আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশটি নিয়ে আন্তর্জাতিক মনোযোগের মূল কেন্দ্র হলো, সেখানকার ক্রমাগত খারাপ হতে থাকা মানবাধিকার পরিস্থিতি। লাখ লাখ আফগানি চরম গরিবি হালে জীবনযাপন করছে এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়।
এ মাসে আফগানিস্তান আরেকটা ভয়ানক মাইলস্টোনে পৌঁছেছে। সেটা হলো, মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়ের দরজা বন্ধ হওয়ার ১০০০ দিন পার হয়েছে।
আফগানিস্তানে আরেকটি গল্প আছে। সেই গল্পটা দেশটির জন্য আশার এবং আরও বেশি মনোযোগ কাড়ার দাবি রাখে। সেই গল্পটা আফগানিস্তানের ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট বা জাতীয় প্রতিরোধ ফ্রন্টের (এনআরএফ) কর্মকাণ্ড।
চরমপন্থী নয় এ রকম একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী এনআরএফ। তালেবান শাসকদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ তারা। এনআরএফের বর্তমান নেতা হলেন আহমদ মাসউদ। ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে সোভিয়েত ও তালেবানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা আহমদ শাহ মাসউদের ছেলে তিনি।
২০২১ সালে তালেবানরা কাবুলের ক্ষমতায় এলে মাসউদ তার পূর্বজনদের আবাসভূমি তাজিকদের পাঞ্জশির উপত্যকায় ফিরে যান। এটি আফগানিস্তানের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য অঞ্চল। কাবুল থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই অঞ্চলে প্রতিরোধ আন্দোলনের একেবারে নিখুঁত জায়গা।
মাসউদের প্রতিরোধ ফ্রন্টে হাজার হাজার সেনা, পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যোগ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান পরিত্যাগ করে গেলেও তাদের লড়াইয়ের স্পৃহা থেকেই গিয়েছিল।
প্রায় তিন বছর পর এখন এনআরএফ তিনটি প্রধান লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এর মধে৵ প্রথমত, তালেবানবিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠীকে এক ছাতার নিচে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে।
এই উদ্দেশ্যে আগামী সপ্তাহে অস্ট্রিয়ায় ভিয়েনা-প্রক্রিয়ার চতুর্থ সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ভিয়েনাপ্রক্রিয়া মরিয়া হয়ে ওঠা তালেবানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে একসঙ্গে বসার একটি বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। তালেবানরা ক্ষমতায় বসার এক বছরের মাথায় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সভার ফল হিসেবে মাসউদ তালেবানবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের কার্যত (ডি ফ্যাক্টো) নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
সবচেয়ে কৌতূহলজাগানিয়া বিষয় হলো, গত মাসে এনআরএফের সদস্যরা হেরাথ প্রদেশে বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে। এনআরএফ নিয়ন্ত্রিত প্রথাগত এলাকা থেকে হেরাথ প্রদেশ কয়েকশ কিলোমিটার দূরে। এনআরএফ তালেবানের অভয়ারণ্য হিসেবে বিবেচিত কাবুলেও হামলা চালিয়েছে।
যাহোক, এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার যে ভিয়েনাপ্রক্রিয়া কেবলমাত্র জাতিগত তাজিকদের একটা মঞ্চ নয়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সর্বশেষ যে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে ৩০টির বেশি গোষ্ঠী অংশ নেয়। হাজারা, উজবেক এমনকি শিখদের প্রতিনিধিরাও সেখানে ছিলেন। প্রায় অর্ধেক অংশগ্রহণকারী ছিলেন নারী। আগামী সপ্তাহের সভায় ৬৫টি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা অংশ নিতে পারেন।
এনআরএফের দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে, তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরও সম্পৃক্ত হতে এবং ছোট পরিসরে হলেও তাদের স্বীকৃতি আদায় করতে চায়। তাজিকিস্তান এই গোষ্ঠীটির জন্য একটা রাজনৈতিক কার্যালয় চালু করলেও এখন পর্যন্ত তারা অন্য কোনো দেশের সমর্থন পায়নি।
এনআরএফ শুধু অর্থনৈতিক সমর্থন নয়, নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও সমর্থন চাইছে। তারা চাইছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হোক এবং আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে তারা একটা সংলাপ করুক।
ভিয়েনাপ্রক্রিয়ায় অর্থায়ন করছে অস্ট্রিয়ার একটি নাগরিক সমাজ সংস্থা। তাদের উদ্দেশ্য হলো, আন্তর্জাতিক পরিসরে এনআরআইয়ের অবস্থান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা। এর আগের সভাগুলোয় পর্যবেক্ষক হিসেবে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন; কিন্তু সেটি যথেষ্ট নয়। এনআরএফের জন্য আরও বিস্তৃত পরিসরে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা দরকার।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি তালেবান শাসকদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে তাহলে এনআরএফের সঙ্গে সংলাপে না বসার তাদের কোনো কারণ নেই।
এনআরএফের তৃতীয় লক্ষ্য হচ্ছে, দেশজুড়ে তালেবানবিরোধী নিরাপত্তা অভিযানের পরিধি ও পরিসর বাড়ানো। প্রথম শীতকালটা এনআরএফ পাঞ্জশিরের রুক্ষ পর্বতে কাটিয়েছিল নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্য। ২০২২ সালের গ্রীষ্মকালে তারা পাঞ্জশিরের আশপাশে এবং তাজিক অধ্যুষিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সীমিত পরিসরে চোরাগোপ্তা আক্রমণ শুরু করে। এরপর পূর্ব আফগানিস্তান ও কাবুলসহ অন্য কিছু এলাকায় তারা তাদের আক্রমণের পরিধি বাড়িয়েছে।
শেষ বসন্ত ও গ্রীষ্মকালটাতে এমন কোনো সপ্তাহ নেই যে তালেবানের অবস্থান লক্ষ্য করে এনআরএফ আক্রমণ করেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য বলেছে, এ বছরে এ পর্যন্ত ১৬০ বার তালেবান অবস্থানে হামলা করেছে এনআরএফ।
সবচেয়ে কৌতূহলজাগানিয়া বিষয় হলো, গত মাসে এনআরএফের সদস্যরা হেরাথ প্রদেশে বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে। এনআরএফ নিয়ন্ত্রিত প্রথাগত এলাকা থেকে হেরাত প্রদেশ কয়েকশ কিলোমিটার দূরে। এনআরএফ তালেবানের অভয়ারণ্য হিসেবে বিবেচিত কাবুলেও হামলা চালিয়েছে।
এনআরএফ তাদের সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে সজাগ। সর্বোপরি, যুক্তরাষ্ট্রের ফেলে যাওয়া বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম পেয়েছেন তালেবান শাসকেরা। এর মধ্যে রাইফেল, সাঁজোয়া যান, নাইট ভিশন ডিভাইস, হেলিকপ্টার রয়েছে।
এনআরএফ বাইরে থেকে কোনো সামরিক সমর্থন পাচ্ছে না। তারা তাদের কাছে মজুত অস্ত্রশস্ত্র এবং দুর্নীতিবাজ তালেবান কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কেনার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এনআরএফ যখন অব্যাহতভাবে তালেবানদের দুর্বল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, তখন তাদের কিছু মাত্রায় সামরিক সহায়তা প্রয়োজন।
আফগানিস্তানে সমস্যার অন্ত নেই। মানবসৃষ্ট সমস্যা যেমন দেশশাসনের ক্ষেত্রে তালেবানের অক্ষমতা এবং বন্যা, ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে আফগান জনগণকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা রয়েছে।
যাহোক, এনআরএফ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে এমন একটা গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে, যারা আফগান জনগণের স্বার্থকে সর্বোত্তমভাবে লালন করে। ভিয়েনা আলোচনার দিকে বিশ্বের ঘনিষ্ঠ দৃষ্টি রাখা উচিত।
লুক কফি, হাডসন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো
আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত