বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঐক্য অসম্ভব নয়; তবে অতি বিরল। কারণ রাজনীতি আর সন্দেহ মাসতুতো ভাই। এই দুই জিনিসের একটিকে ছাড়া অপরটি চলতে পারে না।
যেখানেই রাজনীতি, সেখানেই সর্বগ্রাসী বন্যার মতো পারস্পরিক বিশ্বাসের বাঁধ ভেঙেচুরে সন্দেহ ঢুকে পড়ে।
আর সন্দেহ করোনার চেয়ে দ্রুত গতিতে সংক্রমিত হয়ে একটি জাতির সবচেয়ে দামি ঐশ্বর্য জনঐক্যকে উইপোকার মতো ভেতর থেকে কেটে কেটে ঝাঁজরা করে দেয়।
দেশের মানুষ ঐক্যের ঐতিহাসিক স্বাদ পেয়েছিল ১৯৭১ সালে। এরপর তারা ১৯৯০ সালে আরেকবার এই স্বাদ পেয়েছে।
তবে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট জন-ঐক্যের উদ্দাম আনন্দ নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী ঐক্যের আনন্দকেও বহুগুণ ছাপিয়ে গিয়েছিল।
জুলাই-আগস্টে ডান-বাম, উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, তরুণ-বৃদ্ধ, নারী–পুরুষ, আস্তিক-নাস্তিক—সব রাজপথে নেমেছিল।
ফ্যাসিবাদী সরকার এমন একটি সংকট জাতির সামনে এনেছিল যে, সব পথ এক পথে মিলেছিল।
এক অবিস্মরণীয় ঐক্যের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে ‘আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া’ ছিলাম। ফ্যাসিবাদী সরকারের সুবিধাভোগী একটি অংশ বাদে গোটা জাতি এক হওয়ার আনন্দে মেতে উঠেছিল।
জনতার ঐক্যে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। জনতার ঐক্যের হাত ধরে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু ঐক্য বস্তুটাই যেহেতু প্রায়শই কর্পূরের মতো ক্ষণস্থায়ী এবং প্রসঙ্গটি যেহেতু রাজনীতির, সেহেতু রাজনীতির মাসতুতো ভাই সন্দেহ ঠিকই ঢুকে পড়েছে এবং ইতিমধ্যে ঐক্য মিইয়ে গেছে।
সন্দেহ, সংশয় ও অবিশ্বাসের একটা ঘন ধুম্রকুণ্ডলী দেশের রাজনীতির আকাশকে আবারও আচ্ছন্ন করে ফেলছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিকে জানিয়েছিলেন, এই রক্তস্নাত অভ্যুত্থানের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোকে সংস্কার করা হবে। যৌক্তিক পর্যায়ের সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া হবে।
বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য দলগুলো এ নিয়ে তখন আপত্তি তোলেনি। সংস্কার প্রশ্নে কারও কারও আপত্তি থাকলেও সে আপত্তিতে তখন বিরোধিতার দ্যোতনা ছিল না।
এরপর সন্দেহ সক্রিয় হতে শুরু করল। কিছুদিন গড়াতে না গড়াতেই সংস্কার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার দিনক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। বিএনপির দিক থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দেওয়ার উঠতে শুরু হলো
সেই দাবি এখন শুধু প্রবলই হচ্ছে না। বিএনপি যাতে ক্ষমতায় যেতে না পারে সে জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চক্রান্ত চলছে বলেও তারা অভিযোগ করা শুরু করেছে।
একটি সংবাদমাধ্যমের খবরের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে: ‘ “আওয়ামী লীগের পর বিএনপিকেও মাইনাসের ষড়যন্ত্র চলছে”—বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নেতারা’।
বিএনপির শীর্ষ নেতাদের এই কথার অর্থ দাঁড়ায়, ষড়যন্ত্র করে ইতিমধ্যে রাজনীতি থেকে (অন্যায্যভাবে) আওয়ামী লীগকে মাইনাস করা হয়েছে; একইভাবে ‘বিএনপিকেও মাইনাসের ষড়যন্ত্র চলছে’।
অর্থাৎ, সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একটি ঘোর অবিশ্বাস ও সন্দেহ বিএনপিকে গ্রাস করে ফেলেছে।
বিএনপি চায় দ্রুত নির্বাচন দেওয়া হোক। জামায়াত চায় সরকারকে সংস্কারের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হোক। তারপর নির্বাচন দেওয়া হোক।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলছেন, শুধু একটি নির্বাচনের জন্য মানুষ গুলিতে প্রাণ দেয়নি, সুতরাং নির্বাচনের জন্য ‘পাগল হওয়ার’ কোনো সুযোগ নেই।
ছাত্রদের দিক থেকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা’র দাবিকেও সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখছে বিএনপি। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ইতিমধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আসছে।
সংবাদমাধ্যমের ওই প্রতিবেদনটি বলছে, ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’র মতো আরও অনেক ইস্যু সৃষ্টি করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চক্রান্ত চলছে বলে মনে করছে বিএনপি।
দেশে এক ধরনের ‘অরাজকতা’ তৈরি করতে একটি মহল চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও দলটি মনে করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সতর্ক থাকার বিষয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে।
এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যখন তাদের নেতা-কর্মীদের ‘সতর্ক থাকতে’ বলে এবং ‘কঠোর নির্দেশনা’ দেয়, তখন বুঝতে হয়, প্রতিপক্ষকে দলটি চূড়ান্তভাবে সন্দেহ করছে এবং প্রতিপক্ষকে সে প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিয়েছে।
সামষ্টিক জনমানস যদি নির্বাচন, সংস্কার, নতুন দল গঠন—ইত্যাদি বিষয়ে সংশয়াচ্ছন্ন হয় তাহলে তা জাতির এগিয়ে যাওয়ার পথকে সর্পিল করে তোলে। এ কারণে সরকার ও রাজনীতিকদের যতটা সম্ভব নিজ নিজ উদ্দেশ্য-বিধেয় পরিষ্কার করা দরকার। তা না হলে, পারস্পরিক সন্দেহের বিষবাষ্প আরও ঘনীভূত হবে। এই সন্দেহ আস্থাবিনাশী ও ঐক্যবিনাশী। ফলতঃ তা ভয়ানক।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা আমার প্রাথমিক নিয়োগকর্তা, তারা যখন বলবে, আমরা চলে যাব।’
সেই ‘নিয়োগ কর্তা’দের মধ্য থেকেও ইউনূস সরকারের সমালোচনা আসছে।
পতিত সরকারের ওপরের সারির নেতাদের বিদেশে চলে যেতে দেওয়া, আওয়ামী আমলের হাসিনা-ঘনিষ্ঠ আমলা ও কর্মকর্তাদের বহাল তবিয়তে থাকাসহ নানা ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সরকারের দিকে দৃশ্যত সন্দেহের তির ছুড়ছে।
সন্দেহ আকাশ থেকে পড়ে না। সন্দেহ ভর করে যুক্তির ওপর; এমনকি কুযুক্তিরও ওপর।
যুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে বিভিন্ন দলমতের মানুষ জুলাই আগস্টে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
একইভাবে কোনো না কোনো যুক্তি বা কার্যকারণের ওপর ভর করে এই সব পক্ষ আজ একে অন্যকে সন্দেহ করছে।
রাজনীতিকদের চোখ স্বভাবতই সন্দিগ্ধ বলে দেশের সামগ্রিক রাজনীতির দেহে সন্দেহ সংক্রমিত হয়েছে। এক পক্ষ দ্রুত আরেক পক্ষের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে।
চব্বিশ ঘণ্টা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখা সচিবালয়ের বিশাল ভবনের দুই প্রান্তে একই সময় আগুন ধরল, মাঝখানে ধরল না।
গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোর গুরুত্বপূর্ণ ‘নথিদাহ’ হলো। সাত তলায় কুকুর পুড়ে ভস্মীভূত হলো।
ঘটনার পর পরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দিক থেকে বলা হয়েছিল, এই আগুন স্বাভাবিক আগুন না। এই আগুন কেউ না ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অনেকের সন্দেহ ছিল, আগের সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ ‘নাই’ করে দেওয়ার উদ্দেশে পরিকল্পিতভাবে আগুন ধরানো হয়েছে।
এরপর তদন্ত কমিটি যখন বলল, এই আগুন কোনো মানুষ জ্বালায়নি, বিদ্যুতের ‘লুজ কানেকশন’ এর জন্য দায়ী; তখন পাবলিকের মনে সরকারের ভাষ্য নিয়ে সন্দেহ এল।
ঐতিহ্যগতভাবে রাজনীতিকদের উদ্দেশ্য নিয়ত পরিবর্তনশীল; তাই তাঁদের উদ্দেশ্যের গতিপ্রকৃতি ‘দেবা ন জানন্তি’। এ কারণেই জনমনে দ্রুত সন্দেহ দানা বাঁধে।
সামষ্টিক জনমানস যদি নির্বাচন, সংস্কার, নতুন দল গঠন—ইত্যাদি বিষয়ে সংশয়াচ্ছন্ন হয় তাহলে তা জাতির এগিয়ে যাওয়ার পথকে সর্পিল করে তোলে।
এ কারণে সরকার ও রাজনীতিকদের যতটা সম্ভব নিজ নিজ উদ্দেশ্য-বিধেয় পরিষ্কার করা দরকার।
তা না হলে, পারস্পরিক সন্দেহের বিষবাষ্প আরও ঘনীভূত হবে। এই সন্দেহ আস্থাবিনাশী ও ঐক্যবিনাশী। ফলতঃ তা ভয়ানক।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ইমেইল: [email protected]