কোটা সংস্কার আন্দোলন নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। এত দিন শিক্ষার্থীদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বাধা না দিয়ে সহযোগিতা করেছে সরকার। কিন্তু গতকাল রোববার মধ্যরাতে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে আন্দোলন; জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সতর্ক অবস্থান সাংঘর্ষিক অবস্থানে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিল। সোমবার দুপুরে সেই ইঙ্গিতই সত্যি হলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করে ছাত্রলীগ; যথারীতি তাঁদের অনেকের মাথায় ছিল হেলমেট। দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটতে শুরু করলে তাঁদেরকে ব্যাপক মারধর করা হয়। শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
আগের অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে আন্দোলনে ব্যাপক দমন-পীড়ন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধ করে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে।
সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের একটি রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালের পর আবার রাস্তায় নেমেছেন। মেধার বিপরীতে কোটা কিংবা কোটার বিপরীতে মেধা—এই বাইনারির বাইরে গিয়ে তরুণদের কর্মসংস্থানের সামগ্রিক হাল দেখে নেওয়াটাও জরুরি।
প্রথমেই বাংলাদেশের তরুণদের কর্মসংস্থানের কিছু পরিসংখ্যান দেখে নেওয়া যাক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, প্রতিবছর কর্মবাজারে যুক্ত হচ্ছেন ১৮-১৯ লাখ তরুণ। স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস ২০২১ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭। তাঁদের মধ্যে নারী ৪ লাখ ৪ হাজার ৫৯১ জন, যা মোট চাকরিজীবীর প্রায় ২৬ শতাংশ। ২০১০ সালে নারী চাকরিজীবীর সংখ্যা ছিল ২১ শতাংশ। জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গত ২২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে জানান, সরকারি প্রতিষ্ঠানে গত ৫ বছরে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ২৩৭ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এ পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট, বছরে গড়ে মাত্র ৭০ থেকে ৭১ হাজার কর্মসংস্থান হয় সরকারি খাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের যে আন্দোলন, সেটা মূলত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি। যদিও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এখন সব সরকারি চাকরিতেই কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন।
সরকারি খাতে চাকরির বাইরে থেকে যাওয়া লাখ-লাখ তরুণ প্রতিবছর শ্রমবাজারে আসছেন, তাঁদের কর্মসংস্থান ও জীবিকার ব্যবস্থা হয় বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে। তাঁদের বেশির ভাগের কর্মসংস্থান ও জীবিকার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। বরং ক্ষমতার বলয়ে যুক্ত ব্যক্তিদের নানাভাবে সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়, যাতে এই লোকগুলোর সম্পদ গুটিকয়েক পকেটে পড়ে।
যেমন কিছুদিন আগে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ অংশের সিন্ডিকেটের কথা বলা যায়। দেশে কাজ না থাকায় প্রতিবছর ছয় থেকে সাত লাখ তরুণ কর্মসংস্থানের আশায় বিদেশে পাড়ি জমান। খেয়ে না-খেয়ে রেমিট্যান্স পাঠান, তথাকথিত অভিজাত অংশের অবাধ পাচারে ডুবতে বসা অর্থনীতিকে কোনোরকমে ভাসিয়ে রাখেন তাঁরা। বাংলাদেশি সেই খেটে খাওয়া তরুণদের কর্মসংস্থানের অন্যতম বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায় যাওয়ার দরজা বন্ধ করে দিয়েছে যে সিন্ডিকেট, তাতে চারজন সংসদ সদস্য জড়িত। মালয়েশিয়া যেতে যেখানে সরকার নির্ধারিত ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা, সেখানে এই চক্রের কারণে সে ব্যয় বেড়ে হয়েছিল ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ ভাবছে সরকার। শিক্ষার্থীরা অপমানিত হয়েছেন, তাঁদের মর্যাদায় আঘাত লেগেছে। তা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা যে ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান দিয়েছেন, সেটা ঠিক হয়নি। তাঁদের বুঝতে হবে একটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে অনেক পক্ষ থাকে। সে সব পক্ষের প্রত্যেকের নিজ নিজ স্বার্থ ও এজেন্ডা থাকে, অন্তর্ঘাত ঘটানোর প্রচেষ্টা থাকে। ফলে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই সচেতন থাকা দরকার ছিল, কেউ তাঁদের আন্দোলনকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে কি না।
দেশে থেকে যাওয়া তরুণদের একটা বড় অংশ ফুটপাতে হকারি, পান-সিগারেট-চা কিংবা আলুপুরি-বেগুনি-চা বিক্রির মতো স্বনিয়োজিত কাজে যুক্ত হন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী ও পুলিশকে চাঁদা দিয়ে তাঁদের ব্যবসা করতে হয়। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকায় একেকজন হকারের কাছ থেকে দিনে গড়ে ৩০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। তার মানে বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা চাঁদা দিতে হয়। এর প্রভাব সরাসরি জিনিসপত্রের দামের ওপর পড়ছে।
বেসরকারি খাতে তরুণদের যে কর্মসংস্থান হয়, সেখানে ভদ্রস্থ জীবনযাপনের মতো বেতন, কাজের নিশ্চয়তা কতজনের ভাগ্যে জুটছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অনেকেই ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, ২০১৮ সালে নির্বাহী আদেশে বাতিল হওয়ার আগে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থা ছিল অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক। ৫৬ শতাংশ কোটা থাকায় অপেক্ষাকৃত ভালো প্রতিযোগীরা বিসিএসের চাকরি পাওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিসিএসের মাধ্যমে যাঁরা সরকারি চাকরি পাচ্ছেন, তাঁরা মেধাবী আর অন্যরা অমেধাবী, এভাবে দেখারও সুযোগ নেই।
কেননা, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়া যতটা না মেধার ব্যাপার, তার চেয়ে বেশি সুযোগের। দারিদ্র্যের কারণে প্রতিবছর প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে যে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে, ভালো সুযোগ পেলে বিসিএস পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা কি তাঁদের হতো না? ফলে বৈষম্যবিরোধিতার কথা বললে সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণদের ভদ্রস্থ জীবনযাপনের মতো কর্মসংস্থানের কথাও বলতে হবে। তাঁদের বাদ রেখে বৈষম্য বিলোপ করা যাবে না।
২০১৮ সালের প্রথম কোটাবিরোধী আন্দোলনের পর সরকার একতরফভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি থেকে কোটা তুলে দেয়। বাতিল করা সেই সিদ্ধান্ত আবার কেন সামনে নিয়ে আসা হলো, এর পেছনে সরকারের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছে, সরকার চাইছে আদালতের মধ্য দিয়েই ব্যাপারটার ফয়সালা হোক।
কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ ভাবছে সরকার। শিক্ষার্থীরা অপমানিত হয়েছেন, তাঁদের মর্যাদায় আঘাত লেগেছে। তা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা যে ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান দিয়েছেন, সেটা ঠিক হয়নি। তাঁদের বুঝতে হবে একটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে অনেক পক্ষ থাকে। সে সব পক্ষের প্রত্যেকের নিজ নিজ স্বার্থ ও এজেন্ডা থাকে, অন্তর্ঘাত ঘটানোর প্রচেষ্টা থাকে। ফলে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই সচেতন থাকা দরকার ছিল, কেউ তাঁদের আন্দোলনকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে কি না।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সরকারের প্রতিপক্ষ নয়। এবারে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার দায় সরকারের, কেননা কোটা সংস্কার না করে বাতিল করেছে তারা। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নামিয়ে দিয়ে, শিক্ষার্থীদের পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে, মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের দমানোর চেষ্টা আর যাই হোক ভালো ফল দেবে না।
মনোজ দে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী