উপভোগ্য নির্বাচন, আনন্দের উপকরণ

কয়েক দিন আগে আমার অফিসে এলেন তিনি। বিমর্ষ চেহারা, ভগ্ন কণ্ঠ। তাঁকে এ রকম আগে দেখিনি কখনো। কথা শুনে বুঝলাম ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিপর্যস্ত তিনি। আগে দুবার যেমন নির্বাচন হয়েছে, এবারও তেমনই হবে? এ প্রশ্ন তুলে তিনি হতাশ কণ্ঠে বলেন, এর কোনো শেষ নেই আসিফ!

তিনি আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, পড়ানো আর গবেষণা নিয়েই তাঁর জীবন পার করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে কখনো দেখিনি কোনো দলাদলিতে। আমরা যখন বিভিন্ন বিষয়ে বিবৃতি দিই, তিনি তখনো দূরে থাকেন এসব থেকে। কাজেই তঁার ভগ্নদশা দেখে একটু অবাক হই। ‘স্যার বাদ দেন, এসব ভেবে কী করবেন’—এ ধরনের কথা বলে তাঁকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করি। তিনি থামেন না, বারবার তাঁর হতাশার কথা বলতেই থাকেন: ‘এসব কী হচ্ছে, এসব তো মেনে নিতে পারছি না!’

তাঁর মতো আরও বহু মানুষের কথা শুনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব, সামাজিক অনুষ্ঠানে, পথে-ঘাটে অনেকের কাছ থেকে একই প্রশ্ন শুনি: এভাবে করে ফেলছে নির্বাচন, আবারও! এসব শুনে আমার মনে হয়, এবারের মতো অবসাদগ্রস্ত নির্বাচন আর হয়নি আগে। ২০১৪ সালে মানুষ ছিল হতচকিত, ২০১৮ সালে সতর্ক কিন্তু আশাবাদী! ২০২৪ সালে মানুষ অবসাদগ্রস্ত, হতাশ কিংবা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত!

তবে এর পাশাপাশি আনন্দও আছে কিছু মানুষের। এক দলকে মারধর করে মাঠছাড়া করা হয়েছে। আরেক দল নেচেকুঁদে সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, ‘খেলা হবে, খেলা হবে’ বলে ফাঁকা মাঠে আনন্দ-উল্লাস করছে। তাদের পক্ষে সামান্য হলেও কিছু দর্শক হই–হুল্লোড় করছে। ৭ তারিখ এ খেলার নির্ধারিত দিন। সেদিনও অনুগত আর ডামি কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে সেই দলই শুধু থাকবে, রেফারি, লাইন্সম্যান এবং ফুটবল ফেডারেশনও থাকবে তাদের পক্ষে। 

এক দলের এ খেলায় একটা দলই গোল করবে বিনা বাধায়, একই রকম কিংবা আরও বেশি আনন্দ-উল্লাস হবে সেদিনও। সেই ম্যাচের ফলাফল ইতিমধ্যে নির্ধারণ হয়ে গেছে—৩০০-০। তবু এটা নিয়ে উল্লাস, অহমিকা আর আত্মম্ভরিতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে তাদের!

এ খেলায় আমাদের যাদের অংশগ্রহণ নেই, সম্মতি নেই, আগ্রহ নেই, তারা কি তাহলে শুধু অবসাদগ্রস্ত হয়েই থাকব? কয়েক দিন ধরে মনে হচ্ছে, এমন হয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। এ খেলায় গর্ব করার মতো, এমনকি বিনোদিত হওয়ার মতো কিছু আছে আমাদের জন্য। আমরা কি এভাবে বিষয়টা দেখতে পারি?

২.

যাঁরা দেশের সম্পদ লোপাট করেন, ব্যাংকের টাকা মেরে দেন বা প্রকল্পের টাকা হাতিয়ে নেন, তাঁরা খুশি থাকেন অন্যায় আর অসুস্থভাবে। আমরা সন্তুষ্ট থাকি অন্যভাবে। সেটা হচ্ছে এসব কাজে অংশ না নেওয়ার এবং নিজেরা ভালো থাকার সন্তুষ্টি। নিজের বিবেকের কাছে নিজে পরিষ্কার থাকার এই মহৎ আনন্দের তুলনা নেই কোনো। 

ঠিক সেভাবে নির্বাচন নিয়েও আমরা আনন্দে থাকতে পারি সম্ভবত। ভোটে কারচুপি করে কেউ যদি আনন্দে থাকে, আমাদেরও আনন্দে থাকা উচিত এটা ভেবে যে বহু প্রলোভন বা হুমকির পরও আমরা এতে অংশ নিইনি, এটি মেনে নিইনি। বরং আমরা অনেকে দেশ আর গণতন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকে এসবের বিরুদ্ধে কথা বলি, মাঠে সংগ্রাম করি, প্রতিবাদ জানাই। এটাই হোক আমাদের আনন্দ আর গর্বের বিষয়।

অন্যায়কারীরা যদি আত্মতুষ্টি আর গর্ব নিয়ে থাকতে পারে, তাহলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে থাকার আত্মতুষ্টি আর গর্ব আমাদের থাকা উচিত আরও অনেক বেশি। অবশ্যই আমরা গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের দুরবস্থার কথা ভেবে কষ্ট পাব, তা থেকে উত্তরণের ভাবনায় পিষ্ট হব। কিন্তু এই কষ্ট আর এ ভাবনা করার বিবেকবোধ ও মনুষ্যত্ব আমাদের রয়েছে—এ চিন্তাই আমাদের গর্ব আর আনন্দের বিষয় হোক। অসুস্থ চিন্তার মানুষের চেয়ে এ আনন্দ অনেক বেশি মহৎ কিছু।

আমি জানি, নিজের বিবেকের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও নির্বাচনের খেলায় সম্মতি দেওয়ার জন্য বহু মানুষকে নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক সুবিধার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে অন্যায়ভাবে। ভোট দেওয়া মানুষের সংবিধানসম্মত অধিকার। ভোট মূল্যহীন হয়ে গেলে বা অন্য যেকোনো বিবেচনায় ভোট দিতে না যাওয়াও মানুষের সংবিধানসম্মত অধিকার। 

অথচ সেই অধিকারকে নাকচ করে মানুষকে ভোটকেন্দ্রে আসার জন্য বাধ্য করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ অন্যায়ও করা হচ্ছে প্রকাশ্যে, গর্বিত গর্জনে। এই অন্যায়কারীরা যদি অসৎ আনন্দে থাকতে পারে, তাহলে এই অন্যায়কে মেনে না নেওয়ার বা তা মোকাবিলার আনন্দ উপভোগের চেষ্টাও আমরা করতে পারি সৎ থেকে।

আমরা কে না জানি, রেফারির ওপরও রেফারি থাকে, ফেডারেশনের ওপরও ফেডারেশন থাকে। আজ বা আগামীকাল একদিন অসৎ খেলার অবসান হবে। এটাই জগতের নিয়ম। আমরা এ আনন্দে থাকি যে এমন দিনের প্রতীক্ষায় আছি আমরা, এমন দিনকে বরণ করার চেষ্টায় থাকব আমরা।

৩.

একতরফা খেলায় কিছুটা বিনোদিত হওয়ার চেষ্টাও করতে পারি আমরা। ৭ তারিখের খেলায় ৩০০ গোলদাতার বিজয়ী দলে অনুগত আর ডামিদের মধ্যে কাকে কাকে নেওয়া হবে, তা নিয়ে নানা কাণ্ড হচ্ছে দেশে। খেলায় নামার টাকা না পেয়ে, খেলার দলে নাম থাকার নিশ্চয়তা না পেয়ে কেউ কেউ মাঠ ত্যাগ করছে। খেলার রেফারিরা এক দলের খেলাটি নির্বিঘ্নে হবে, ৩০০টি গোলই সুষ্ঠুভাবে হবে, একটা দলই নিরপেক্ষভাবে গোল দেবে—এমন নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। 

মাঠে শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত বাহিনী বহু আগে একটা দলকে অন্য দলের নির্দেশে মারধর করে মাঠছাড়া করেছে। এক দলের খেলায় কোনো সমস্যা যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য মাঠছাড়া দলটির খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের খুঁজে খুঁজে আটক করছে। ফেডারেশনের ডিসিপ্লিনারি বোর্ড এই আটকাদেশকে বৈধ ঘোষণা করছে। 

খেলার রিপোর্ট কাভার করতে আসা সাংবাদিকদের এখন নানাভাবে পোষ মানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ খেলাকে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক দেখানোর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া আর ফিফাকে নানাভাবে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।

এমন মজার খেলা আর কবে হয়েছে দেশে! চিত্তবিনোদনমূলক ভেবে এমন খেলা উপভোগ করা যেতে পারে। তবে আমাদের এ বিশ্বাসে যেন একটুও চিড় না খায় যে এ খেলায় জিতে গর্ব করার মতো নেই কিছু আসলে। এ খেলায় সত্যিকারের বিজয়ও নেই আসলে।

এ খেলায় আমরা কোনোভাবে অংশ নিইনি—এ হোক আমাদের সান্ত্বনা আর বিবেকবোধের সন্তুষ্টি।


আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক