বাংলাদেশের অর্থনীতির রোগ সারবে কীভাবে

কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ–সহিংস পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) সন্ধ্যার পর থেকে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু করা হয়। এ কয়দিনের প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার সম্পাদকীয়, লেখা ও সাক্ষাৎকার ধাপে ধাপে অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) এ লেখা ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

দেশে-বিদেশে পরিচিতজনদের প্রশ্ন—আমাদের অর্থনীতি কীভাবে গর্তে পড়ল? গর্ত থেকে বেরোনোর উপায় কী? আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ‘গ্রস রিজার্ভ’ ২০ বিলিয়ন ডলারে এবং নিট রিজার্ভ (ব্যয়যোগ্য) ১৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অথচ ২০২১ সালের আগস্টে সরকারের দাবি অনুযায়ী, গ্রস রিজার্ভ বেড়ে ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল।

পত্রিকান্তরে জানা গেছে, দুই বছরে আমদানি ব্যয় ৪০ বিলিয়ন ডলার কমিয়েও রিজার্ভের পতন থামানো যায়নি। ২০২১ সালের আগস্টে দেশে ১ ডলারের দাম ছিল ৮৭ টাকা। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি অনুসারে তা দাঁড়িয়েছে ১১৮ টাকায়। এর মানে, এই দুই বছরে টাকার বৈদেশিক মান ৩৮ শতাংশ অবমূল্যায়নের শিকার হয়েছে।

সংখ্যা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক থাকলেও আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং, রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনা এবং হুন্ডি পদ্ধতিতে ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার—এ চার প্রধান অর্থ পাচারের প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে প্রতিবছর ১৫ থেকে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। সংখ্যায় এসব পুঁজি পাচারকারী কয়েক হাজারের বেশি হবে না। দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা, প্রকৌশলী, বিত্তবান ব্যবসায়ী কিংবা দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের সমাজের ওপরের অংশে তাঁদের অবস্থান। 

উল্লিখিত সমস্যাগুলো বর্তমান ব্যবস্থার ভুলের কারণেই সৃষ্ট; বিশেষ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের অদক্ষতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণেই বেশির ভাগ সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করেছে। তবে উল্লিখিত সমস্যাগুলো সমাধানের অযোগ্য নয়। বিগত দিনে সরকার খেলাপি ঋণ, পুঁজি পাচার, হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স প্রেরণ, দুর্নীতি দমন এবং স্বল্প প্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প গ্রহণের হিড়িকের ব্যাপারে যে ভুল অবস্থান গ্রহণ করেছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। 

করোনাভাইরাস মহামারির আঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে গেলেও বাংলাদেশের মাথাপিছু জিএনআই ২০১৯ অর্থবছরের ১ হাজার ৯০৯ ডলার থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন ২ হাজার ৭৬৫ ডলারে এবং ২০২৪ সালের জুন মাসে ২ হাজার ৭৮৪ ডলারে পৌঁছেছে বলে সরকারি দলিল দেখিয়েছে।

এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অর্থনীতি যে স্বস্তিকর অবস্থানে থাকার কথা, তার পরিবর্তে বরং জটিল আকার ধারণ করছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে যাবে বলে বিশ্বব্যাংক অনুমান করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের দুর্নীতির র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী, বাংলাদেশ আফগানিস্তানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। 

২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বর্তমান সরকার দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করলেও তাদের এই অঙ্গীকার পূরণে খুব একটা তৎপর দেখা যায়নি। পুঁজি পাচার দমন না করলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাবে না। অর্থনীতি বিপদে পড়ার আরেকটি বড় কারণ অযাচিতভাবে একের পর এক বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ। বাংলাদেশে এক দশকে অনেকগুলো বৃহৎ বা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে কিংবা বাস্তবায়নাধীন, যেগুলোর বেশ কয়েকটিকে স্বল্প প্রয়োজনীয় অথবা অপ্রয়োজনীয় বলা চলে।

অন্য যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো ক্রমহ্রাসমান কর-জিডিপি অনুপাত। কর-জিডিপি অনুপাত কমতে কমতে ৮ শতাংশের নিচে নেমে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। কর-জিডিপির অনুপাত কমতে থাকায় বাজেটের ব্যয়-সংকুলানের জন্য সরকারি ঋণের বোঝা বাড়ছে। প্রত্যক্ষ করের অবদান কর-রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ, বাকি দুই-তৃতীয়াংশ আসে পরোক্ষ কর থেকে। এর মানে, দেশে করের মূল বোঝা বহন করে চলেছে সাধারণ জনগণ।

এই অবস্থা থেকে বের হতে যা দরকার তা হলো, জনহিতকর প্রকল্প নির্বাচনে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকার চেষ্টা, প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা, প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের সততা, রাজনীতিবিদদের পরমতসহিষ্ণুতা, দেশপ্রেম এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেশের স্বার্থকে দাম দেওয়া। সেই সঙ্গে কিন্তু সুশাসন, স্বচ্ছতা আর জবাবদিহির কথাও ভুলে গেলে হবে না।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক