গণ-অভ্যুত্থানের পর যে ধরনের বিশৃঙ্খলা সাধারণত হয়, বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম কিছু হচ্ছে না। সমস্যা হচ্ছে, এই পরিস্থিতি বেশি দিন ধরে চললে জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়তে থাকবে। যেকোনো সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হলো মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। মানুষ যেন মনে করে, এই সরকার তাদের সরকার।
শুরু করা যাক দ্রব্যমূল্য দিয়ে। সাম্প্রতিক অতীতে পৃথিবীতে যত গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, তার পেছনে অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সেই সঙ্গে সুশাসনের অভাব। আরব বসন্তের সূত্রপাত তিউনিসিয়ার সবজি বিক্রেতা মুহাম্মদ বুয়াজিজির আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে। মূলত পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন; তাঁর সেই জ্বলন্ত শরীরের ছবি বিশ্বগণমাধ্যমে ঠাঁই পায়। মুহূর্তেই জ্বলে ওঠে আগুন। বারুদ প্রস্তুতই ছিল, তাতে আগুনটা ছুঁইয়ে দেয় তাঁর আত্মহনন।
আমাদের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পাটাতন তৈরি করেছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের অভাব, অপশাসন ও দুর্নীতি। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি মানুষের ক্ষোভ ছিল চরম; জনপ্রশাসন থেকে শুরু করে সরকার-সংশ্লিষ্ট সবার প্রতিই তা ছিল। ফলে আগুন দাবানলে হয়ে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি।
কথা হলো, মানুষ স্বস্তি চায়। এটি থাকলে সরকারে কে থাকল বা তাদের রাজনৈতিক অভিপ্রায় কী, সেসব অতটা ধর্তব্যে আসে না। শেখ হাসিনা যে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে একতরফা নির্বাচন করেও পার পেয়ে যান, তার মূল কারণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা। তখন বাংলাদেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, দুর্নীতি ছিল, মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ শতাংশের ঘরে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সামষ্টিক অর্থনীতিতে একধরনের স্থিতিশীলতা ছিল। সেই স্থিতিশীলতা কাজে লাগিয়ে আরও অনেক কিছু করা সম্ভব ছিল, যা হয়নি। রাজনৈতিক বিভক্তি থাকলেও সমাজে একরকম স্থিতিশীলতা ছিল।
সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে শুরু করে কোভিডের সময়; এরপর ২০২২ সাল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি হয়। সেই সঙ্গে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও বড় বড় দুর্নীতির খবর বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে। অবিশ্বাস্য দুর্নীতি ও লুটপাটের খবর মানুষ জানতে শুরু করে। সরকারি মদদে ঘটা এসব দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনা মানুষকে ক্ষুব্ধ করে। তখন মানুষের মধ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এমনকি ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ হবে কি না, অনেক মানুষ সাংবাদিকদের কাছে তা জানতে চাইতেন। সুশাসনের অভাব, গণতন্ত্রহীনতা, বিচারহীনতা, সরকারের দমনমূলক আচরণ ও একগুঁয়ে মনোভাব, পুলিশের দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ ও সরকারি দলের লোকজনের স্বেচ্ছাচারিতা— এসব কিছুই জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমি তৈরি করে।
কিন্তু প্রথম সমস্যা হলো, যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে এত দিন এত কথা বলা হয়েছে, তা এখনো চলমান। সেই পরম্পরা থেকে মুক্তির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিগতভাবে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে মুদ্রানীতি বা শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব নয়। সে জন্য সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
আগস্ট মাসে বন্যা ও তারপর অতিবৃষ্টিতে ফসলহানি হবে জানা কথা, কিন্তু সে জন্য বিশেষ প্রস্তুতি কি ছিল? বাজারে কখন কোন পণ্যের সরবরাহসংকট হতে পারে, তা আগেভাগে নিরূপণ করে কি আমদানি আরও উন্মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে? এমনকি দেশীয় পোলট্রি ব্যবসায়ীরা সরকারকে ডিম আমদানি করতে দিতে চায় না। তাঁদের মুখে সেই একই খোঁড়া যুক্তি, আমদানি করলে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে; মানুষের দুরবস্থা তাঁদের হৃদয় বিগলিত করতে পারে না।
ডিমের দাম ডজনপ্রতি ১৮০ টাকায় ওঠার পরও তাঁরা এই অবস্থান নেন। সরকার অবশ্য আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু যখন আমাদের ঘাড়ের ওপর এসে পড়ছে, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। আগেভাগে ব্যবস্থা নিতে পারছি না। ডিমের দাম তিন থেকে চার দিনের মধ্যে কমে গেছে ঠিক; কিন্তু এই কয় দিনের দুর্ভোগ মানুষের মনে থাকবে; বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের। মাছ-মাংসের দাম আগে থেকেই বাড়তি, অতিবৃষ্টিতে সবজির দামও বাড়তি—এ বাস্তবতায় তাঁদের সবেধন নীলমণি ছিল ডিম। কিন্তু সেই ডিমের দাম ডজনপ্রতি ১৮০ টাকায় উঠে যাওয়া তাঁদের পেটে লাথি মারার শামিল।
দেশের সবকিছু হাতে গোনা কয়েকটি গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত হয়ে গিয়েছিল। এই যে ডিম আমদানিতে বাধা দেওয়া, তার অর্থ হলো, সেসব গোষ্ঠী এখনো আছে। তারা যে হঠাৎ করে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবেন, তা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ব্যবস্থা পাল্টানোর মতো সক্ষমতা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কতটা আছে?
এ তো গেল বাজারের অবস্থা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পক্ষ বা গোষ্ঠী রাজধানীতে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করছে। এমনকি সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। মূল সমস্যা হলো, এসব আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। রাস্তাঘাটের শৃঙ্খলা বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। যানজট চরম আকার ধারণ করেছে। এ পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে বিরক্তির বোধ তৈরি হচ্ছে। সড়কের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। আগেও দুর্ভোগ ছিল, কিন্তু অনিয়মের মধ্যে একধরনের নিয়ম ছিল, যা ৫ আগস্টের পর ভেঙে পড়েছে। সেখানে শৃঙ্খলা আনার কাজটি যত দ্রুত করা উচিত ছিল তা হচ্ছে না।
আরেকটি বিষয় হলো অটোরিকশার দৌরাত্ম্য। রাজধানীর প্রায় সব সড়কে এখন অটোরিকশা চলাচল করছে। প্রতিদিনই যেন বাড়ছে এই অটোরিকশা। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ঢাকা শহর যেন অটোরিকশার; এ পরিস্থিতি যে বিষয় জানান, দেয় তা হলো বেকারত্ব বাড়তি। গ্রাম থেকে তরুণেরা শহরে এসে কাজ না পেয়ে বা ভালো রোজগারের আশায় অটোরিকশা চালাচ্ছেন। এত দিন ঢাকার পরিচিতি ছিল রিকশার শহর হিসেবে, এখন হয়তো তা হবে অটোরিকশার শহর।
পরিবহনে চাঁদাবাজি চলছে আগের মতোই। ফলে আগেও যেমন এক কিলোমিটার রাস্তার জন্য ১০ টাকা বা ক্ষেত্রবিশেষে ২০ টাকা ভাড়া হতো, এখনো হচ্ছে। অথচ সড়কে পুলিশের দৌরাত্ম্য নেই বলেই আমরা জানি। যেটা হয়েছে, সেটা হলো এক দলের চাঁদাবাজদের জায়গায় আরেক দলের চাঁদাবাজ এসেছে। এসব থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক প্রভাব মানুষ অনুভব করতে পারবে না।
তিউনিসিয়ার গণ-অভ্যুত্থানে ২৭ দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট জয়নুল আবেদিন বেন আলীর ২৩ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান হয়। এরপর মিসরের কায়রোর তাহরির স্কয়ারে মাত্র ১৮ দিনের আন্দোলনে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন তিন দশকের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক। আমাদের ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসককে বিদায় করতে সময় লেগেছে ৩৬ দিন। কিন্তু তিউনিসিয়া ও মিসরের জনগণ গণ-অভ্যুত্থানের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। সে জন্য অভ্যুত্থান-পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ অত্যন্ত জরুরি।
বাস্তবতা হলো, মানুষের জীবনে স্বস্তি ও স্থিতিশীলতা আসতে পারে—তেমন কোনো উদ্যোগ এখন দেখা যাচ্ছে না। আরব বসন্ত ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অস্থিতিশীলতা ছিল মূল কারণ। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
এ ছাড়া রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সুশাসন না এলে গণবিরোধী প্রশাসনিক কাঠামো অক্ষুণ্ন থাকবে। এতে যেমন মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়বে, এর সুযোগ নিয়ে পতিত শাসকগোষ্ঠী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করতে পারে।
প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক