ইদানীং গুবরে পোকার মতো যাদব বাবুর পাটিগণিত গোবর ভরা এই মাথার মধ্যে ঘোরে আর টুক টুক করে অঙ্ক কষে। কিন্তু অঙ্ক মেলে না। জিডিপি, মাথাপিছু আয়, ফরেন রিজার্ভ—এ ধরনের শক্ত শক্ত জিনিস যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করার পর হাতে থাকে যে ‘উন্নয়ন’; তা থেকে অপচয়, ‘গুনাগারি’, দুর্নীতি ও মারিং-কাটিং বিয়োগ করার পর চূড়ান্ত বিয়োগফল হিসেবে দাঁড়ায় একটি ছড়া: ‘চড়ুই পাখি বারোটা, ডিম পেড়েছে তেরোটা, একটা ডিম নষ্ট, চড়ুই পাখির কষ্ট।’
ডলারের আকাল পড়ায় দেশ যখন আইএমএফের কাছ থেকে হাওলাত করার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে, তেল-গ্যাসের ঘাটতিজনিত ঘোর কৃষ্ণকায় লোডশেডিংয়ে যখন পাবলিকের জান কয়লা হচ্ছে, আগুন দরের বাজারে ঢুকে পটোলের কেজি ৮০ টাকা শুনে যখন তা খাব নাকি তুলব বলে দোনোমনা করছি, ঠিক সেই সময়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) জানাল, আগামী নির্বাচনে দেড় শ আসনে ইভিএমে ভোট করার জন্য মাত্র ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা দিয়ে ২ লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনা হবে।
মেশিন-প্রতি দাম পড়বে মাত্র ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৫৫০ টাকা। মাস কাবারি মায়না দিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে কাপড় খোলা দশায় পড়া বিধ্বস্ত বাবাকে তাঁর অতি আধুনিক ফিটফাট ফুলবাবু মার্কা ছেলে ‘আব্বা, একটা আইফোনের অর্ডার দিয়া আসলাম’ বলার পর বাবার যে অবস্থা হয়, এই খবরটি আমাদের প্রায় সেই কিসিমের একটি নাতিদীর্ঘ ধাক্কা দিয়েছে।
এই ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই জানা গেল, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে, অর্থাৎ ২০১৮ সালে ইসি ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা দিয়ে যে দেড় লাখ ইভিএম কিনেছিল (যার প্রতিটির দাম পড়েছিল ২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা) তার ২৮ হাজারই নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। বিকল ইভিএমগুলোর ‘ওয়ারেন্টি ডেট’ থাকলেও সেগুলো বিনা পয়সায় সারাই করা যাবে কি না বা সারাই করতে পয়সা লাগলে সেই বাবদ ঠিক কত পয়সা ‘গুনাগারি’ যাবে তা পরিষ্কার না। এই ‘আজুরিয়া’ ব্যয়সংক্রান্ত সুললিত খবরে চড়ুই পাখির ডিম পাড়াবিষয়ক সেই সুশ্রাব্য ছড়াটি আমাদের আরেক দফা মনে পড়ে যায়।
রাজার মতো বাজার করা লোকের কাছে হয়তো প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকায় ইভিএম কেনা আর আগের কেনা মেশিনের ৩০ শতাংশ নষ্ট হওয়ার খবরে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যাঁদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কামাই করা ডলারে এই আয়োজন, তঁাদের তো এই খবরে মাথা নষ্ট হওয়ার কথা।
মনে মনে ‘একটা ডিম নষ্ট, চড়ুই পাখির কষ্ট’ বলতে বলতে আঙুলের কর গুনে যদি যাদব বাবুর পাটিগণিতে হিসাব করি, তাহলে কী দাঁড়ায়? নতুন ইভিএমের খরচ ৮৭১১ কোটি টাকা + আগের ইভিএমের খরচ ৩৮২৫ কোটি টাকা= ১২৫৩৬ কোটি টাকা। ৩০০ আসনের মোট ভোটারের সংখ্যা ১১ কোটি ৩২ লাখ হলে মোটাদাগে ১৫০ আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা ৫ কোটি ৬৬ লাখ। সেই হিসাবে শুধু ইভিএম যন্ত্র বাবদ এই দেড় শ আসনে প্রত্যেক ভোটারের পেছনে খরচ কত হবে, তা জানতে আমাদের ১২ হাজার ৫৩৬ কোটিকে ৫ কোটি ৬৬ লাখ দিয়ে ভাগ করতে হবে। সে হিসাবে ভোটারপিছু ইভিএম বাবদ খরচ হবে ২ হাজার ২১৪ টাকা।
শুধু ইভিএম নামক যন্ত্রটি বাবদ ভোটারপ্রতি এই খরচ হবে। এই টাকায় আমরা যে যন্ত্র কিনব, তার সঙ্গে মাগনা পাচ্ছি বিরোধী দলের ঘোর আপত্তি, সাধারণ ভোটারের অবিশ্বাস ও বিশেষজ্ঞদের কারচুপির আশঙ্কাসহ নানা কিছু।
অথচ এই টাকা খরচ না করলেও কাজ চলে যেত। কিন্তু শুধু ‘কাজ চললে’ আমাদের চলে না; কারণ রবি ঠাকুরের মতো আমরাও বিশ্বাস করি ‘ছাগলের যতটুকু শিং আছে তাহাতে তাহার কাজ চলিয়া যায়, কিন্তু হরিণের শিঙের পনেরো-আনা অনাবশ্যকতা দেখিয়া আমরা মুগ্ধ হইয়া থাকি।’ ক্ষেত্রবিশেষে ‘পনেরো-আনা অনাবশ্যকতা’র মুগ্ধতা আমাদের কাছে ষোলো আনার চাইতেও আবশ্যিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
নির্বাচন আসতে এক বছরের একটু বেশি বাকি। কিন্তু বিএনপি এখনই নির্বাচন নিয়ে বেশ সরব হয়েছে। তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেবে না—এই দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। সরকার তাতে পাত্তা দিচ্ছে না। দুই–চার দিন পরপরই বিএনপির ওপর আওয়ামী লীগ কর্মীরা হামলা করছে। তাতে বিএনপির কর্মীরা ডুব দিচ্ছে কিন্তু ডুবে যাচ্ছে না।
খানিক পরই মাথা তুলে নিজের উপস্থিতির জানান দিচ্ছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন বিএনপি কর্মী হামলার শিকার হয়ে মারা গেছে। তারপরও তারা মাঠ ছাড়ছে না। এই ধারাবাহিকতা যদি চলতে থাকে তাহলে সংঘাতময় অবস্থা কত দূর গড়াবে এবং তার ফলে ঠিক সময়ে, ঠিকমতো ভোট হবে কি না, সেটাই কেউ ঠিক করে বলতে পারছে না।
আমাদের লক্ষ্য ভোট। উপলক্ষ ব্যালট কিংবা ইভিএম। কিন্তু উপলক্ষটা লক্ষ্যকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। ভোটের সরঞ্জাম কেনায় ইসির যতটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, ভোটকে অংশগ্রহণমূলক করার ও ভোটের বিষয়ে ভোটারের মধ্যে আগ্রহ পয়দা করার বিষয়ে ততটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পিষ্ট হওয়ার কালে কোটি কোটি ডলার পাচার ও যুক্তিহীন ব্যয়ের খবরে তারা কতটা বিক্ষুব্ধ ও ভোটবিমুখ হয়েছে, তা এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে উপলব্ধির অন্তর্লোকে উঁকি মারছে।
রাজার মতো বাজার করা লোকের কাছে হয়তো প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকায় ইভিএম কেনা আর আগের কেনা মেশিনের ৩০ শতাংশ নষ্ট হওয়ার খবরে কিছু যায় আসে না। কিন্তু যাঁদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কামাই করা ডলারে এই আয়োজন, তঁাদের তো এই খবরে মাথা নষ্ট হওয়ার কথা। ট্রাফিক জ্যামে তাঁদের জীবনের ‘ডাবল ডেকার’ ক্লান্তিতে হাঁপায়।
ডিমকে যেমন কুসুম থেকে, হিমোগ্লোবিনকে যেমন রক্ত থেকে আলাদা করা যায় না; তেমন করেই যেহেতু রাজনীতিকে জীবন থেকে আলাদা করা যায় না, সেহেতু রাজনৈতিক রুচির গোডাউন লুট হয়ে গেছে জেনেও তঁারা ভোটের দিকে চেয়ে থাকেন।
সে কারণেই ভোটের চেয়ে ভোটের যন্ত্র কেনায় অধিক আগ্রহ তঁাদের ক্ষুব্ধ করে। রক্তের পয়সায় কেনা ইভিএমের অবহেলাজনিত নষ্ট হওয়ার খবরে ‘একটা ডিম নষ্ট’ হওয়া চড়ুই পাখির মতো তঁাদের কষ্ট হয়। এই কষ্ট মানুষের। এই কষ্ট গণতন্ত্রের।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক