তাইওয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির উসকানিমূলক সফরের সময়টিকে চীনের নেতা সি চিন পিংয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে নিঃসন্দেহে অশুভ সময় বলা যায়। কারণ, আগামী নভেম্বরে সিপিসির জাতীয় কংগ্রেস। তার আগে ক্ষমতায় তাঁর দখল আরও সুসংহত করার জন্য সি চিন পিংকে দেখাতে হবে, তিনি যথার্থ কর্তৃত্বে আছেন।
পেলোসির তাইওয়ান সফর এমন এক সময়ে চিন পিংয়ের শক্তিশালী ভাবমূর্তিকে চ্যালেঞ্জ করে বসল, যখন তিনি পার্টির সেক্রেটারি হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাঁর সহকর্মীদের সমর্থন চাইবেন।
সি চিন পিংয়ের ‘একটি আধুনিক পরাশক্তির জাতীয় পুনরুজ্জীবন’ শীর্ষক ঘোষিত নীতির অংশ হিসেবে তিনি তাইওয়ানকে শান্তিপূর্ণভাবে মূল ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর তাঁর সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের সীমাবদ্ধতাকে সামনে তুলে ধরেছে।
এটি মার্কিন কংগ্রেসের একজন সদস্যের (যিনি কিনা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের পেছনে ক্রমানুসারে তৃতীয় স্থানে রয়েছেন) তাইওয়ান সফরের বিষয়ে বেইজিংকে প্রতিক্রিয়া দেখানোর দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এই নাটকের মধ্যে আরও দুটি বিষয় আছে।
প্রথমটি হলো বেইজিংয়ের সন্দেহ, বাইডেন প্রশাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অনুসৃত ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ বজায় রাখার নীতি থেকে সরে যাচ্ছে। একই সঙ্গে চীন যদি তাইওয়ানকে সামরিকভাবে হুমকি দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ইস্যুটির মুখোমুখি হবে নাকি এড়িয়ে যাবে, তা নিয়ে বেইজিং ধন্দে রয়েছে।
মনে হচ্ছে বাইডেন প্রশাসন চীনকে এ বার্তা দিতে চায় যে চীনের আগ্রাসনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসবে। গত মে মাসে একজন প্রতিবেদক এবং বাইডেনের মধ্যকার এ কথোপকথন বেইজিংকে নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন করবে:
প্রতিবেদক: সুস্পষ্ট কারণে আপনি সামরিকভাবে ইউক্রেন সংঘাতে জড়াতে চাননি। কিন্তু তাইওয়ান আক্রান্ত হলে তাকে কি রক্ষা করতে আপনি সামরিকভাবে জড়িত হতে ইচ্ছুক?
সামরিক সংঘর্ষে জড়ানো চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের কারোরই আগ্রহ নেই। তবে একটি দুর্ঘটনার ফলে দুই দেশ একটি বড় ধরনের বিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটি উল্লেখযোগ্য যে তাইওয়ান এবং এর আশপাশে নিজের সামরিক মহড়ার সময় চীন প্রণালিতে মধ্যম রেখা অতিক্রম এড়াতে চীন সতর্কতা অবলম্বন করেছে।
বাইডেন: হ্যাঁ।
প্রতিবেদক: আপনি জড়িত হবেন?
বাইডেন: এটি আমাদের প্রতিশ্রুত বিষয়।
হোয়াইট হাউস পরবর্তীকালে বাইডেনের বক্তব্য প্রত্যাহার করতে চেয়েছিল, যেমনটি এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের তাইওয়ান নীতিসংক্রান্ত অন্যান্য ক্ষেত্রেও হয়েছিল।
তবে ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের এ পর্ব চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের বিভিন্ন সময় হওয়া আলোচনায় এবং ১৯৭৯ সালের স্বাভাবিকীকরণ চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত ‘এক চীন নীতির’ প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির প্রতি চীনের বিদ্যমান আস্থাকে ক্ষুণ্ন করবে।
জিমি কার্টার প্রশাসনের অধীনে হওয়া এ চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চীনকে পূর্ণমাত্রায় কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল এবং তাইওয়ানের সঙ্গে ওয়াশিংটন স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। তবে পরে কংগ্রেস তাইওয়ান রিলেশন্স অ্যাক্ট নামের একটি আইন প্রণয়ন করে, যা তাইওয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের অনুমতি দেয়। একই সঙ্গে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য ভূখণ্ডটিকে অস্ত্র সরবরাহের অনুমোদন দেয়। এটি বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্ককে তিক্ত করে তোলে।
১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাইওয়ানের ন্যাশনালিস্ট পার্টির নেতা লি তেং-হুইকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের অনুমোদন দিলে চীন ক্ষুব্ধ হয়। ক্লিনটনের ওই অনুমোদন তাইওয়ানের নেতাদের যুক্তরাষ্ট্র সফরের নিষেধাজ্ঞাকে উল্টে দিয়েছে।
পরের বছর তাইওয়ানের প্রথম অবাধ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লির নির্বাচন বেইজিংকে আরও অসন্তুষ্ট করে। তাঁর নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা ১৯৯৫-৯৬ সালজুড়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। ওই সময় চীন তাইওয়ানের কাছে সামরিক মহড়া চালায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা আগ্রাসন রোধ করতে যুদ্ধজাহাজ পাঠায়।
তাইওয়ান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে উত্তেজনা এত দিন বিক্ষিপ্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে; তবে এই সর্বশেষ বিস্ফোরণ সম্ভবত সি চিন পিংয়ের জন্য সবচেয়ে গুরুতর ঘটনা।
সামরিক সংঘর্ষে জড়ানো চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের কারোরই আগ্রহ নেই। তবে একটি দুর্ঘটনার ফলে দুই দেশ একটি বড় ধরনের বিবাদে জড়িয়ে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটি উল্লেখযোগ্য যে তাইওয়ান এবং এর আশপাশে নিজের সামরিক মহড়ার সময় চীন প্রণালিতে মধ্যম রেখা অতিক্রম এড়াতে চীন সতর্কতা অবলম্বন করেছে। চীনের সামরিক বাহিনী সর্বশেষ যে বিমান ও সমুদ্র মহড়া চালিয়েছে, তার মধ্যে গোলা নিক্ষেপও ছিল।
পেলোসি তাঁর সফরের কারণে যে কূটনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, তার জন্য কোনো রকম অনুশোচনা প্রকাশ করেননি। তিনি তাইওয়ানে অবতরণের পরে ওয়াশিংটন পোস্ট–এ প্রকাশিত তাঁর নিজের লেখা একটি মতামতধর্মী লেখায় তিনি তাইওয়ানের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য বেইজিংয়ের সমালোচনা করেছেন। তিনি হংকংয়ে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর ‘নিষ্ঠুর পীড়ন’ এবং এর উইঘুর মুসলমান সংখ্যালঘুদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের জন্যও বেইজিংকে দায়ী করেছেন।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন কারবি পেলোসির সফর নিয়ে প্রশাসনের ভুল ধারণার কথা উল্লেখ করেছেন। কারবি বলেছেন, ‘এ সর্পিল ঘটনাপ্রবাহ কোনো ধরনের সংকট বা সংঘাতের দিকে যাক তা আমরা চাই না।’
এখন পর্যন্ত চীন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তাইওয়ানের পণ্য চীনে রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং বেইজিংয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকোলাস বার্নসকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মধ্যরাতে তলব করা হয়েছে।
পেলোসির সফর মার্কিন-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৃহত্তর উত্তেজনার সূত্রপাত ঘটাতে পারে। তবে বাইডেন ও সির মধ্যে একটি মুখোমুখি বৈঠক হলে এ উত্তেজনা প্রশমিত হতে পারে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● টনি ওয়াকার মেলবোর্নের লা ট্রোব ইউনিভার্সিটির একজন ফেলো