ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ও স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে যাওয়ার বিষয়টি এখনো মানতে পারছেন না—এমন কেউ আর নেই বলে মনে করা যে ভুল, তার কিছু প্রমাণ আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পেয়েছি।
তাঁরা শুধু স্বৈরশাসনের মাঠকর্মী বা দলীয় সদস্য নন, তাঁদের কেউ কেউ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানেও আসীন আছেন বলাটা সম্ভবত অন্যায় হবে না। বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কথা এখানে স্মরণ করা যায়। কিন্তু সেটাই শেষ নয়। না হলে স্বৈরশাসনকে দীর্ঘায়িত করার কাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের প্রধান হঠাৎ করে সংবিধান লঙ্ঘনের আওয়াজ তুলতেন না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ২৪ আগস্ট সমকাল–এ এক নিবন্ধে সংবিধান আংশিক অথবা পুরোপুরি স্থগিত রাখার কথা বলেছেন। তিনি অভিযোগের সুরে বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক সংকটে। আলোচনার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই কমিশনের প্রধান হিসেবে পত্রিকায় লিখে জনগণকে অবহিত করাই সমীচীন মনে করছি।’ তিনি কী আলোচনা করতে চান, তা যতটুকু খোলাসা করেছেন, তা হচ্ছে, ‘বিপ্লবোত্তর এই সময়ে খানিকটা সাংবিধানিক শূন্যতা দৃশ্যমান।’
সাবেক এই আইনসচিব, যিনি বিচার বিভাগেও কাজ করেছেন, তিনি সংবিধান আংশিক বা পুরোপুরি স্থগিত করার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছেন, সামরিক অভ্যুত্থান হলে সামরিক ফরমান দ্বারা সংবিধানকে অবিলম্বে রহিত বা স্থগিত করা হয়। স্থগিত করা হলে ফরমানকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে অগ্রগণ্যতা দেওয়া হয়। অর্থাৎ ফরমান ও স্থগিত— সংবিধানের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে ফরমানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আইনের শাসনের ধারাবাহিকতাকে এভাবে বজায় রাখা হয়।
এরপর হাবিবুল আউয়াল অর্ন্তবর্তী সরকারকে ‘বিপ্লবী সরকার’ হিসেবে অভিহিত করে তাদের শপথ নেওয়ার কথা বলেছেন। প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টারা যে সংবিধানের অধীন শপথ নিয়েছেন, তাতে তিনি বিস্মৃত হয়েছেন কি না জানি না। তবে তিনি লিখেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে আগাম বৈধতা নেওয়া হয়েছে। পরে আপিল বিভাগকেই বিদায় করা হয়েছে।’ আপিল বিভাগের বিদায় যে স্বৈরশাসনকে টিকিয়ে রাখায় উচ্চ আদালতের বিতর্কিত ভূমিকা এবং নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণে ঘটেছে, সে বাস্তবতাকে তিনি উপেক্ষা করেছেন।
যদিও কাজী হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থান কার্যকর করতে আদালতের অনুমোদন প্রয়োজন হয় না’, তবু তাঁর বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি একধরনের শ্লেষ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘গণ-অভ্যুত্থান একটি স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা (সেলফ এভিডেন্ট)। আইনের ঊর্ধ্বে এর অবস্থান। তবে বিপ্লবোত্তর সময়ে আইনের ঊর্ধ্বে একটি ফরমান অনিবার্যভাবে প্রয়োজন। সামরিক আমলারা তা জানেন। সুশীল আমলারা সেটা বোধ করি জানেন না।’ সুশীল আমলা হিসেবে কাদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা বুঝতে কোনো পাঠকের কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
হাবিবুল আউয়ালের নিবন্ধটি সমকাল–এ যা ছাপা হয়েছে, তার চেয়েও বেশি কিছু তিনি লিখেছেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে এমন কিছু বক্তব্য আছে, যা সমকাল–এ ছাপা হয়নি, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত (বিপ্লবের ইতিহাস মনে করালেন সিইসি, চাইলেন সংবিধান স্থগিতের ফরমান, ২৫ আগস্ট, ২০২৪)।
তিনি বিভিন্ন দেশে বিপ্লব ও প্রতি–বিপ্লবের ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত টেনে সম্ভাব্য প্রতি–বিপ্লবের ঝুঁকির কথা বলেছেন। আর সেখানেই লিখেছেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে এক সামরিক বিপ্লবে হত্যা করা হলো। নভেম্বরে আবারও সামরিক বিপ্লব এবং পরে অচিরেই সৈনিক-জনতার অংশগ্রহণে এক সফল প্রতি–বিপ্লব।’
৩ নভেম্বরের ব্যর্থ অভ্যুত্থানকে বিপ্লব ও ৭ নভেম্বরের পরিবর্তনকে ‘প্রতি–বিপ্লব’ অভিহিত করার বয়ানটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজনের একটি গুরুতর বিতর্কের উৎস। একপক্ষীয় বয়ান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তাঁর জবাব কী হবে, সেটা অনুমান করা থেকে বিরত থাকলেও প্রসঙ্গটি উত্থাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন করা আবশ্যক।
কথিত প্রতি–বিপ্লবের ঝুঁকির কথা বলা এবং তার সঙ্গে সাংবিধানিক শূন্যতা বিরাজ করার দাবি মোটেও স্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষ করে তাঁদের নিয়োগ যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিরোধী দলগুলো ও নাগরিক সমাজ থেকে যখন অনেক আগে থেকেই তাঁদের পদত্যাগের জোরালো দাবি ছিল, তখন তাঁরা গণ–অভ্যুত্থানের পরও পদ আঁকড়ে থাকায় তাঁদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
তাঁদের কার্যক্রম, বিশেষ করে একতরফা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের মেয়াদকে দীর্ঘায়িত করার কারণে, তাঁদের অধীন অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনেই আর আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল অংশ নিচ্ছিল না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের যে কথা বলেছিলেন, তা তিনি কীভাবে ভুলে গেলেন? তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘বড় বড় রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, নির্বাচন অশুদ্ধ হবে না। নির্বাচন অবৈধ হবে না; কিন্তু নির্বাচনের যে সর্বজনীনতা, সেটা খর্ব হতে পারে, গ্রহণযোগ্যতা খর্ব হতে পারে, নির্বাচনের যে ন্যায্যতা, সেটাও খর্ব হতে পারে। লিগ্যালিটি নিয়ে হয়তো প্রশ্ন হবে না।
কিন্তু লিগ্যালিটির সঙ্গে লেজিটিম্যাসির যে সম্পর্ক আছে, সেটাকে টোটালি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’ যে নির্বাচনের লেজিটিম্যাসি বা ন্যয্যতা খর্ব হওয়ার কথা স্বীকার করে নেওয়ার পর তো তাঁর নৈতিক দায়িত্ব ছিল অন্য কমিশনারদের নিয়ে তখনই পদত্যাগ করা। দ্বাদশ সংসদের নির্বাচন যদি গ্রহণযোগ্য হতো, তাহলে ইতিহাস ভিন্ন রকম হতো।
হাবিবুল আউয়াল এখন লিখেছেন, ‘সংসদ অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে।’
সংবিধানের ১২৩(৩)খ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে তিনি সংসদ সদস্যদের আসনগুলো শূন্য হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলেছেন। এটি লঙ্ঘনের জন্য তাঁদের মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজার ঝুঁকি আছে বলেও লিখেছেন। অথচ তাঁদের সামনে সংবিধানের ১১৮ (৬) অনুচ্ছেদে পথ বাতলে দেওয়া আছে। ‘রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন’ বিধি অনুসরণে কোনো কারণ দেখানোরও প্রয়োজন নেই।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার পত্রিকায় কলাম লিখতেই পারেন, সেটা তাঁর অধিকার। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বাস্তবতা মেনে পরিবর্তনের পথকে সুগম করতে পদত্যাগ না করে তিনি এমন কিছু কথা লিখেছেন, যাতে একটা রাজনৈতিক সুর আছে। ওই সুরে একটি রাজনৈতিক ধারার প্রতিফলনও আছে। সংবিধান নিয়ে তিনি যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা নিয়ে রাষ্ট্রপতি বা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা না করে তিনি যেভাবে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন, তা খুবই অস্বাভাবিক। আমরা জানি না, তিনি যা লিখেছেন, তা শুধুই তাঁর অভিমত, নাকি পুরো কমিশনের?
আমরা ভুলতে পারি না যে সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি সরকার সবকিছু খুলে দেওয়ার পরও অস্বাভাবিকভাবে আদালতের কার্যক্রম তিন দিন স্থগিত করে দিয়েছিলেন এবং পরে সব বিচারকের (ফুল কোর্ট) একটি সভা ডেকেছিলেন। তাঁর ওই পদক্ষেপকে বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থানের চেষ্টা বলে ছাত্ররা প্রতিবাদী হয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরা বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁরাই আদালতের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন।
একই ধরনের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানেই প্রত্যাশিত নয়।
কামাল আহমেদ সাংবাদিক