ভাত ও ভোট: দুই অধিকার নিশ্চিত করার বুদ্ধি

ইচ্ছা থাকলে উপায় আছে, তবে বুদ্ধিটা ঠিকঠাক প্রয়োগ করতে হয়, সেটাই উপায়।

আমি একটা চিঠি পেয়েছি। অনামা সেই চিঠি আমার মনে হয়েছে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্রকাশ করা উচিত। আমি সামান্য সম্পাদনা করে চিঠিটা তুলে ধরছি:

প্রিয় আনিসুল হক,
সালাম নেবেন। ‘আশা করি ভালো আছেন’ কথাটা আশা করে বলতে পারলাম না। দোয়া করি ভালো থাকুন। নিচের লেখাটা দয়া করে প্রকাশ করবেন।

ভাতের অধিকার। ভোটের অধিকার। রাষ্ট্র জনগণকে এই দুই অধিকার দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। নেতৃবর্গ সোচ্চার। এই অধিকার যদি নিশ্চিত করা যায়, জনগণ খুশি, নেতারা তৃপ্ত এবং গৌরবান্বিত। নেতাদের মুখে যখন খই ফুটতে থাকে—‘আমরা জনগণের ভাতের অধিকার, ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছি। ওরা তো কেড়ে নিয়েছিল,’ তখন সেই খই জনগণের চোখেমুখে এসে খোঁচার মতো লাগে না, খোঁটার মতো লাগে না, বরং জনতা হাসিমুখে হইহুল্লোড় করে খই-মুড়ি খায়।

যদি পেটে খাওয়া যায়, তবে পিঠে খানিকটা সওয়াও যায় বটে। ভাত দেওয়ার মুরোদ যার নেই, তাকে পিটুনি দেওয়ার গোসাই হতে দেখলে পিটুনি খানেওয়ালা তা মেনে নিতে পারে না। যে গরু দুধ দেয়, তার লাথিটা–গুঁতোটা সহ্য করতেই হয়। অন্যদিকে ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। বিশ্বজুড়ে মানুষের একটাই মাতৃভাষা—ক্ষুধা। রফিক আজাদ লিখেছিলেন, ‘উড্ডীন পতাকাসমেত খাদ্যমন্ত্রী এবং তার গাড়ি, আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।’

আসলে সমস্যার সমাধান করতে হয় বুদ্ধি দিয়ে। মহাকাশে বলপেন ব্যবহার করা যায় না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে না বলে কলমের কালি বের হয় না। যুক্তরাষ্ট্র এই সমস্যার সমাধানের জন্য চার বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে একটা কলম আবিষ্কার করল। আর রাশিয়ানরা মহাকাশে নিয়ে গেল ১০ টাকার কাঠপেনসিল। ইচ্ছা থাকলে উপায় আছে, তবে বুদ্ধিটা ঠিকঠাক প্রয়োগ করতে হয়, সেটাই উপায়। আমরা কি সঠিক সময়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারব?

আমাদের সামনে আজ দুটো গুরুতর প্রশ্ন। একটা হলো, আগামী বছরের শেষে যে নির্বাচন হওয়ার কথা, সেটাতে জনগণের ভোটের অধিকার কায়েম হবে কি না, মানে ভোটটা ভালো হবে কি না। আরেকটা জীবন-মরণ প্রশ্ন। আগামী বছর বাংলার মানুষ পেটপুরে খেতে পারবে কি না। দ্বিতীয় সমস্যাটা আন্তর্জাতিক। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এই দুই দেশ গমের প্রধান উৎপাদক ও সরবরাহকারী। এখন সেখান থেকে পৃথিবীর অন্যত্র গমসরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আছে নিষেধাজ্ঞার সমস্যা। অন্যদিকে তেলের দাম গেছে বেড়ে। সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেছে ডলার সংকট। এর ফলে সারের দাম বেড়ে গেছে পৃথিবীজুড়ে। দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন গেছে কমে, ডিজেলের দাম গেছে বেড়ে। কৃষক সেচ দেবেন কীভাবে? ন্যায্যমূল্যে সারই পাবেন কোথায়? ফলে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে নাকি কমবে, এই প্রশ্ন কঠিন, এর উত্তর জানা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি ইঞ্চি জমিতে আবাদ করতে বলছেন। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলছে, এ বছর বিশ্বে খাদ্য অপর্যাপ্ত নয়, সমস্যা হলো, খাদ্যের দাম বেশি। সামনের বছর সার-ডিজেল সংকটের কারণে বিশ্বে খাদ্যের অপর্যাপ্ততাও দেখা দিতে পারে। আমাদের মিতব্যয়ী হতে হচ্ছে। আমাদের কৃচ্ছ্র করতে হচ্ছে। ব্যয়সংকোচন করতে হচ্ছে। সুদিনের সঞ্চয় দুর্দিনের সহায়। ব্যয়সংকোচন করাই সর্বোত্তম পন্থা। তা কৃচ্ছ্র হচ্ছে বটে! কিশোর-কিশোরী ক্লাবের জন্য বরাদ্দ নাশতার টাকা মাথাপিছু ৩০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫ টাকা করা হয়। এখন আর নাশতাই দেওয়া হবে না। বাঁচল দিনে ৫২ লাখ টাকা। সপ্তাহে দুই দিন দেওয়া হতো এই নাশতা। সপ্তাহে বাঁচল ১ কোটি ৪ লাখ। বছর শেষে বেঁচে গেলে ৫৩ কোটি টাকার মতো। তো এই টাকায় ১ লাখ ৭৬ হাজার কিশোরকে নাশতা না খাইয়ে টাকাটা আমরা সচিবের বাড়িতে সুইমিংপুলের জন্য ব্যবহার করতে পারি। বাড়ির ছাদে হেলিপ্যাড করে দেওয়া যায়।

যা–ই হোক, খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতেই হবে। ডিজেল, বিদ্যুৎ, সার দিতেই হবে কৃষককে। ওখান থেকে কাটছাঁট করা যাবে না। এদিকে বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষ থেকে আমরা রক্ষা করব। এই অঙ্গীকার শুনে আমার পরিচিত দুজনকে দুটো আলাদা কাজ করতে দেখেছি। একজন ব্যাংকে গেছেন তাঁর কানাডায় পড়ুয়া সন্তানকে বেশি করে ডলার পাঠিয়ে রাখতে। আরেকজন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে লোহার সিন্দুকে রেখে দিয়েছেন। খুবই আশঙ্কাজনক। কাজেই বলব, আতঙ্ক না ছড়িয়ে ব্যবস্থা নিন। কথা নয়, কাজ চাই।

কাজটা কী হতে পারে? এক ঢিলে দুই পাখি মারা। আমরা চাই ভোটের অধিকার নিশ্চিত থাকুক জনগণের। হোক ভালো নির্বাচন। ভালো নির্বাচন কাকে বলে? ১৯৯৬ সালে ভালো নির্বাচন হয়েছে, ২০০৮ সালে ভালো নির্বাচন হয়েছে। পরীক্ষা করলে আমরা দেখতে পাব, সেসব নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়নি। কাজেই ভালো নির্বাচন মানেই হলো ইভিএম ছাড়া নির্বাচন। এমনকি গত দুটো ঐতিহাসিক নির্বাচনও হয়েছে ইভিএম ছাড়াই। আর তা ছাড়া দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এবং টক শো বক্তা ইভিএম মেশিন চান না। সে ক্ষেত্রে ৮ হাজার ৭১২ কোটি টাকা দিয়ে ইসি যে ইভিএম মেশিন কিনতে চাইছে আর তার প্রচারের জন্য ২০৬ কোটি টাকা চাইছে, তা বন্ধ করে দিলেই হয়। ভালো নির্বাচনও হলো, আর সেই বেঁচে যাওয়া টাকা দিয়ে আমরা হয় সার কিনলাম, না হলে ডিজেল কিনলাম, না হলে চাল-ডাল কিনে রেখে দিলাম। জনগণের ভোটের অধিকার এবং ভাতের অধিকার নিশ্চিতে এক ধাপ এগিয়ে গেলাম। বুদ্ধিটা কেমন দিলাম?
ইতি,
বাংলাদেশের একজন সচেতন বুদ্ধিমান নাগরিক

আরও পড়ুন

নাম না জানা ভদ্রলোকের লেখাটা আমার কেবল পছন্দই হয়নি, কাজের বলেও মনে হয়েছে। আসলে সমস্যার সমাধান করতে হয় বুদ্ধি দিয়ে। মহাকাশে বলপেন ব্যবহার করা যায় না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে না বলে কলমের কালি বের হয় না। যুক্তরাষ্ট্র এই সমস্যার সমাধানের জন্য চার বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে একটা কলম আবিষ্কার করল। আর রাশিয়ানরা মহাকাশে নিয়ে গেল ১০ টাকার কাঠপেনসিল। ইচ্ছা থাকলে উপায় আছে, তবে বুদ্ধিটা ঠিকঠাক প্রয়োগ করতে হয়, সেটাই উপায়। আমরা কি সঠিক সময়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারব?

  • আনিসুল হক সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক