বিএনপির ৩১ দফা ও মধ্যপন্থী রাজনীতি কেন গুরুত্বপূর্ণ

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) কয়েক বছর ধরেই রাষ্ট্রকাঠামো নিয়ে সংস্কারের কথা বলে আসছে। ২০১৬ সালে খালেদা জিয়া দলটির ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেন। এরপরের কয়েক বছর ধরে দলের অভ্যন্তরে ও শরিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা শেষে জুলাই ২০২৩-এ দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৩১ দফার ঘোষণা দেন। যদিও বিএনপি ও এর শরিক দলগুলো বিভাগীয় পর্যায়ে তাদের ৩১ দফা নিয়ে সেমিনার ও আলোচনা সভা করেছিল, কিন্তু তা সাধারণ জনগণের কাছে খুব একটা পৌঁছায়নি।

পতিত ফ্যাসিস্ট আমলে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মী ও নাগরিক সমাজের ওপরে নির্যাতন ও বাক্‌স্বাধীনতার অভাবের কারণে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতেও বিরোধী দলগুলোর সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে খুব বেশি আলোচনা লক্ষ করা যায়নি। বিএনপির সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক সমাজের মধ্যে ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ নামের সংগঠনটিও রাষ্ট্রকাঠামো মেরামত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার নিয়ে আলোচনা নতুন মাত্রা পায়। বিএনপির সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থী, নাগরিক কমিটি, জামায়াতে ইসলামীসহ সুশীল সমাজের অনেকেই রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও শাসনকাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন যে দরকার, তা নিয়ে একমত হয়। এরই মধ্যে নাগরিক কমিটি সাংবিধানিক পরিবর্তন-সংক্রান্ত বেশ কিছু দাবিও পেশ করেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে সংবিধান সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন, শ্রম সংস্কার কমিশন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনসহ ১৫টি কমিশন গঠন করা হয়েছে।

আশার কথা হচ্ছে সংস্কার যে দরকার, সে নিয়ে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, শিক্ষার্থী ও অন্তর্বর্তী সরকার—কারোরই কোনো দ্বিমত নেই। এটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রথম পদক্ষেপ। দ্বিমত ও দ্বিধা রয়েছে দুটি বিষয়ে। দ্বিমত লক্ষ করা যায় কখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং কোন সরকারের অধীন মূল সংস্কার হবে, তা নিয়ে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই বড় ধরনের সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি করে যেতে পারে, কিন্তু সংস্কার করা উচিত নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই।

আরেকটি বিষয়ে কারও কারও মধ্যে দ্বিধা রয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রতিশ্রুত সংস্কার করবে কি না। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের নানা দেশেই রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু বিএনপি সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে তাদের রাজনৈতিক প্রচারণা চালাচ্ছে, তার মূল ভিত্তিই হচ্ছে ৩১ দফা।

গত কয়েক মাসে বিএনপির যত রাজনৈতিক কর্মসূচি হয়েছে, তার প্রতিটি রাষ্ট্র সংস্কার ও ক্ষমতায় গেলে বিএনপি জনগণকে ৩১ দফার কোন কোন সুবিধা দেবে, তা ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে কর্মশালার মাধ্যমে বিএনপি ৩১ দফার প্রচারণা চালাচ্ছে। রাজধানীতেও বিভিন্ন এলাকায় তারা ৩১ দফাকেন্দ্রিক সমাবেশ ও কর্মশালা করছে।

অর্থাৎ বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে দলটি ৩১ দফা ও এর প্রধান সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ৩১ দফার এই গুরুত্ব ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা দেখে বোঝা যাচ্ছে, বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহার ও ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনা এই দফাগুলোকে ঘিরেই হবে। তাই এই দফাগুলো শুধু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, বরং দলটির আগামী রাজনীতির রূপরেখা। বিচ্ছিন্ন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সহজ, কিন্তু দলের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ক্ষমতায় গিয়ে পাল্টে দেওয়া কঠিন। কারণ, ৩১ দফার ওপরেই নির্ভর করছে বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি কেমন হবে এবং কতটুকু সফলভাবে তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও অন্যান্য শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতিদিনের বক্তব্যও এখন ৩১ দফাকেন্দ্রিক। তাই সংস্কারের এই রূপরেখা ভঙ্গ করা দলটির জন্য কঠিন হবে।

আরও পড়ুন

বিএনপির ৩১ দফায় দুটি ভাগ লক্ষ করা যায়। প্রথম ভাগে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের প্রস্তাব রয়েছে। যেমন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা তৈরি করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারা এবং সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের দফা ইত্যাদি। এ ছাড়া গণমাধ্যম কমিশন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন, সংবিধান সংস্কার কমিশন, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন গঠন ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারের প্রস্তাব রয়েছে বিএনপির ৩১ দফায়।

দ্বিতীয় ভাগ রাষ্ট্রকাঠামোর সঙ্গে জড়িত না হলেও তা দৈনন্দিন জীবনে মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, দ্রব্যমূল্য, চাকরি, মজুরি ইত্যাদি মৌলিক বিষয় এখনো নিশ্চিত না হওয়ার কারণে রাষ্ট্রকাঠামোর সঙ্গে সঙ্গে এসব বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি।

বিএনপির সংস্কার প্রস্তাবে শিক্ষিত বেকারদের এক বছর পর্যন্ত ভাতা, নারীদের জন্য ফ্যামিলি কার্ড, কৃষকদের জন্য কৃষি কার্ড, ব্রিটিশ স্বাস্থ্যসেবার আদলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে এই সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে। ১৮ নম্বর দফায় বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

বিএনপির ৩১ দফা নিয়ে দলের বাইরে গণমানুষের ভেতরেও আরও আলোচনা প্রয়োজন। কারণ, এখানে বিএনপি বেশ কিছু বিষয়ে দলটির অবস্থান পরিষ্কার করেছে। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলেছে।

গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, অমানবিক নিষ্ঠুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো ও ক্রসফায়ার বন্ধের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। আশার কথা হচ্ছে, সম্প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তুলে পুলিশ সংস্কার কমিশনের কাছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছে বিএনপি। বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দলের কাছ থেকে এ ধরনের শক্ত অবস্থান মানবাধিকার রক্ষার জন্য একটি সুখবর।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিএনপির অবস্থানও আশাব্যঞ্জক। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে দলটির ব্যবধান ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। ২১ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে যার যার অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।’

এ ছাড়া ১৫ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ‘দলমত ও জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল জাতিগোষ্ঠীর সংবিধান প্রদত্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্ম-কর্মের অধিকার, নাগরিক অধিকার এবং জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হবে।’ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রদানের কথা উল্লেখ করে ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং তাদের সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে দলটি।

বিএনপির এই মধ্যপন্থী ও বহুত্ববাদী রাজনীতিকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। আগামী দিনের বাংলাদেশের রাজনীতি কোন দিকে যাবে, তার অনেকাংশই নির্ভর করবে বিএনপি কতটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদ’ভিত্তিক এই রাজনীতিকে আলিঙ্গন করবে, তার ওপর।

  • ড. সাইমুম পারভেজ ডয়চে ভেলে একাডেমি ও বন রাইন-জিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক যোগাযোগ বিষয়ের শিক্ষক