জ্ঞানবাপি মসজিদ নিয়ে বারানসির জেলা জজের রায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের উল্লাস দেখে হায়দরাবাদের সংসদ সদস্য আসাউদ্দিন ওয়াইসি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ভেবেছিলাম বিচারক ওই মামলা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেবেন।
কিন্তু রায় দেখে মনে হচ্ছে, দেশ আরও একবার আশির দশকে ফিরে যাচ্ছে। এ ধরনের আরও মামলা শুরু হবে। দেশজুড়ে নতুন করে শুরু হবে অস্থিরতা।’
ওয়াইসি খুব একটা অসত্য যে বলেননি, তা বোঝা যায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাপতি অলোক কুমারের মন্তব্যে। ছত্তিশগড়ের রাজধানী রায়পুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সম্মেলনের আসর থেকে উৎফুল্ল অলোক বলেন, ‘বিচারকের রায় বুঝিয়ে দিল এই জাতীয় মামলা ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের আনা উপাসনাস্থল আইনের আওতায় পড়ে না।’
তিনি বলেন, ‘প্রথম বাধাটা কাটল। জয় আমাদের হবেই। কারণ, সত্য আমাদের সঙ্গে।’ হিন্দুদের পক্ষে অন্যতম মামলাকারী সোহনলাল আর্য বলেছেন, ‘এই রায় জ্ঞানবাপি মন্দিরের নতুন ভিত্তিপ্রস্তর।’ উত্তর প্রদেশের উপমুখ্যমন্ত্রী ব্রজেশ পাঠকের প্রতিক্রিয়া, ‘দেশে খুশির ঢেউ উঠেছে।’
শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেই জল্পনায় না গিয়ে আপাতত স্মরণ করা যেতে পারে, তিন দশক আগে ‘বাবরি মসজিদের কবল থেকে রাম জন্মভূমিকে মুক্ত করার’ আন্দোলনের সময় এই কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের বজ্রনির্ঘোষ ছিল, ‘ইয়ে (অযোধ্যা) তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়’। হিন্দুত্ববাদীদের সেই হুংকার বাস্তবায়িত হওয়ার পথে বারানসির জেলা আদালতের রায় প্রথম সোপান কি না, তা নির্ধারণের দায়িত্ব ভারতের সুপ্রিম কোর্টের। হিন্দু সমাজের একাংশের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছে তারা আশাবাদী। মথুরার মামলা নিয়েও তাঁরা আশায় বুক বাঁধছেন।
অযোধ্যা আন্দোলন তীব্রতর হওয়ার সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও উপাসনাস্থল আইনটি পাস করিয়ে ছিলেন। ‘প্লেসেস অব ওয়রশিপ অ্যাক্ট, ১৯৯১’-এর প্রতিপাদ্য ছিল, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় দেশের সব উপাসনাস্থলের চরিত্র যে রকম ছিল, তার বদল ঘটানো যাবে না। ব্যতিক্রম শুধু অযোধ্যা, যেখানে বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিতর্ক অব্যাহত এবং যা আদালতে বিবেচনাধীন।
হিজাব, হালাল, আজান, আমিষ বিতর্ক সমাজকে দ্রুত বিভক্ত করছে। বুলডোজারের ব্যবহার বা দেশদ্রোহ মামলা একাংশকে শঙ্কিত রেখেছে। ‘আরবান নকশাল’ বা ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ শব্দচয়ন ক্রমশ ভীত করে তুলছে ভিন্ন স্বর তোলা বিরুদ্ধবাদীদের। দেশপ্রেম ও দেশদ্রোহ সংজ্ঞার নিত্য পরিবর্তন ঘটছে। জ্ঞানবাপির প্রাথমিক রায় যেভাবে এক মহলে উদ্যাপিত, তাতে সংলাপের অবকাশ নেই বললেই চলে। কে জানে, নতুন করে প্যান্ডোরার বাক্স উন্মোচিত হতে চলেছে কি না।
সেই অযোধ্যা মামলার চূড়ান্ত রায় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ যখন দিলেন, তখন তাঁরাও ওই ১৯৯১ সালের আইনের প্রাসঙ্গিকতার উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন, ওই আইন দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র অটুট রাখার সহায়ক, যা দেশের সংবিধানের মূল কাঠামো। এ–ও বলেছিলেন, আমাদের সাংবিধানিক আইনের মৌলিক নীতি হলো পেছন পানে না হাঁটা।
সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতি একযোগে এ-কথাও বলেছিলেন, ঐতিহাসিক ভুলত্রুটির সংশোধন আদালতের আঙিনায় হওয়া ঠিক নয়। বারানসি জেলা আদালতের রায়ের পর এখন মনে হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের কাছে তাঁদের রায় ও মন্তব্যই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে চলেছে।
এমন মনে হওয়ার কারণ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের পর্যবেক্ষণ। সুপ্রিম কোর্টের যে পাঁচ বিচারপতি সর্বসম্মতিক্রমে অযোধ্যা মামলার রায় দিয়েছিলেন, বিচারপতি চন্দ্রচূড় ছিলেন সেই বেঞ্চের অন্যতম।
জ্ঞানবাপি মসজিদ মামলার ‘মেইনটেনেবিলিটি’ অর্থাৎ ১৯৯১ সালের আইন অনুযায়ী তা বিচার্য কি না, সেই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন হলে তা বিচারের ভার পড়ে বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের ওপর। তিনি রায়ে বলেছিলেন, ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইনে বলা হয়েছিল কোনো ধর্মস্থানের চরিত্র বদল করা যাবে না।
কিন্তু ধর্মীয় চরিত্র নির্ধারণ করা যাবে না তা বলা হয়নি। বারানসির জেলা আদালতের বিচারক সেই চরিত্র নির্ধারণের রায়ই শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, স্মরণাতীতকাল ধরে কাশী বিশ্বনাথ মন্দির চত্বরে দেবদেবীর মূর্তি পূজা হয়ে আসছে। বলেছেন, একবার কোনো সম্পত্তি দেবোত্তর ঘোষিত হলে তা ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।
অযোধ্যা মামলার রায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আরাধ্য দেবতার সম্পত্তি ধ্বংস হয়ে গেলেও সেই সম্পত্তির চরিত্রের বদল ঘটে না। কাজেই জ্ঞানবাপি মসজিদের অভিন্ন দেয়ালে থাকা হিন্দু দেবদেবীর নিরবচ্ছিন্ন পূজা–অর্চনার দাবিসংক্রান্ত মামলা ২২ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি শুনবেন।
সেই শুনানি শেষে তাঁর চূড়ান্ত রায় কট্টরবাদীদের উৎফুল্ল করতে পারে। হতাশও। রায়ে যা–ই বলা হোক, বিচারের পরবর্তী ধাপ অপেক্ষায় থাকবে। জেলা আদালত থেকে হাইকোর্ট, সেখান থেকে সুপ্রিম কোর্ট। শেষমেশ কী হবে সেই অনুমান বৃথা। এই মহলের কাছে ১৯৯১ সালের আইনের ফাঁকফোকরের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে তার ‘স্পিরিট’।
উপাসনাস্থলের চরিত্র পরিবর্তন না করার কথা সেই সময়কার সরকার কেন ভেবেছিল? একটাই কারণ, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত যেন ধর্মীয় সংঘাতের বধ্যভূমি না হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িকতার বিষ যেন চড়তে শুরু না করে। কিন্তু সরকারের চরিত্র বদলের পাশাপাশি আইনের সেই ‘স্পিরিট’ উবে যেতে শুরু করেছে। দেশের সর্বত্র হিন্দুত্ববাদ দৃঢ় প্রোথিত করার রাজনৈতিক তাগিদ যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই উৎসাহিত হচ্ছে এই ধরনের প্রবণতা।
গণতান্ত্রিক দেশে আইনের শাসন সর্বদা প্রাধান্য পায়। কিন্ত মুশকিল হলো, আইনের চোখে মামলা কখনো অমীমাংসিত থাকে না। সব সময় যেকোনো এক পক্ষের জয় হয়, অপর পক্ষ হারে। অথচ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিতর্কের মীমাংসা দুই পক্ষের কাছেই সম্মানজনক ও গ্রহণীয় হতে পারে। অযোধ্যা মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট সেই রায়ই দিয়েছিলেন।
২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ মন্দির ও মসজিদ দুই পক্ষকেই বলেছিলেন, বিতর্কিত ২ দশমিক ৭৭ একর জমি তিন ভাগে ভাগ করা হোক। এক–তৃতীয়াংশ স্থান গ্রহণ করুক ‘রাম লালা’র প্রতিনিধিত্বকারীরা, এক–তৃতীয়াংশ যাক সুন্নি ওয়াক্ফ বোর্ডের কাছে, তৃতীয় ভাগ পাক নির্মোহী আখড়া। কেউ তা মানেনি। প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী পর্যন্ত একবার বলেছিলেন, মসজিদ ও মন্দির দুই–ই পাশাপাশি তৈরি হোক। হলে সেটা হতে পারত ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আরও এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
এখন এই পরিবর্তিত আবহে এ–জাতীয় সুপরামর্শে কেই–বা আমল দেবে? হিজাব, হালাল, আজান, আমিষ বিতর্ক সমাজকে দ্রুত বিভক্ত করছে। বুলডোজারের ব্যবহার বা দেশদ্রোহ মামলা একাংশকে শঙ্কিত রেখেছে। ‘আরবান নকশাল’ বা ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ শব্দচয়ন ক্রমশ ভীত করে তুলছে ভিন্ন স্বর তোলা বিরুদ্ধবাদীদের। দেশপ্রেম ও দেশদ্রোহ সংজ্ঞার নিত্য পরিবর্তন ঘটছে। জ্ঞানবাপির প্রাথমিক রায় যেভাবে এক মহলে উদ্যাপিত, তাতে সংলাপের অবকাশ নেই বললেই চলে। কে জানে, নতুন করে প্যান্ডোরার বাক্স উন্মোচিত হতে চলেছে কি না।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি