ইউরোপে নতুন এক অন্ধকার যুগ নেমে আসছে?

ফ্রান্সের কট্টর ডানপন্থী নেত্রী মারি–লো পেনছবি : এএফপি

গত সপ্তাহে ইউরোপ মহাদেশের রাজনীতিতে যেন একটি ভূমিকম্প হয়ে গেছে এবং সেই ভূমিকম্পে সেখানকার রাজনীতি ডানপন্থার দিকে হেলে পড়েছে।

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচনে জার্মানি, গ্রিস, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, স্পেন, হাঙ্গেরিসহ বিভিন্ন দেশে উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দলগুলোকে এগিয়ে থাকতে দেখা গেছে।

৬ থেকে ৯ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ভোটের পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর মধ্যপন্থী দল রেনেসাঁ পার্টি ও তাদের ইউরোপপন্থী জোট বেসোইন দো’ ইউরোপ কট্টর ডানপন্থী নেত্রী মারি লো পেনের দল ন্যাশনাল র‍্যালির কাছে বড় ব্যবধানে হেরে গেছে। ফলে মাখোঁ আগাম পার্লামেন্ট নির্বাচন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এবং সেটিই এখন সবার মনোযোগের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৯৪০ সালে নাৎসিদের সঙ্গে মার্শাল ফিলিপ পেতেনের যূথবদ্ধতায় সহযোগিতাবাদী ভিচি শাসন প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথমবারের মতো ফ্রান্স একটি চরম ডানপন্থী সরকারের মুঠোর মধ্যে যাওয়ার হুমকিতে পড়েছে।

আরও পড়ুন

এটি হলে তা বৃহত্তর ইউরোপীয় প্রকল্পের জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি বয়ে আনতে পারে। কারণ, ব্রেক্সিটের মধ্য দিয়ে ব্রিটেন যেভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, ফ্রান্সে কট্টর ডানপন্থীরা ক্ষমতায় এলে একই কায়দায় ইউরোপ থেকে ফ্রান্সের বেরিয়ে যাওয়া প্রশ্নে ফ্রেক্সিট গণভোট আয়োজনের পথ প্রশস্ত হয়ে যাবে।

ব্রেক্সিট যুক্তরাজ্যের জন্য কতটা খারাপ পরিণতি ডেকে এনেছে, তার সম্যক প্রমাণ থাকার পরও ডানপন্থীরা ফ্রেক্সিট বাস্তবায়নে ঝুঁকে পড়তে পারে।

ইউরোপের অন্য দেশগুলোর কথা নাহয় মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে জার্মানিতে অতি ডানপন্থীদের বাড়বাড়ন্তকে সবচেয়ে অশুভ ও সবচেয়ে পরিহাসপূর্ণ অবস্থা বলা যায়।

রক্ষণশীল দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন ও ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়নের জোট জার্মানিতে ইউরোপীয় নির্বাচনে প্রথম স্থান লাভ করতে পারে।

কিন্তু আসল ধাক্কার বিষয় হলো, নবগঠিত জনতুষ্টিবাদী দল অলটারনেটিভ ফার ডয়েশল্যান্ড ১৬ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

ঠিক ১০০ বছর আগে, অর্থাৎ ১৯২৪ সালে ফিরে গেলে দেখা যাবে, সে বছর জার্মানির প্রথম জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল নবগঠিত জনতুষ্টিবাদী দল ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট ফ্রিডম পার্টি (এনএসএফপি)।

ইউরোপের এই সদ্য পুনরুত্থিত ডানপন্থী দলগুলোর প্রতিটিরই একটি বিষয়ে নাৎসিদের সঙ্গে মিল রয়েছে। সেটি হলো, তারা অর্থনৈতিক সমস্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়া নাগরিকদের কাছে তাদের দুর্দশার পেছনে সরকারগুলোর অভিবাসী নীতির হাত আছে বলে দাবি করছে।

এনএসএফপি ছিল নিষিদ্ধ হওয়া ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির (যা নাৎসি পার্টি নামে বেশি পরিচিত) একটি ফ্রন্ট। মিউনিখ ‘বিয়ার হল’খ্যাত ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় নাৎসি পার্টির নেতা অ্যাডলফ হিটলার জেলে বন্দী ছিলেন।

এনএসএফপি ১৯২৪ সালের নির্বাচনে খুব খারাপ ফল করেছিল। সে বছর তারা মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।

কিন্তু পরের ৯ বছরের মধ্যে হিটলার চ্যান্সেলর হিসেবে একটি জোট সরকারের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এর পরের বছর ১৯৩৪ সালের আগস্টে তিনি নিজেকে ‘ফুয়েরার’ ঘোষণা করে জার্মানিকে একটি সর্বগ্রাসী একনায়কতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন।

পরের ইতিহাস মর্মান্তিক। পরের ইতিহাস রক্তাক্ত। পরের ইতিহাস এমন এক ইতিহাস, যা এক শতাব্দী পরও মনে পড়লে আমাদের শিউরে উঠতে হয়। তার পুনরাবৃত্তির লক্ষণ আমাদের জন্য নিদারুণ উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে।

গত সপ্তাহে যেসব ঘটনা ঘটে গেছে, তা বোঝানোর জন্য সম্ভবত ‘বিড়ম্বনা’ একটি অপর্যাপ্ত শব্দ।

ইউরোপকে নাৎসিদের কবল থেকে মুক্ত করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল যে মিত্র বাহিনী, সেই মিত্র বাহিনীর ফ্রান্সে অবতরণের ৮০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপনের জন্য ৬ জুন নরম্যান্ডিতে ইউরোপের নেতারা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো একত্র হয়েছিলেন।

কিন্তু তার কয়েক দিনের মধ্যেই ইউরোপের ভোটাররা ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনে তাদের সর্বকালের সবচেয়ে বড় সমর্থন অতি-ডানপন্থী দলগুলোর হাতে তুলে দিয়েছেন।

অবশ্য ইউরোপীয় মিডিয়া বা রাজনীতিতে কোনো আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নীতিকে নাৎসিদের সঙ্গে তুলনা করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু ভয়াবহ বাস্তবতা হলো, এক শতাব্দী আগে নাৎসিদের মাধ্যমে যে ভূত জার্মানির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল, সেই ভূত আবার ইউরোপে ফিরে এসেছে।

ইউরোপের এই সদ্য পুনরুত্থিত ডানপন্থী দলগুলোর প্রতিটিরই একটি বিষয়ে নাৎসিদের সঙ্গে মিল রয়েছে। সেটি হলো, তারা অর্থনৈতিক সমস্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়া নাগরিকদের কাছে তাদের দুর্দশার পেছনে সরকারগুলোর অভিবাসী নীতির হাত আছে বলে দাবি করছে।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো ও আবাসনের অভাবের মতো বিষয় থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়া এবং স্কুল ও কারাগারে ভিড় বেড়ে যাওয়ার মতো বিষয়ে তারা অভিবাসীদের দায়ী করে যাচ্ছে।

ইউরোপের প্রতিটি দেশ এখন এই অশুভ মতবাদের সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করেছে এবং কোনো কোনো স্তরে এই ভাষ্যকে মেনে নিচ্ছে।

উদাহরণ হিসেবে ব্রিটেনের কথা বলা যেতে পারে। ২০০৬ সালে দেশটি জনতুষ্টিবাদের এই পিচ্ছিল ঢালে পা রেখেছিল। সে বছর সেখানে ইউরোস্কেপটিক ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টি (ইউকেআইপি) নামের একটি নতুন ডানপন্থী দল আসে। নতুন দল হিসেবে তখন কেউ তেমন এটিকে পাত্তা দেয়নি। সাবেক ধনকুবের নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বাধীন এই দলকে নিয়ে অনেকে ঠাট্টা–তামাশা পর্যন্ত করেছিলেন।

কিন্তু ফারাজ ইউরোপে অভিবাসীদের আসা এবং তাদের কারণে শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শ্রমিকদের ওপর কী কী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সেগুলোকেই তাঁর নির্বাচনী প্রচারের প্রধান বিষয় করে তুলেছিলেন। এটি কাজেও দিয়েছিল।

২০১৪ সালে ইউকেআইপি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জয় করে মূলধারার দলগুলোকে চমকে দিয়েছিল।

ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির যে ডানপন্থী সদস্যরা যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে তাঁদের আসনগুলো নাইজেল ফারাজের দল দখল করে নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছিলেন, তাঁদের সন্তুষ্ট করার জন্য ২০১৫ সালে কনজারভেটিভ দলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন দেশটি ইইউর সদস্য থাকবে কি না, তা নিয়ে একটি জাতীয় গণভোট করতে রাজি হয়ে যান।

যুক্তরাজ্যের জাতীয় নির্বাচনে ইউকেআইপি একটি মাত্র আসনে জিতেছিল। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গিয়েছিল। ২০১৬ সালের ২৩ জুন ব্রিটিশরা ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে ভোট দিয়ে দেয়।

এখন সেই ফারাজ ইউকেআইপির উত্তরসূরি দল রিফর্ম ইউকের প্রধান হিসেবে ফিরে এসেছেন। দলটি আগামী ৪ জুলাই অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেবে এবং কনজারভেটিভ পার্টি এখন যে বেসামাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এটির ফায়দা তারা নির্বাচনে তুলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আমরা বুঝতে পারছি, প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার মাধ্যম খণ্ডিত হয়ে যাওয়া ইউরোপ গোটা বিশ্বকে আবারও মর্মান্তিক সংঘাতের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যা ঘটেছিল, তা যাতে আর না ঘটে, সে চেষ্টার অংশ হিসেবে গঠিত ইইউ এখন সেই সব জাতীয়তাবাদী চরমপন্থীদের দখলে চলে যাচ্ছে, যারা নিজেদের একটি পতাকায় মুড়িয়ে ক্ষমতা নিতে চাচ্ছে এবং সবচেয়ে খারাপ লোকদের কাছে তারা সাহায্যের আবেদন করছে।

ইউরোপীয় ইতিহাস আমাদের শেখায়, রাজনৈতিক ও নৈতিক সমঝোতার অংশ হিসেবে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার প্রবণতার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।

তবে খোদ ইউরোপীয়রা এই পাঠ আত্মস্থ করেছে কি না, তা জানতে একটি উদ্বিগ্ন বিশ্বকে এখন অপেক্ষা করতেই হবে। এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

আরব নিউজ থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

জনাথন গরনাল যুক্তরাজ্যের লেখক ও সাংবাদিক