেখেছি নেপালে রাজার শাসনের আমলে। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা সর্বোচ্চ বর্ণ ব্রাহ্মণ সৃষ্টি করেছেন মুখ থেকে আর শূদ্র তথা নিম্নবর্ণ সৃষ্টি করেছেন পা থেকে, অতএব ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠ এবং ব্রাহ্মণকে সবচেয়ে উঁচু আসনে বসিয়ে রাজ্যের সব নিয়মনীতি প্রণয়ন করতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, ব্রাহ্মণকে কোনো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না, তা সে যত বড় অপরাধই করুন না কেন। তাঁর কারাদণ্ড হবে বড়জোড় তিন বছর ইত্যাদি।
ভারত চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে যান পাঠিয়েছে, ভারতের অর্থনীতির আয়তন অচিরেই চতুর্থ বৃহত্তম হচ্ছে, শেয়ারবাজারের আকৃতি হংকংকে ছাড়িয়ে গেছে, ২০২৪-এর প্রথম কোয়ার্টারে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮%, এসব গল্পে জনগণের কিচ্ছু যায় আসে না। কারণ, এসব গল্প তাদের জীবনকে স্পর্শ করে না। তারা চাকরি চায়, তারা দয়া-দাক্ষিণ্য চায় না; বরং নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজে রোজগার করতে চায়, তারা খাদ্য চায়, ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষা চায়, যুবতী মেয়ের লজ্জা নিবারণের বস্ত্র চায়, ভালো ঘরে মেয়ের বিয়ে দিতে চায় আর চায় একটু বিশ্রাম, ঘুম ও সুস্থ বিনোদন।
হিন্দু রাষ্ট্রের এই ভয়ংকর রূপ যাঁরা জানেন, তাঁরা এই আধুনিক বিজ্ঞান, যুক্তি ও মানবিকবাদের পরাকাষ্ঠার যুগে ধর্ম-রাষ্ট্র সমর্থন করতে পারেন?
এ রকম একটি অমানবিক, বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা শূদ্র তথা দলিত, আদিবাসী, অনগ্রসর শ্রেণি মেনে নেবে, এটা ভাবার কারণ কী?
৭০ বছর ধরে ভারত যে প্রতিষ্ঠানগুলো তিল তিল করে গড়ে তুলেছিল, নরেন্দ্র মোদি সরকার পুলিশ বিভাগ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন এমনকি হিস্ট্রিক্যাল রেকর্ড কমিশনেও দলীয় লোক নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলছে।
মোদি সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, শিকাগো ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক রঘু রাজন যিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।
তিনি মোদির ‘ডিমনিটাইজেশন’ নীতি অনুমোদন করেননি বলে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
অথচ এই নীতি ব্যাপক ক্ষতি করেছে অর্থনীতির। দুর্নীতি রোধের নামে এই নীতি আদতে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের হাজার হাজার কোটি রুপি হস্তগত করার সুযোগ করে দিয়েছে।
পক্ষান্তরে, সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছিল দেশের সাধারণ মানুষ। এটাও ভোটাদাতারা মনে রেখেছে।
ভারতীয় ভোটাদাতাদের সচেতনতার মাত্রার প্রশংসা করতেই হবে। তাঁরা মনে রেখেছেন, মোদি কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, গ্রামে-গঞ্জে মানুষের আয় দ্বিগুণ করবেন, বেকারত্বে হার অর্ধেকে নামাবেন আর মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় রাখবেন।
বাস্তবে মোদি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পরাজয়, ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের কাছে হিন্দি ভাষার আগ্রাসন ও হিন্দুত্ববাদ তথা ‘এক দেশ, এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা’ তত্ত্বের পরাজয় হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়।
এই তত্ত্বে পশ্চিমবঙ্গবাসী আতঙ্কিত। তারা হিন্দির আগ্রাসনকে রুখে দিতে চেয়েছে।
দ্বিতীয়ত, মমতা সরকারের জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোতে, বিশেষ করে নারীরা উপকৃত হয়েছেন।
তাই মমতা সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি সত্ত্বেও জনগণ তাদের ভোট দিয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের জন্য একটি শিল্পভিত্তি নির্মাণ করার পরিবর্তে টাকা খরচ করছেন জনতুষ্টিবাদী প্রকল্পে, যা রাজ্যকে শুধু পিছিয়েই দিচ্ছে, দিন দিন বেকারত্বও বাড়ছে। ভোটের রাজনীতির এ এক সর্বনাশা রূপ বটে।
আধুনিক কালের সবচেয়ে প্রভাবশালী অর্থনীতিবিদ, প্রফেসর কেইন্স লিখেছে, ‘ইন দ্য লং রান উই অল আর ডেড,’ অর্থাৎ দীর্ঘ মেয়াদে আমরা সবাই মৃত। মানুষ নগদ কী পেল, এটাই বিবেচনা করে ভোট প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন।
ভারত চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে যান পাঠিয়েছে, ভারতের অর্থনীতির আয়তন অচিরেই চতুর্থ বৃহত্তম হচ্ছে, শেয়ারবাজারের আকৃতি হংকংকে ছাড়িয়ে গেছে, ২০২৪-এর প্রথম কোয়ার্টারে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮%, এসব গল্পে জনগণের কিচ্ছু যায় আসে না।
কারণ, এসব গল্প তাদের জীবনকে স্পর্শ করে না। তারা চাকরি চায়, তারা দয়া-দাক্ষিণ্য চায় না; বরং নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজে রোজগার করতে চায়, তারা খাদ্য চায়, ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষা চায়, যুবতী মেয়ের লজ্জা নিবারণের বস্ত্র চায়, ভালো ঘরে মেয়ের বিয়ে দিতে চায় আর চায় একটু বিশ্রাম, ঘুম ও সুস্থ বিনোদন।
পুঁজিবাদের চরম প্রকাশ ঘটেছে যে মার্কিন দেশে, সেখানেও ৯২ সালে বিল ক্লিনটন ক্ষমতায় এসেছিলেন জর্জ বুশের বিরুদ্ধে ‘দ্য ইকোনমি, স্টুপিড’ স্লোগান দিয়ে। কারণ ভারতীয় জনগণের মতো মার্কিন জনগণও বাঁচার মতো বাঁচতে চায়, যার জন্য দরকার অর্থ।
ড. এন এন তরুণ ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ।