ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ভূখণ্ড ও সামুদ্রিক পরিমণ্ডলের স্থিতিশীল অবস্থাকে বদলে দেওয়ার জন্য প্রায় এক দশক ধরে চীন অতি গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। চীনের তৎপরতার কারণে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান, তাইওয়ানের মতো আঞ্চলিক প্রতিবেশী দেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ পর্যায়ে গড়াচ্ছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ত পর্যায়ে চলে গেছে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তার মনোযোগ ও সক্ষমতা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতের দিকে নিবদ্ধ করেছে। এতে চীন তার সম্প্রসারণবাদে অনেক বেশি মারমুখী হয়ে উঠেছে।
এ মুহূর্তে চীনের আঞ্চলিক আধিপত্য বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই চীন নতুন নতুন কায়দায় তাইওয়ানকে ভয়ডর দেখাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বারবার চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে তাইওয়ানের ‘পুনরেকত্রীকরণের’ কথা বলে যাচ্ছেন (যদিও আন্তর্জাতিক আইন অথবা ঐতিহাসিক মানদণ্ডে তাঁর সেই দাবির কোনো ন্যায্য ভিত্তি নেই)।
চীন তাইওয়ানের আকাশ প্রতিরক্ষাসীমা লঙ্ঘন করে ঢুকে পড়া এবং দ্বীপরাষ্ট্রটিকে যুদ্ধজাহাজ দিয়ে ঘিরে ফেলার মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে। এটি এমন একটি যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে, যা বৈশ্বিক ভূরাজনীতির খোলনলচে বদলে দেবে। এ মুহূর্তে হিমালয়ের ওপরও যুদ্ধের মেঘ ঘনাচ্ছে। সেখানে ভারতীয় সীমান্তের ভেতরে বারবার চীনের চুরি করে ঢুকে পড়ে ভূখণ্ড দখলের কারণে প্রায় চার বছর ধরে সামরিক স্থবিরতা জারি রয়েছে।
অন্যদিকে পূর্ব চীন সাগরে জাপানের নিয়ন্ত্রিত সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জকে নিজের দাবি করে দ্বীপপুঞ্জটির জলসীমা ও আকাশসীমায় চীনের ঘনঘন অনুপ্রবেশ জাপানকে আবার সমরাস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীন আক্রমণাত্মকভাবে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালানোর কারণে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমানের উপস্থিতি অনেক গুণ বেড়ে গেছে। এতে সেখানে সংঘাতের আশঙ্কা অনেক বেশি দানা বেঁধেছে।
যেহেতু বৈশ্বিক জাহাজ চলাচলের এক-তৃতীয়াংশ সম্পন্ন হয় দক্ষিণ চীন সাগর দিয়ে, সেহেতু এই অঞ্চলের সম্পদ করায়ত্ত করতে এবং এখানকার কৌশলগত অবস্থানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডর হিসেবে ব্যবহার করতে চীন মরিয়া হয়ে আছে। এখানে নিজের আধিপত্য মজবুত করার জন্য তারা বছরের পর বছর ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
এই লক্ষ্য অর্জন করার জন্য বেইজিং সেখানে পানির গভীরে থাকা প্রবালপ্রাচীরের ওপর বালু ফেলে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করছে। সেই দ্বীপগুলোকে তারা সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে। চীনের এই কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। দেশটি দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানার যে দাবি করে আসছে, তা ২০১৬ সালে দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে খারিজ হয়ে গেছে।
তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের পরপর তিনটি প্রশাসন চীনকে এই অঞ্চলে তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে খুব কমই সচেষ্ট হয়েছে। ফলস্বরূপ চীন এই অঞ্চলে একটি গুলি না চালিয়েও তার সমুদ্রসীমাকে একতরফাভাবে সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড) তাদের নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী পাহারা দিয়ে থাকে।
চীনের কোস্টগার্ড বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপকূলরক্ষী বাহিনী এবং তারা সবচেয়ে বেশি সামরিক সজ্জায় সজ্জিত। তারা অন্যদের সমুদ্রসীমানার ভেতরকার তেল ও গ্যাসক্ষেত্রে অনুপ্রবেশকারী টহলও পরিচালনা করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জোর দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চায়, সংঘাত চায় না’। কিন্তু চীন দক্ষিণ চীন সাগরে তার কৌশলগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং তার জন্য তারা সংঘর্ষের ঝুঁকি নিতেও রাজি আছে। দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ চীন সাগর এখন মার্কিন সংকল্পের একটি পরীক্ষাস্থল হয়ে উঠেছে। আর এই পরীক্ষায় বাইডেন ইতিমধ্যে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।
চীনের উপকূল পাহারায় নিয়োজিত সাধারণ জাহাজ ও অতিকায় আকৃতির জাহাজগুলোয় উচ্চ চাপের জলকামান ও দূরপাল্লার অ্যাকুস্টিক ডিভাইসের মতো ‘অপ্রাণঘাতী’ (নন-লেথাল) অস্ত্র ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
শুধু তা-ই নয়, এই অঞ্চলকে নিজের দাবি করে এখানে চলাচলরত মার্কিন জাহাজ এবং ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের মতো ছোট দেশগুলোর জাহাজকে তাড়া করতে বা হয়রানি করতে চীন তার নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে ব্যবহার করে থাকে।
এমনকি তারা মাছ ধরার নৌযানগুলোকেও নিশানা করে ধ্বংস করছে। সেখানে অন্য দেশের জাহাজগুলোকে যেভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ‘পায়ে পাড়া দিয়ে’ ঝগড়া লাগানো হয়, তাতে এখন স্পষ্টই মনে হচ্ছে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীন তার আঞ্চলিক দাবি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে। তাদের দাবিকৃত অঞ্চলে মাছ ধরা ও জ্বালানি অনুসন্ধানের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারা আরও মরিয়া হয়ে উঠবে।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের এই সামরিকীকরণে বিশেষত ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে পড়েছে। কারণ, ভিয়েতনাম একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে থাকে।
এই নীতি অনুসরণকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী একটি ঐতিহাসিক বাধ্যবাধকতা বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী মিত্র ফিলিপাইন। ১৯৫১ সাল থেকে এই দুই দেশের মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা চুক্তি বলবৎ। কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছে, যখনই দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সম্প্রসারণবাদের কথা আসে, তখন যুক্তরাষ্ট্র কার্যত ফিলিপাইনের প্রতিরক্ষার ভার ফিলিপাইনের ওপর ছেড়ে দেয়।
২০১২ সালে ফিলিপাইনের ইইজেডের মধ্যে ঢুকে পড়ে স্কারবোরো শোল নামের একটি মাছ ধরা পয়েন্ট চীন দখল করে নিয়েছিল। সে সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন একেবারে নীরব ছিল।
তখন থেকেই চীন ফিলিপাইনের ইইজেডের ভেতরে একটু একটু করে ঢুকে আস্তে আস্তে দখল করে যাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উদ্বেগসূচক কাগুজে বিবৃতি ছাড়া কোনো সহায়তা পায়নি ফিলিপাইন। এ পরিস্থিতি শিগগিরই বদলাবে বলে মনে হয় না।
ইউক্রেন এবং গাজার যুদ্ধের কারণে মার্কিন সামরিক সংস্থান ক্রমেই কমে আসছে। সে কারণে চীনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়ানোকে যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বশেষ বিবেচনার বিষয় হিসেবে নেবে।
কিন্তু চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অস্বীকৃতি এ অঞ্চলে সংঘর্ষের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিতে পারে এবং সেই সংঘাত অধিকতর ধ্বংসাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইতিমধ্যে চীনকে দক্ষিণ চীন সাগরে শক্তিশালী অবস্থান অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এখানে চীনের এখন যে অর্জন, তা এক দশক আগেও পেতে চাইলে চীনের সর্বাত্মক যুদ্ধে না জড়িয়ে উপায় থাকত না।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সাম্প্রতিক উসকানি এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে সংঘাতের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি থাকার পরও সি চিন পিং তাঁর সম্প্রসারণবাদ এগিয়ে নিতে আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে চীনের আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদের লাগাম টেনে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা ইতিমধ্যেই ওয়াশিংটনের নিজের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও বাণিজ্য স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জোর দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চায়, সংঘাত চায় না’। কিন্তু চীন দক্ষিণ চীন সাগরে তার কৌশলগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং তার জন্য তারা সংঘর্ষের ঝুঁকি নিতেও রাজি আছে।
দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ চীন সাগর এখন মার্কিন সংকল্পের একটি পরীক্ষাস্থল হয়ে উঠেছে। আর এই পরীক্ষায় বাইডেন ইতিমধ্যে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।
● ব্রহ্ম চেলানি দিল্লিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের ইমেরিটাস অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ