শঙ্খচিল সরকার (৫) ও শস্য সরকার (১১)। প্রথমজন চিলমারীর রমনা ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে। তবে কুড়িগ্রামের কিশলয় স্কুলে ক্লাস করে। দ্বিতীয়জন কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।
শঙ্খচিল সরকারের দুর্গাপূজার ছুটি ছিল ১ থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত। আট দিন। ওদিকে ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া বড় ভাই শস্য সরকারের ছুটি ১ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত।
তেমনিভাবে শঙ্খচিলের যখন গ্রীষ্মকালীন অবকাশ, পবিত্র ঈদুল আজহা ও আষাঢ়ি পূর্ণিমার ছুটি ছিল ২৮ জুন থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত, তখন শস্যের ছুটি ৩ থেকে ১৯ জুলাই এবং পবিত্র রমজান মাসের ছুটি ছিল যথাক্রমে ২২ এপ্রিল থেকে ১১ মে ও ৩ থেকে ৮ এপ্রিল। একইভাবে শীতকালীন ও বড়দিনের ছুটি ছিল ২২ থেকে ২৮ ডিসেম্বর এবং ১৫ থেকে ২৯ ডিসেম্বর।
কোচিং সেন্টারে চলে ছুটিহীন পড়াশোনা। ছয় দিন পড়াশোনা, শুক্রবার পরীক্ষা। সরকারি স্কুলগুলোতে শুক্রবার ও শনিবার ছুটি থাকলেও কোচিং ও টিউশনি চালু থাকায় তা আর ভোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এদিকে নিঃসঙ্গ দাদা-দাদি চিলমারীর গ্রামের বাড়িতে নাতিদের অপেক্ষায় থাকেন। গাছ থেকে নারকেল পড়লে নাতিদের জন্য তুলে রাখেন। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, প্রবীণদের দীর্ঘায়ু হওয়ার সঙ্গে নাতি-নাতনিদের সঙ্গ জড়িত।
মাধ্যমিক আর প্রাথমিকে ছুটিতে কিছুটা মিল থাকলেও, কলেজ ও মাদ্রাসার সঙ্গে তো মেলেই না। ফলে উৎসবগুলো সপরিবার উদ্যাপন করা কঠিন। ফুফাতো, মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে দল বাঁধার উৎসব বিরল ঘটনা। এটার মধ্য দিয়ে জাতির ও স্থানিক গৌরব ও ঐতিহ্য শিশুদের মধ্যে রোপিত হয়।
২.
ডাচ শিশুরা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুখী। ২০১৩ সালে ইউনিসেফ উন্নত বিশ্বের শিশুদের ওপর একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় পাঁচটি বিভাগের মধ্যে যে তিনটিতে তারা সবচেয়ে এগিয়ে থাকে, সেগুলো হলো জীবনধারণে বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা, পড়াশোনার সুযোগ-সুবিধা এবং আচার-ব্যবহার ও জীবনযাত্রার ঝুঁকি। রিনা মায়ে কস্তা একজন মার্কিনি, ছিলেন স্বামীর সঙ্গে নেদারল্যান্ডসে। তিনি নেদারল্যান্ডসের শিশুদের সবচেয়ে সুখী হওয়ার আটটি গোপন কারণ খুঁজে বের করেছেন। তিনি ব্লগে লিখেছেন, ডাচ শিশুরা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুখী।
কারণ, ডাচ মা-বাবারা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষদের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, ডাচ মায়েরা পৃথিবীর মধ্যে প্রকৃত সুখী মা। ডাচ মায়েরা কখনোই বিষণ্নতায় ভোগেন না। ডাচ মা–বাবারা চাকরি ও সংসারের মধ্যে একটি সুন্দর ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেন। ডাচ শিশুরা সবচেয়ে সুখী। কারণ, তাদের বাবারা পার্টটাইম চাকরি করার মাধ্যমে সংসারে সাহায্য করেন ও সন্তান প্রতিপালনে সমান দায়িত্ব পালন করেন।
ডাচ শিশুরা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুখী। কারণ, তাদের একটা দাদু-নানি দিবস আছে। তারা প্রতি সপ্তাহেই কর্মব্যস্ত দিনগুলোতেও নানা-দাদুর সঙ্গে পার্কে বেড়াতে যায়। মা–বাবারা সন্তানদের দাদু-নানুর সঙ্গে সময় কাটানোর ব্যবস্থা রাখেন। সেভাবেই সমন্বয় করেন। প্রতিটি ডাচ শিশুর জীবনে দাদা, দাদি, নানা ও নানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁরা মনে করেন, এতে জ্ঞানের ধারাটিও প্রবাহিত হয়।
ডাচ শিশুরা সুখী, কারণ তাদের স্কুলে প্রতিযোগিতা করার চাপ থাকে না। ১০ বছরের নিচের শিশুদের বাড়ির কাজ থাকে না। তাদের মানসিক পীড়ন খুব কম। কারণ, ডাচ শিশুরা পরিবারের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর নাশতা খায়। তাদের সকালের নাশতা মানেই রুটি ও এর ওপর মাখন, সঙ্গে চকলেট। কারণ, ডাচ শিশুদের মতামত ব্যক্ত করার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। শেষ কারণটি হলো, শিশুদের পরিবারকে ডাচ সরকার প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা দেয়।
পৃথিবীর প্রতি তিন শিশুর মধ্যে একজন এমন দেশে বাস করে, যেখানে তাদের বাবারা বেতনসহ পিতৃত্বকালীন ছুটি পান, যঁাদের সংখ্যা সাড়ে চার কোটি। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, একেবারে শুরু থেকেই মা ও বাবার সঙ্গে ইতিবাচক ও অর্থপূর্ণ মিথস্ক্রিয়া শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ও জীবন গড়তে সহায়তা করে, তাদের স্বাস্থ্যকর ও সুখী করে এবং তারপর শেখার সক্ষমতা বাড়ায়।
এই ভূমিকা পালনে তাদের সুযোগ করে দেওয়া উচিত। চলতি বছরের শুরুতে ইউনিসেফ বিশ্বব্যাপী তার সব কার্যালয়ে ১৬ সপ্তাহ পর্যন্ত বেতনসহ পিতৃত্বকালীন ছুটির বিধান রেখে মা–বাবার ছুটি–সংক্রান্ত সংস্থাটির বিধিমালার আধুনিকায়ন করেছে। ফোর বলেন, ‘আমরা সব শিশুর জন্য হতে পারব না, যদি আমরা সব মা–বাবার জন্য না হই।’
ভয় থেকে জড়তা যেমন আসে, একপর্যায়ে সম্পর্কের অবনতি আর বিচ্ছিন্নতা সমাজ থেকে গোষ্ঠীতে, তারপর পরিবারে, তারপর বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী। জীবনের স্বাভাবিক ক্ষুধা বাধা পেতে পেতে জীবনের প্রতি টান ক্ষয়ে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের আত্মহত্যার যে মড়ক নেমেছে, এর পেছনেও সমন্বিত ছুটি না থাকাও দায়ী।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অভিন্ন ছুটির তালিকায় নিয়ে আসতে হবে। কোচিং সেন্টারগুলোকে ছুটি মানতে কঠোরভাবে বাধ্য করতে হবে। কোচিং সেন্টারগুলো চাইবেই, প্রতিযোগিতা হোক। যত প্রতিযোগিতা, তত মুনাফা। কিছু বিষয় সবাইকে মানতে হবে। পরিকল্পনাহীন ছুটি চালু রেখে রাষ্ট্র ‘সব মা–বাবা’র হবে কীভাবে? রাষ্ট্রই–বা গণতান্ত্রিক হবে কীভাবে?
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক