সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই চোখে পড়ে বিভিন্ন মডেল কিংবা নায়িকার ‘বোল্ড লুক’ বা সাহসী সাজে নিজেকে উপস্থাপনের খবর। এই বোল্ড লুক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাজসজ্জা কিংবা পোশাকে তাঁদের খোলামেলা উপস্থাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মডেল কিংবা নায়িকার এমন ছবি পোস্ট হওয়ামাত্রই তা নিয়ে তুলকালাম শুরু হয়ে যায়। মুহূর্তেই লাইক, ভিউ আর কমেন্টের জোয়ারে ভেসে সংবাদগুলো ভাইরাল হতে সময় লাগে না।
প্রশ্ন হলো, খোলামেলা পোশাকে উপস্থিত হলেই সেটিকে ‘সাহসী সাজ’ বলা যায়, নাকি সেখানেও আছে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার রাজনীতির মারপ্যাঁচ, যা বোল্ড লুকের মোড়কে উল্টো নারীর অবস্থানকেই নড়বড়ে করে তোলে?
প্রাচীনকাল থেকেই নারীর চরিত্র, সৌন্দর্য, শরীর আর পোশাক নিয়ে আছে মানুষের অমোঘ আকর্ষণ। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। আজকের অবাধ তথ্যপ্রবাহ আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহজলভ্যতার সুযোগে মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এসব খবর আর ছবি ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। আর এ ধরনের খবরের বাজার কাটতি এতটাই বেশি যে একটির রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটির ঝড় উঠতে সময় লাগে না।
সভ্যতার শুরুতে পোশাকের জন্ম হয়েছিল একদিকে লজ্জা নিবারণ, অন্যদিকে বৈরী প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে মানবদেহকে সুরক্ষিত রাখতে। পুরুষ ও নারীর আলাদা পোশাকের ধারণাটি মূলত সমাজ দ্বারা নির্ধারিত। তাই পোশাকের নেই সর্বজনগ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞা বা বৈশিষ্ট্য। দেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার ও প্রকৃতি-পরিবেশ অনুযায়ী নির্ধারিত হয় পোশাক।
পৃথিবীতে সম্ভবত এমন একটি পোশাকও নেই, যা শতভাগ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। পুরুষের পোশাক নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক না থাকলেও নারীর পোশাক নিয়ে বিতর্ক যেন থামতেই চায় না; হোক সে পোশাক আপাদমস্তক আবৃত, খোলামেলা কিংবা অন্য কোনো বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
তবে এই বিতর্ক নিছক বিতর্ক নয়; বরং এর মধ্যে লুকিয়ে আছে নারীকে অবদমিত রাখার কৌশল আর নারীর শরীর ও সৌন্দর্যকে পুঁজি করে বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা বাণিজ্যের জটিল হিসাব–নিকাশ। এর কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর অবস্থান প্রকটভাবে দৃশ্যমান হলেও বাণিজ্যটি মূলত পুরুষের উদ্দেশ্যে, পুরুষের অংশগ্রহণে, পুরুষের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়।
প্রচলিত যেকোনো কিছুকে চ্যালেঞ্জ করতে সাহসের প্রয়োজন, সন্দেহ নেই। কিন্তু পোশাকে খোলামেলা হলেই সেই সাজ সাহসী—এ ধরনের ভাবনা অবান্তর। এতে সাহস নয়, বরং অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ লাভের চেষ্টাই মুখ্য হয়ে ওঠে। সাধারণত আত্মবিশ্বাসবিহীন মানুষই অন্যের মনোযোগ লাভ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।
এখন আসি বোল্ড লুক বা সাহসী সাজ বলতে কী বোঝায়, সে সম্পর্কে। সাহসী সাজ মূলত প্রচলিত ধারার বাইরে নতুন কিছু, যা দ্রুত অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সেই ব্যক্তিকে আর দশজনের থেকে আলাদা করে।
ব্যতিক্রমী সেই পোশাকের মাধ্যমে ব্যক্তি খুব দ্রুত তাঁর ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরতে পারেন। সেই পোশাকটি হতে পারে প্রচলিত ধারার বাইরে কিংবা প্রচলিতের সঙ্গে অপ্রচলিতের সমন্বয়ে কিংবা বাহারি রং, ছাঁট কিংবা নকশার সন্নিবেশে নতুন কোনো পোশাক।
কিন্তু হাল আমলে পোশাকের সংক্ষিপ্ততাকে সাহসিকতার সঙ্গে একীভূত করে সাধারণের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসার বিষয়টি পুরোপুরি পরিকল্পিত ও ভিউ-সর্বস্ব বাণিজ্যের মুনাফা লাভের কৌশলমাত্র।
সাহসী সাজের আরেকটি পূর্বশর্ত হলো যিনি প্রচলিত ধারার বাইরের সাজটি বহন করছেন, তাঁকে তাঁর এই সাজ গ্রহণ করতে হবে সাবলীলভাবে, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। না হলে ব্যক্তিত্বে আড়ষ্টতার প্রতিফলন ঘটা অনিবার্য। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি প্রকটভাবে চোখে পড়ে তাঁদের পোশাকের উপস্থাপনে। স্বাভাবিকতা নয়, বরং বাজার কাটতিই মুখ্য হয়ে ওঠে তাঁদের আচরণ ও কথাবার্তায়।
প্রচলিত যেকোনো কিছুকে চ্যালেঞ্জ করতে সাহসের প্রয়োজন, সন্দেহ নেই। কিন্তু পোশাকে খোলামেলা হলেই সেই সাজ সাহসী—এ ধরনের ভাবনা অবান্তর। এতে সাহস নয়, বরং অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ লাভের চেষ্টাই মুখ্য হয়ে ওঠে। সাধারণত আত্মবিশ্বাসবিহীন মানুষই অন্যের মনোযোগ লাভ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে।
শ্লীল-অশ্লীলের সংজ্ঞা ও মাত্রা নিয়ে আছে অনেক বিতর্ক। পোশাক ব্যক্তির স্বাধীনতা। ব্যক্তি তাঁর রুচি ও ইচ্ছা অনুযায়ী পোশাক পরিধান করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে পোশাক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য চরিতার্থে পরিধান করা হয়, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
আর সেটাকে যতই সাহসী সাজ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে সেটি তা নয়। পোশাকে সাহস থাকে না, সাহস থাকে অন্তরে। সাহসের উৎস হলো আত্মবিশ্বাস। মানুষ যে পোশাকে আত্মবিশ্বাসী হন, সাধারণত সে পোশাকই তিনি বেছে নেন। একেক মানুষ একেক পোশাকে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পান। হতে পারে সেই পোশাক ধর্মীয় বা সামাজিক চেতনা থেকে আবির্ভূত, দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অথবা হাল ফ্যাশন থেকে অনুপ্রাণিত।
ব্যক্তির সাহসী উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজন নেই উত্তেজক কোনো পোশাক, জুতা, অলংকার কিংবা মেকআপের। প্রয়োজন নেই কম বয়সী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপনের; বরং সবচেয়ে বেশি যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, আমরা যা পরছি তা যেন আস্থা, বিশ্বাস আর সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারি। যা আমাদের সত্যি, তা-ই আমাদের আত্মবিশ্বাস।
আত্মবিশ্বাস থেকেই জন্ম নেয় সাহস। সাহসের স্বকীয় সৌন্দর্য আছে। তাই আমাদের স্বকীয় সত্তা, যা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ধারণ ও লালন করতে পারে, সেটিই আমাদের সাহসী সাজ বা বোল্ড লুক। সেটিই আমাদের স্বকীয় স্টাইল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শেষের কবিতা উপন্যাসে বলেছিলেন, ‘ফ্যাশনটা হলো মুখোশ আর স্টাইলটা হলো মুখশ্রী।’
● নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী