যেকোনো সরকারেরই প্রথম ১০০ দিনের কাজের অর্জন থাকে, লক্ষ্যমাত্রাও থাকে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজকর্মে সে রকম কোনো অর্জন ধরা পড়ছে না। কারণ, তাদের নিশানা ও কাজের মনোযোগে ঘাটতি যত না দোষের, তার চেয়েও বেশি সমালোচিত তাদের উদ্দেশ্যাবলির বিক্ষিপ্ততা।
সরকারের ভেতরেই তিনটি ধারার দর্শন প্রবহমান। একদল উপদেষ্টা মনে করছেন, কিছু সংস্কার শেষ করে এক অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন দেওয়াই তাঁদের কাজ; যদিও এই দল সবচেয়ে দুর্বল ধারা।
দ্বিতীয় সম্প্রদায় মনে করছে, একটি বৈপ্লবিক ধারায় দেশকে নিয়ে তঁাদের মনমতো প্রজাতন্ত্রের পুনঃসংজ্ঞায়ন সম্ভব। তাঁরাই ঠিক করবেন নির্বাচনে কাকে রাখবেন, কাকে রাখবেন না। তৃতীয় ধারার উপদেষ্টারা কিছুটা বিভ্রান্ত এবং দীর্ঘমেয়াদি কোনো কাজে যুক্ত হতে চাইছেন না। কারণ, তাঁদের মেয়াদ যে কতটুকু, তা তাঁরা নিজেরাই বুঝতে পারেন না। এই ত্রিমুখী অনিশ্চয়তা অর্থনীতিকে আরও সংকটাপন্ন করবে।
কয়েকটি বিচিত্র উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে সরকার তার কাজে নিজেই বিভ্রান্ত। আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বড় ক্ষত ছিল ব্যাংকিং খাত, যার অদক্ষতা ও দুর্নীতির অন্যতম শিকড় ছিল সচিবালয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বা এফআইডির অবস্থান।
২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি তার শাসনামলে এটিকে তুলে দিয়েছিল, যা ছিল আর্থিক খাতের উন্নয়নে এক যথার্থ পদক্ষেপ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি এফআইডির অবস্থান অনেকটা লর্ড ক্লাইভের দ্বৈত শাসনের মতো। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী সরকার এই দ্বৈত শাসনের পুনঃপ্রবর্তন ঘটায়, যা ব্যাংকিং খাতের আরও অবনতি ঘটায়।
অর্থচোর ও লুটেরারা অর্থমন্ত্রীকে প্রভাবিত করে সচিবালয়ের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর লাঠি ঘোরাত। সে জন্যই ২০০৯ সালের ২২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ শেষতক ২০২৪ সালে ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকায় উঠেছিল।
শুধু এফআইডি-ই যে এর বড় কারণ তা নয়। কিন্তু এর মাতবরি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দুর্বল করেছে। গভর্নরকে বানানো হয়েছে সাক্ষীগোপাল। এ জন্য সরকারি ব্যাংকগুলোয় খেলাপির পরিমাণ শতকরা হিসাবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপির চেয়ে চার গুণের বেশি। দক্ষতার প্রথম শর্ত হলো এফআইডি বিলুপ্ত করা। কিন্তু নতুন সরকার এফআইডিতে নতুন সচিবের পদায়ন দিয়ে আরও তাজা করার ব্রতে নেমেছে, যা এর সংস্কারবিমুখতা তুলে ধরে।
কম্পিউটার এক উন্নত যন্ত্র। কিন্তু যার তার হাতে তা তুলে দিলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে না। সরকারি টেলিফোন সংস্থা বা টিঅ্যান্ডটির হাতে সব টেলিযোগাযোগের নিয়ন্ত্রণ জাতিকে দিয়েছে দুর্ভোগ, অপচয় ও দুর্নীতির পুরস্কার। টিঅ্যান্ডটির হাতে মোবাইল ফোন থাকলে যোগাযোগের বিপ্লব ঘটত না। অর্থনীতিও এত দূর এগিয়ে আসত না। সরকার–সমর্থিত মনোপলি সর্বদাই অদক্ষতা ও লুণ্ঠনের আখড়া।
এ রকম আরেকটি সংস্থার নাম বাংলাদেশ বিমান, যা ৫০ বছরেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি বা দাঁড়াতে চায়নি। এই বিমানকে নবনির্মিত তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড ও লাগেজ হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলো কী যুক্তিতে, তা এক বিস্ময়ের ব্যাপার। বাকি সব পরিচালনা জাপানি সংস্থাগুলোর হাতে দিয়ে সব ‘হংস মাঝে এই বককে’ কী করে ঢোকানো হলো, তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কোথাও কি একটা ‘ডিল’ হয়েছে? সংস্কারমুখী এক সরকার কী করে এই পুরোনো পাপীকে এনে লাগেজ কাটার দায়িত্ব দিল?
সরকার প্রবাসীদের স্বাচ্ছন্দ্য বাড়াতে বদ্ধপরিকর। প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ লাউঞ্জ ও নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সরকার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আগের ‘শ্রমিকদরদি’ সরকারেরা এগুলো তাদের উন্নয়নের ধ্যানমগ্ন মস্তিষ্কে আনতে পারেনি কেন, সেটি আজ প্রশ্নের বিষয়।
এখন প্রবাসী শ্রমিককে ‘স্যার’ সম্বোধনেরও রীতি করে দেওয়া হয়েছে, যা অকল্পনীয়। কিন্তু সেই ‘স্যার’ যদি দেখেন যে তাঁর লাগেজ পেতে অহেতুক বিলম্ব হচ্ছে কিংবা তাঁর স্যুটকেস কাটা–ফাটা, তাহলে তাঁর তৃপ্তিও ফেটে যাবে। বিমানকে দায়িত্ব দিলে এটি হবেই। হয়তো প্রথম প্রথম কিছুদিন ওরা সাধু থাকবে। তারপর সেই পুরোনো রূপে ফিরে আসবে। দুই বছরের চুক্তিতে ঢুকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আদায় করে নেবে। কদিন বাদে দক্ষ জাপানি লোকজনের নানা অসিলায় সব কাজ থেকে তাড়াবে। কথাগুলো কেউ পাথরে লিখে রাখতে পারেন। প্রবাসীরা আশা করেছিল যে নতুন টার্মিনালে সবকিছুই বিশ্বমানের হবে। কিন্তু ‘বিমানই লাগেজ সামলাবে’ শুনে সেই স্বপ্ন এখন আতঙ্কে পরিণত হচ্ছে।
চারদিকে আজ তাত্ত্বিকের ছড়াছড়ি। কেউ হয়তো স্বদেশি কোম্পানি বিমানের কাজ পাওয়ার বিরোধিতা করাকে ‘স্বদেশের সঙ্গে বেইমানি’ বলে তত্ত্ব দিতে পারেন। অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থা স্বদেশি বা বিদেশি যা–ই হোক না কেন, তার সমর্থন কোনো দেশপ্রেমের অঙ্গ নয়, বরং তা এদের সমর্থন করাই অর্থনীতির স্বার্থবিরোধী। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক কি রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করে? নাকি কতিপয় সম্পদদস্যুর স্বার্থে কাজ করেছে?
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বা বিপিসি অদক্ষতা ও দুর্নীতির গুদাম। এটি জ্বালানি খাতকে জ্বালিয়ে দিয়েছে। এককালে এর ভেতরে অনুসন্ধান ও নিরীক্ষাকর্ম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সংস্কারের ধাপেই এসব সংস্থাগুলোকে খতম করা উচিত ছিল জনস্বার্থেই। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এলে আপস করবে।
টিঅ্যান্ডটির দরজায় ধরনা দিয়ে ফোনের সেবা পেতে হলে করিমন, ছমিরন বিবিরা ইহজনমে মুঠোফোন ব্যবহার করতে পারত না। সেটি গ্রামীণফোনের প্রবর্তক আজকের প্রধান উপদেষ্টা সবচেয়ে ভালো জানেন। তারপরও কেন এই অদক্ষ ও মার্কামারা দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি সংস্থাগুলোকে সব জায়গায় প্রশ্রয় দেওয়ার নাম সংস্কার নয়।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বা বিপিসি অদক্ষতা ও দুর্নীতির গুদাম। এটি জ্বালানি খাতকে জ্বালিয়ে দিয়েছে। এককালে এর ভেতরে অনুসন্ধান ও নিরীক্ষাকর্ম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সংস্কারের ধাপেই এসব সংস্থাগুলোকে খতম করা উচিত ছিল জনস্বার্থেই। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এলে আপস করবে। এদের সরাবে না। সেখানে দলবাজি আছে। রয়েছে ভোটের হিসাব। এদের অদক্ষতার দায়ভার শেষতক জনগণের কাঁধেই চাপানো হয়। করের টাকা দিয়ে লুণ্ঠিত ব্যাংকের পুনঃপুঁজিকরণ সম্পন্ন করা কিংবা বিপিসিকে টাকা দেওয়া একধরনের মৃদু মাপের দেশদ্রোহ।
নতুন সরকারের কর্মতালিকায় এগুলো আসছে না। শুধু দু–একজন উপদেষ্টা আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাজ ছাড়া আর কারও কর্মে বা কথায় কোনো দীর্ঘমেয়াদি দিকনির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে না। বিশৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি বা সিন্ডিকেটের দাপট না কমালে যে মূল্যস্ফীতি কমবে না, সে কথা বহু–উচ্চারিত হওয়ার পরও আজ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা একেবারেই নিরামিষাশী। সেনাবাহিনী কিছুটা অক্সিজেন সরবরাহ করছে মাত্র। কিন্তু মূল কাজটি পুলিশ বিভাগের। রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় না থাকার কারণে গোয়েন্দা বিভাগগুলোও কাজে আনন্দ পাচ্ছে না।
শুধু সাধারণ মানুষ নয়, খোদ ছাত্রনেতা ও সমন্বয়কদের মধ্যেও দিন দিন হতাশা বাড়ছে। ক্ষমতাপ্রাপ্ত কয়েকজন নেতা আসল কাজে মনোযোগ না দিয়ে নানামুখী বিদ্বেষ ও অস্থিরতা বাড়াচ্ছেন। এভাবে চললে ব্যবসায় বাঁচবে না, মানুষ কাজ পাবে না, সরকার কর পাবে না।
রাষ্ট্র চলবে কী করে? অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি সব সংস্থার বিলুপ্তি ঘটিয়ে সব ব্যবস্থাপনায় ব্যক্তি খাতের প্রতিযোগিতামূলক অংশগ্রহণ না বাড়ালে অর্থনীতি গতিশীল হবে না। যোগ্যতা থাকার পরও যদি দেশি বা বিদেশি সংস্থাগুলো দেশীয় কর্মকাণ্ডে নিয়োগ না পায়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগও আসবে না, দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়ে রপ্তানিও বাড়বে না। কাটবে না রিজার্ভ সংকট। সংস্কারের মূল লক্ষ্য হোক যোগ্যতার ভিত্তিতে কাজ এবং চিহ্নিত অদক্ষ সংস্থাগুলোর অপসারণ।
● ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক