৭৭ বছর বয়সী ডোনাল্ড ট্রাম্প ভার্জিনিয়ায় তাঁর ভক্ত-আশেকানদের কাছে ৮০ বছর বয়সী জো বাইডেনকে নিয়ে কী বলেছিলেন শুনুন, ‘ওই যে আমাদের একজন আছে। বেসমেন্টে লুকিয়ে থাকে। আর আমাকে দেখেন। এই যে আমি।’ ওহাইও, অ্যারিজোনায় নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে তাঁর লম্ফঝম্ফ আরও বাড়ল। এবার বললেন, ‘হান্টার কোথায়, হান্টার (বাইডেনের ছেলে)? জানেন নাকি কোথায়? কোথায় আর থাকবে, বাপের সঙ্গে বেসমেন্টে লুকিয়ে আছে। আমি এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্য চষে ফেলছি। আর সে তো টানা চার দিন গর্ত থেকেই বের হয়নি।’
কোভিডকালেও ৭৭ বছর বয়সী ট্রাম্প এখনো কত জওয়ান, তার প্রমাণে ব্যস্ত ছিলেন। আর দেখাচ্ছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন কত ভিতু, কত অথর্ব। তিনি যত বলেন, তাঁর পারিষদেরা আরও শতগুণ বলেন। ওয়াল্টার রিড ন্যাশনাল মিলিটারি হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মেয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্প তাঁর একটা ছবি প্রকাশ করলেন। সেই ছবিতে ট্রাম্পকে একটি কনফারেন্স টেবিলে বসে ফাইলে সই করতে দেখা গেল। ছবির ক্যাপশনে ইভাঙ্কা লিখলেন, ‘আমেরিকার জনগণের জন্য কাজ করা থেকে কোনো কিছুই তাঁকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি নিরলস।’
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো জনতুষ্টিবাদী কর্তৃত্বপরায়ণ নেতাদের মুখের ভাষা হলো বড় অস্ত্র, অলংকারও বলতে পারেন। কালচারাল ব্যাকল্যাশ: ট্রাম্প, ব্রেক্সিট, অ্যান্ড অথরিটেরিয়ান পপুলিজম বইয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পিপা নরিস ও রোনাল্ড ইঙ্গেলহার্ট অন্তত তা-ই বলেছেন। তাঁদের বক্তৃতা ‘আমি’ কেন্দ্রিক। ‘আমি’ এটা করেছি, ওটা করেছি, আমিই, আমিই সে। মুখে জনগণের জন্য জান দিয়ে দেন, কিন্তু সেবা দেন অনুগত গোষ্ঠীকে। থাকে উতোরচাপান, বিরোধী দলের নেতাদের অন্য দেশের ‘এজেন্ট’ বলা আর জাতীয়তাবাদের প্রচার। ডানে-বাঁয়ে-ওপরে-নিচে তাকালে এমন অনেক বক্তব্য বা মন্তব্য মনে পড়বে আপনাদের।
যেমন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল বিজেপির প্রধান টার্গেট হলেন রাহুল গান্ধী। তিনি কিন্তু রাহুলের নাম উচ্চারণ করেন না। তিনি ও তাঁর দলের লোকজনের কাছে রাহুল হলেন ‘পাপ্পু’। এই নামকরণ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। দ্য প্রিন্টসহ ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম এটা নিয়ে লেখালেখিও করেছে। তাদের মত হলো ‘পাপ্পু’ নাম দিয়ে বিজেপি আসলে পঞ্চাশোর্ধ্ব রাহুল গান্ধীর একটা মাথামোটা ছোকরা ভাবমূর্তি তৈরি করেছে সুকৌশলে।
বিরোধীদলীয় নেতাদের যেকোনো বক্তব্যের প্রতিক্রিয়াই এদের কাছে, ‘যা মুড়ি খা’ ধরনের। তবে এই দলভুক্ত নেতাদের সবার তরিকা এক না। চীনে রাজনৈতিক দল একটিই, কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না (সিপিসি)। ওখানে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের কথার বাইরে উল্টো সিধে করলেই হাপিস হতে হয়। এই নেতা হাত থাকতে মুখে কি লাইনে চলেন।
ভার্চ্যুয়াল-জগতে সক্রিয় তাদের বিশাল বাহিনী নানা রকম ক্যারিকেচার করে বুঝিয়ে দিয়েছে রাহুল আসলে পাপ্পুই। তিনি কংগ্রেস নেতা, ইন্দিরা গান্ধীর দৌহিত্র বা রাজীব গান্ধীর ছেলে নন। তাই রাহুল যখন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রা করলেন তখন অনেক পত্রপত্রিকাই লিখল রাহুল তাঁর পাপ্পু ইমেজ থেকে বেরিয়ে এসেছেন (রাহুল গান্ধীস ‘পাপ্পুফিকেশন’ মে বি ওভার, বেয়ার্ড সিম্বোলাইজেস ইমেজ মেকওভার: এক্সপার্টস, দ্য হিন্দু)।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বিরোধীদলীয় নেতা ও কট্টর সমালোচক আলেক্সি নাভালনিকে দুই চোখে দেখতে পারেন না। তবে তিনিও কখনো নাভালনির নাম উচ্চারণ করেন না। অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠান বেলিং ক্যাট ও সিএনএন খবর ছাপল যে পুতিন গোয়েন্দা সংস্থার লোক দিয়ে বিষ প্রয়োগে নাভালনিকে হত্যার চেষ্টা করেছেন। বার্ষিক সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে প্রশ্নও উঠল (পুতিন সেইস ইফ রাশিয়া ওয়ান্টেড টু কিল অপজিশন লিডার নাভালনি, ইট উড হ্যাভ ফিনিশড দ্য জব: সিএনএন)। পুতিন একটুও বিচলিত হলেন না। নাভালনির নাম উচ্চারণ না করে বক্তব্য সারলেন। বললেন, বার্লিনের রোগী তো মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার আশীর্বাদপুষ্ট। রুশ গোয়েন্দারা যদি চাইত তাকে কবেই ‘ফিনিশ’ করে দিতে পারত। কিন্তু তারা এই কাজ কেন করবে? তার মতো লোককে কে খোঁজে? ওর বউ এসে আমার কাছে পড়ল, আমিই তাকে জার্মানিতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বিরোধীদলীয় নেতাকে নাস্তানাবুদ করতে যা করেছেন, তার দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। নির্বাচনের আগে ব্ল্যাক সি প্রদেশে গিয়েছিলেন এরদোয়ান। বক্তৃতা শেষে ১০ বছরের এক শিশুকে খেলনা গাড়ি হাতে দিয়ে কথা বলতে বলেন। শিশুটি বলে, ‘কেমাল কিলিচদারওলু (বিরোধীদলীয় নেতা ও রিপাবলিকান পিপলস পার্টির চেয়ার) একজন বিশ্বাসঘাতক। এ নির্বাচনে এরদোয়ানই সেরা। আপনারা সবাই আমার প্রেসিডেন্ট চাচাকে ভোট দেবেন।’
বিরোধীদলীয় নেতাদের যেকোনো বক্তব্যের প্রতিক্রিয়াই এদের কাছে, ‘যা মুড়ি খা’ ধরনের। তবে এই দলভুক্ত নেতাদের সবার তরিকা এক না। চীনে রাজনৈতিক দল একটিই, কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না (সিপিসি)। ওখানে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের কথার বাইরে উল্টো সিধে করলেই হাপিস হতে হয়। এই নেতা হাত থাকতে মুখে কি লাইনে চলেন। চীনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং নিখোঁজ বেশ কিছুদিন ধরে। তাঁকে নিয়ে আলোচনার রেশ কাটতে না-কাটতেই নিখোঁজ হয়েছেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল লি শাংফু। এত গুঞ্জন, এত আলোচনার পরও সি চিন পিংয়ের তরফে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি কোথাও।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধার এরা আসলে খুব একটা ধারেন না। ব্রাজিলের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য ছিল, ‘নির্বাচনে দেশের কিছুই বদলাবে না। সেই দিনই বদলাবে, যেদিন এখানে একটা গৃহযুদ্ধ হবে এবং সেনা শাসনামলে যা ঘটেনি, তাই ঘটবে...৩০ লাখ মানুষ খুন হবে। যদি কোনো নির্দোষ মানুষ মারা যায়, তাতেও সমস্যা নেই। কারণ, যেকোনো যুদ্ধেই নির্দোষ কিছু লোক মরে।’ এই বলসোনারোই ২০১৪ সালে বিরোধীদলীয় এক নারী সাংসদ সদস্য মারিয়া ডো রোজারিওকে বলেছিলেন, ‘আপনাকে আমি ধর্ষণও করব না। আপনি ধর্ষণের যোগ্য না।’ ব্যাপক সমালোচনার মুখেও তিনি এ বক্তব্য নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেননি, লজ্জিতও হননি।
কারণ ক্ষমা চাওয়া, দুঃখ প্রকাশ, লজ্জিত হওয়ার মতো মানবিক গুণাবলি এসব নেতার নেই। এবার ভেবে দেখুন বিরোধী দলের নেতাদের কটু কথা বলার প্রতিযোগিতায় কে হবেন প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয়। কাকে দেবেন জিপিএ ফাইভ? যাঁদের কথা বললাম, তাঁদের বাইরেও কাউকে দিতে পারেন। এমনকি চাইলে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভও।
শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই–মেইল: [email protected]