নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে বৈষম্যবিহীন দেশের জন্য আন্দোলনে তারুণ্যের বিজয়ের পর। বাংলাদেশের তরুণদের ও আপামর জনগণের এই আন্দোলনের মূল সুরটি আমাদের বুঝতে হবে, নিকট ও দূর ভবিষ্যতের উন্নয়ন লক্ষ্য ও তা বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণের জন্য। তরুণদের আকাঙ্খা হচ্ছে ভালো কাজের মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
বিভিন্ন চিন্তাবিদদের মত হচ্ছে যে কর্মক্ষম ব্যক্তি বিশেষত তরুণরা উৎপাদনশীল কাজ করতে চায়, যে কাজের মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি হবে। সেইসাথে কর্মনিয়োজনের একটি স্বীকৃতিও থাকতে হবে।
সুতরাং এই মুহূর্তে নতুন সরকারকে দেশে স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টার সাথে সাথে সামগ্রিক উন্নয়ন কৌশলের দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। সেই পথে অর্থনীতি ও উন্নয়ন এমনভাবে এগোতে হবে যে বৈষম্য দূর করার প্রচেষ্টা যেন স্পষ্ট হয়। যত দ্রুত এগুলো মনোযোগ পায় তত মঙ্গল। এই ধরণের উন্নয়ন আলোচনা এতদিন বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর ধূম্রজালে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল।
সামষ্টিক অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা যে সবচেয়ে জরুরি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এবং পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সামষ্টিক অর্থনীতির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাকে বলা যায় উন্নয়নের পূর্বশর্ত, আর উন্নয়নের আসল লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের জীবনমান বৃদ্ধি আর দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণ।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে যেসব অর্জন হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে এই অনুধাবন যে বৈষম্য দূর করা আর দেশের সবাইকে উন্নয়ন কাজে সম্পৃক্ত করা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেদিকে অগ্রসর হবার আলোচনার শুরু হিসেবে এই লেখাতে কয়েকটি প্রসঙ্গ সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। এখনই এই পথ পুরো নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। ধারাবাহিকভাবে পূর্ণাঙ্গ কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এই কৌশল প্রণয়ন চলতে থাকার সময়টুকুতেও কিছু পরীক্ষামূলক কার্যক্রম, উদাহরণ তৈরির প্রচেষ্টা হাতে নেওয়া যায়।
সব কর্মক্ষম ব্যক্তি উন্নয়নের জন্য কাজ করতে না পারলে ক্ষমতাশালী ও ক্ষমতাহীনদের মধ্যে দূরত্ব তৈরী হয়। তখন মনে হয় দেশটা ওদের। এই “ওদের” নামে যে অন্যপক্ষ তারা উন্নয়নের নামে কিছু সুবিধাভোগী তৈরি করে ও তাদের সমর্থন আদায় করে। এভাবেই বিগত দশ পনোরো বছরে দেশে বৈষম্যের পাহাড় গড়ে উঠেছে। তাতে শিল্প-কৃষি-সেবা খাতে যেসব সম্ভাবনা বিকশিত হতে পারতো, তা হারিয়ে গিয়েছে।
বেকারের সঙ্গে এই নিট সংখ্যা যোগ করলে ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, ৬৭ লাখ তরুণ-যুবকের (১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী) জন্য উৎপাদনশীল কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। এ দুই অবস্থানে (বেকার ও নিট) নারীর সংখ্যা ৭১ লাখ। যদি ধরে নেওয়া হয় তাদের অর্ধেক পরিবারের কাজে (শিশু ও বেশি বয়সীদের সেবা ও গৃহকর্মে) ব্যস্ত, তাহলেও প্রায় ৩৫ লাখ কর্মসংস্থান দরকার।
যেমন শিল্প খাতের কথাই ধরি। আমার একটি সম্প্রতি সমাপ্ত গ্রন্থে দেখিয়েছি যে ২০১১ সালের পর থেকে বড় শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রসার হয়েছে। যদিও তারা সংখ্যায় কম এবং সেই সময়ে সংখ্যা আরো কমেছে, তবুও শিল্পের মূল্য সংযোজনে ও মোট কর্মসংস্থানে তাদের অংশ বেড়েছে, ফলে শ্রমবাজারে দাপট বেড়েছে। অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সংখ্যা ও কর্মসংস্থানে অংশ কমেছে। অথচ সেগুলোইতো ভূমিকা রাখতে পারে মধ্যবিত্তের আয় বৃদ্ধিতে। কেন এতো ঢাক ঢোল পিটিয়ে শিল্প নীতি, এসএমই নীতি গ্রহণ সত্ত্বেও সুফল এলো না? আন্তরিক চেষ্টা না থাকলে সেগুলো শুধু লোক দেখানো ইচ্ছে-কথা হয়েই থাকে।
টেকসই উচ্চ প্রযুক্তির দিশা দিয়ে ক্ষুদ্র জমির মালিকদের আয় বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করা হয়নি। তরুণেরা কৃষিবিমুখ হয়ে পড়ছেন। আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তি পেলে আবার মাটির কাছাকাছি গিয়ে ‘নতুন যুগের কৃষি’ সৃষ্টি করতে আগ্রহ জাগবে সবার। অর্থাৎ পথ অনেক আছে।
তরুণদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো সামগ্রিক উন্নয়ন–পরিকল্পনার কেন্দ্রস্থলে থাকবে। কারণ, তাঁরাই উদ্যোগী মনোভাব, নতুন ধ্যানধারণা বয়ে আনবেন, ছড়িয়ে দেবেন। তরুণদের আগ্রহের দিকগুলোর, সমস্যার অনেক কিছু এখনো জানাবোঝার-পরিমাপের বাইরে।
সরকারি পরিসংখ্যান তো শুধু তাঁদের ৮ শতাংশ বেকার, সেটুকু বলেই শেষ করে। অথচ তার একটা বড় অংশ ‘বেকার’ নাম ঘোচাতে কলেজে নামমাত্র ভর্তি থাকে, কেউ পরিবারের অন্যদের সঙ্গে কাজ ভাগাভাগি করে নিয়োজিত। কেউ নানা পথে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার কায়দাসন্ধানী। তাঁদের সবার সত্যিকার উৎপাদনশীল কাজ করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে দিতে হবে।
সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান দরকার সেই তরুণ-তরুণী-যুবকদের জন্য, যাঁরা কাজ করছেন না অথচ কাজ খুঁজছেন না, অর্থাৎ বেকার গুনতিতে ঢোকেননি, কিন্তু পড়াশোনা ছেড়েছেন। আইএলও তাঁদের বলছে ‘নিট’ (নট ইন এডুকেশন, এমপ্লয়মেন্ট অর ট্রেনিং)। তাঁদের সবাইকে যোগ করলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রয়োজন হবে বিশাল সংখ্যার।
বেকারের সঙ্গে এই নিট সংখ্যা যোগ করলে ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, ৬৭ লাখ তরুণ-যুবকের (১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী) জন্য উৎপাদনশীল কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। এ দুই অবস্থানে (বেকার ও নিট) নারীর সংখ্যা ৭১ লাখ। যদি ধরে নেওয়া হয় তাদের অর্ধেক পরিবারের কাজে (শিশু ও বেশি বয়সীদের সেবা ও গৃহকর্মে) ব্যস্ত, তাহলেও প্রায় ৩৫ লাখ কর্মসংস্থান দরকার।
বৈষম্যের আরেকটি দিক উল্লেখ করা জরুরি। তা হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অর্জনের পার্থক্য। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ নব্বইয়ের দশক থেকেই এগিয়ে গিয়েছিল। সেই অগ্রগতির অনেকটা এসেছিল স্কুলশিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে, শিল্পে নারীর কর্মনিয়োজনের পথ ধরে, ক্ষুদ্রঋণ ও এনজিও কার্যক্রমের সহায়তায়। কিন্তু গত এক দশকে উচ্চতর শিক্ষা, পারিবারিক ভূমিকা, উন্নত কর্মনিয়োজন—এসব ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান দুর্বল হচ্ছে।
গ্রাম ও শহরের মধ্যে এখন যে সুযোগের পার্থক্য বিরাজ করছে, সে বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে। সেখানে শুধু অবকাঠামো নয়, শিক্ষা–স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ ও মানের পার্থক্য যেন প্রজন্ম ধরে বঞ্চনা দীর্ঘায়িত না করতে পারে, তেমন পদক্ষেপ দরকার। অবশ্য শিক্ষা–স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে সর্বব্যাপী ঘাটতি আছে, যা এই লেখার পরিসরে আলোচনা করছি না।
সব মিলিয়ে আরও এক কোটি (সেই সঙ্গে নতুন শ্রমশক্তি ধরলে আরও বেশি) মানুষকে উৎপাদনকাজে নতুন নিয়োজন সম্ভব হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। কর্মোদ্যমে ব্যস্ত তরুণ ও যুবকদের হাতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের চেহারা পাল্টে যাবে। সেই উজ্জ্বল দৃশ্যপট বাস্তবে দেখতে হলে শিল্প, কৃষি, আধুনিক সেবা খাত—সর্বত্র শ্রমঘন উৎপাদনের কৌশল নিতে হবে। যাঁরা এখনই উপার্জনের কাজে ঢুকতে চান না, উন্নত প্রশিক্ষণ চান, তাঁদের সেই সুযোগ দিতে হবে।
মনে হতে পারে, এগুলো বলা তো সহজ, কিন্তু হবে কীভাবে! আগেই বলা হয়েছে, পথ অনেক আছে। এসব পথ সহজ করার জন্য সুষ্ঠু বাস্তবমুখী সময়-বেঁধে-দেওয়া পরিকল্পনা নিতে হবে, বাস্তবায়নের সোপান তৈরি করতে হবে। এখানে বিশেষজ্ঞ–শিক্ষক-গবেষকেরা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় ভূমিকা রাখতে পারেন, কিন্তু আসল পরিকল্পনাটি ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। যাঁদের জন্য এ পরিকল্পনা, অর্থাৎ তরুণদের দ্বারাই এটি ধাপে ধাপে তৈরি হতে হবে। তাঁদের পক্ষেই সম্ভব প্রতিটি জেলায় কী ধরনের সম্পদ আছে—জমি, বন, নদী, পুকুর, শিল্প, হস্তশিল্প, জনসম্পদ—সব বিবেচনায় নিয়ে, কী ধরনের আর্থিক বিনিয়োগ করতে হবে, প্রশিক্ষণ লাগবে, কতজনের কর্মসংস্থান হবে, তার একটি প্রাথমিক রূপরেখা আঁকা।
এসব পরিকল্পনার জন্য অর্থায়ন ও মানবসম্পদের সঙ্গে আরও যে উপকরণ দরকার, তা হচ্ছে যথাযথ তথ্য। বিগত দশকগুলোয় সরকার বিবিএসের মাধ্যমে যেসব জরিপ করিয়েছে, সেগুলোর তথ্য এবং অন্য সরকারি উৎসের তথ্যের মান নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা আছে। তরুণদের উদ্যম, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অভিজ্ঞ-প্রাজ্ঞজনদের বিশ্লেষণের সমন্বয়ে এগিয়ে গেলে বৈষম্যহীন উন্নয়নের পথনির্দেশনা প্রস্তুত করা ও বাস্তবায়ন দুরূহ হলেও অসাধ্য হবে না।
● রুশিদান ইসলাম রহমান অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন–গবেষক ও সাবেক গবেষণা পরিচালক, বিআইডিএস