আজকে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় একটি ছবি ছাপা হয়েছে। ১৬ বছর ১০ মাস বয়সী এক কলেজশিক্ষার্থীকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ও দড়ি বেঁধে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়েছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী পরিস্থিতিতে এমন আরও অল্পবয়সী গ্রেপ্তার হচ্ছে।
এর আগে শনিবার আইনগতভাবে শিশু হিসেবে স্বীকৃত একজন শিক্ষার্থীকে সাত দিনের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দিয়েছিলেন ঢাকার একটি আদালত। সেটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সচেতন মহলে তুমুল সমালোচনা তৈরি হয়।
এক দিন পর ওই শিক্ষার্থীর আইনজীবী আবারও আবেদন করলে আদালত সেই রিমান্ড বাতিল করেন। পাশাপাশি তাকে টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। তার মানে সেই কিশোরের এখনো জামিন হয়নি, সে এখনো একপ্রকার বন্দী।
আর জামিন হলেও এখানে অনেক প্রশ্ন রয়ে যায়। কারণ, আরও অল্প বয়সীদের গ্রেপ্তারের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে পরবর্তী সময়ে একই ধরনের পরিস্থিতি দেখতে না চাইলে, প্রশ্নগুলো আমাদের হাজির করা উচিত।
আমাদের আলোচনার সেই কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় করা পুলিশ সদস্য হত্যা মামলায়। তবে অভিযোগ উঠেছে, তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি চার দিন পর স্বীকার করা হয়েছে। সদ্য স্কুল পার করা উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীকে এভাবে হত্যা মামলার আসামি করা, তা–ও পুলিশ হত্যা মামলার, বিষয়টি মেনে নেওয়া কঠিন।
এখানে স্পষ্ট ধারণা করা যায়, অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; সুনির্দিষ্ট আসামি হিসেবে নয়। কারণ, আন্দোলন নিয়ে মামলাগুলো বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি প্রতীয়মান হয়।
আইনজীবীর পক্ষ থেকে জন্মসনদসহ একাডেমিক সার্টিফিকেট আদালতে উপস্থাপন করার পরও কেন তাকে রিমান্ড দেওয়া হয়েছিল? শিশুদের ব্যাপারে খুবই স্পষ্ট বিশেষ আইন আছে, সেটি কেন এখানে গুরুত্ব পেল না?
পুলিশ-ইবা কীভাবে চার দিন যাবৎ এই শিশু ছেলেকে গোপনে আটক করে রাখল এবং একটা শিশু ছেলের রিমান্ড কেন চাইল? মানে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি ধাপে আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। এই প্রতিটি জিনিসের উপযুক্ত তদন্তসহ ব্যবস্থাগ্রহণ করা না হলে শুধু এই কিশোরের রিমান্ড বাতিল বা জামিন হলেই সামগ্রিক বেআইনি কাজের ক্ষতিপূরণ হয় না।
আরও অবাক করার বিষয়, এ কিশোরের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল সমালোচনা ওঠা এবং একপ্রকার জনমতের চাপ তৈরি হওয়ার পর তার রিমান্ড বাতিলের নির্দেশ এল। তার মানে এ প্রশ্নও ওঠে, জনমতের এই চাপ তৈরি না হলে ওই কিশোরের রিমান্ড বাতিল হতো না। এখানে জনমতের চাপ আদালতকে কতটা প্রভাবিত করেছে, সেটি নিয়ে আরও বড় আলোচনা হতে পারে।
এবার শিশুদের জন্য বিশেষ আইনটি দেখি, যেটি শিশু আইন-২০১৩ নামে পরিচিত।
১. এই আইনের ৩ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে—
‘আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে।’
মানে কোনো অভিযোগে বিচার বা গ্রেপ্তার বা আটকসংক্রান্ত ইস্যুতে অন্য কোনো আইনে যা–ই বলা থাক না কেন, অভিযুক্ত যদি কোনো শিশু হয়, তাহলে শিশু আইন অনুযায়ীই করতে হবে সবকিছু, অন্য কোনো আইন বলবৎযোগ্য হবে না।
২. প্রশ্ন হলো আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার ওই শিক্ষার্থী কি শিশু ছিল?
অবশ্যই সে শিশু ছিল। তার জন্মসনদ ও একাডেমিক সার্টিফিকেট আদালতে উপস্থাপন করেছিলেন তার আইনজীবী। সে অনুযায়ী তার বয়স ১৭ বছর ৩ মাস। শিক্ষার্থীটি এই ২০২৪ সালে এসএসসি পাস করে ঢাকার একটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষে মাত্রই ভর্তি হয়েছে, তার ক্লাসও শুরু হয়নি।
শিশু আইনের ৪ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাই শিশু। অতএব, ওই শিক্ষার্থীর ওপর শিশু আইনের বাইরে অন্য কোনো আইনি কার্যক্রম চলতে পারে না।
৩. তার বিচার করা হয়েছে অন্য সবার মতো ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। অথচ শিশু আইন অনুযায়ী শিশু আদালত ব্যতীত অন্য কোনো আদালতের এই বিচার করার কোনো এখতিয়ারই নেই, কোনো অবস্থাতেই নয়। অর্থাৎ তার এই বিচারের পুরো প্রক্রিয়াটাই হয়েছে আইনি প্রক্রিয়াবহির্ভূত।
৪. ওই শিক্ষার্থীকে যখন আদালতে হাজির করানো হয়, তার হাতে হাতকড়া পরানো, রশি দিয়েও হাত-মাজা পেঁচিয়ে বাঁধা ছিল। অথচ শিশু আইনের ৪৪(৩) ধারা অনুযায়ী, গ্রেপ্তার করার পর শিশুকে কোনো অবস্থাতেই হাতকড়া বা মাজায় দড়ি বা রশি পরাতে পারবে না পুলিশ।
৫. গুরুতর আরও একটা অভিযোগ আছে শিক্ষার্থীটির পরিবারের পক্ষ থেকে। গ্রেপ্তারের চার দিন তার কোনো খোঁজই তাঁদের জানানো হয়নি। চার দিন পর তাকে আদালতে হাজির করেছে পুলিশ, তবু পরিবারের লোকদের জানানো হয়নি। পরিবারের লোকজন এই চার দিনের প্রতিটা দিন কোর্ট চত্বরে গিয়ে খোঁজ করেছেন তার। অবশেষে চতুর্থ দিনে গিয়ে কাকতালীয়ভাবে পেয়ে গেছে তাকে। এটিও আইনের গুরুতর লঙ্ঘন।
অথচ ওই কিশোরকে আটকের সঙ্গে সঙ্গেই পরিবারের লোককে জানানো ছিল আইন অনুযায়ী অবধারিত। এমনকি শিশু আইনের অধীনে আদালতে বিচার হতে হলেও অভিভাবককে সঙ্গে রাখাটা আইনি বিধান। কিন্তু পুলিশ পুরো কাজটাই করেছে পরিবারকে না জানিয়ে; যা আইনের অত্যন্ত গুরুতর লঙ্ঘন।
৬. গুরুত্বপূর্ণ আরেকটা প্রশ্ন হলো আদালত কি কোনো শিশুকে রিমান্ড দিতে পারেন? উত্তর হলো, পারেন না। শিশুকে রিমান্ডে পাঠানোর কোনো বিধানই নেই আইনে।
৭. ওই কিশোর শিক্ষার্থীর কি জামিন প্রাপ্য ছিল? অবশ্যই ছিল। শিশু আইনের ৫২ ধারায় জামিনের ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা আছে। অথচ তাকে জামিন না দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে।
শিশু আইন একটা বিশেষ আইন। এই আইন অনুসারে পুলিশ নিজেই শিশুকে অভিভাবকের জিম্মায় ছেড়ে দিতে পারত কোর্টে সোপর্দ করার আগেই। তার অপরাধ জামিনযোগ্য নাকি জামিন অযোগ্য, সেটিও বিবেচনা করার দরকার পড়ে না এই আইন অনুযায়ী। তা ছাড়া কোনো বিশেষ কারণে পুলিশ তাকে না ছেড়ে দিয়ে যদি শিশু আদালতে প্রেরণ করে, সেখান থেকে অবশ্যই জামিন পাওয়ার অধিকার আছে শিশুর। কোনো অবস্থাতেই রিমান্ডে পাঠানোর সুযোগ নেই।
৮. আর যদি বিশেষ কোনো কারণে তাৎক্ষণিক জামিন না–ও দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে শিশু আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী, শিশুকে নিরাপদ হেফাজতে রাখার আদেশ দিতে পারেন আদালত। এই নিরাপদ হেফাজত মানে কিন্তু সাধারণ জেল নয়।
তা ছাড়া ওই আইনেই উল্লেখ আছে, এই নিরাপদ হেফাজতে রাখার বিষয়টি যদি বিবেচনা করতেও হয় (কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে), সেটা সর্বশেষ পন্থা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে, যার মেয়াদ হবে যথাসম্ভব স্বল্পতম সময়ের জন্য। এখন ওই কিশোরকে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। এখন সেখান থেকে ওই শিক্ষার্থীর কবে জামিন হয়, সেটি দেখার অপেক্ষা।
আলোচ্য এই কিশোরের ইস্যুতে শুধু যে দেশীয় আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হয়েছে সেটিই নয়; বাংলাদেশ কিন্তু জাতিসংঘ প্রণীত কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চিলড্রেনের (সিআরসি) সঙ্গে সম্মতকারী দেশ। ফলে ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে যা ঘটেছে, তা জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদেরও (সিআরসি) চূড়ান্ত লঙ্ঘন। কারণ, শিশু আইন, ২০১৩ বাংলাদেশ প্রণয়ন করেছেই জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদকে আত্তীকরণ করতে।
ওই কিশোরসহ অল্প বয়সী আরও যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের ব্যাপারে কোনোভাবেই আইন লঙ্ঘনের সুযোগ নেই। আইন অনুযায়ী শিশু-কিশোরেরা পূর্ণ সুরক্ষা পাক, সেটি নিশ্চিত করা হোক।
সাইয়েদ আবদুল্লাহ আইন ও আদালত বিষয়ে লেখক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অ্যালামনাই।