অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের বছর

শীতের রাতে নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদ পার হয়ে স্কুলের মাঠে যাত্রাগান দেখতে যেতাম। তখন যৌবন ছিল। তাই লোকে ‘ফাত্রা’ বললেও পরোয়া করতাম না। সেখান থেকে আমার একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল। রাত বারোটার সময়ও যদি যাত্রামঞ্চে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ কিংবা ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ গানগুলো শুরু না হতো, তাহলে বলা যেত গ্রিনরুমে নির্ঘাত কোনো ভেজাল হচ্ছে। হয়তো যাত্রাপালা সে রাতে ভন্ডুল হয়ে যেত।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় পাঁচ মাসের কাজে সেই যাত্রাগানের রাত বারোটার কথা মনে হচ্ছে। গ্রিনরুমে কোনো ইস্যু নিয়ে ভেজাল হচ্ছে। এতে সরকারের যে গজেন্দ্রগমন ও আত্মসৃষ্ট কিছু অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে বলা যায়, ২০২৫ সাল হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের বছর। 

সংস্কার আগে, না নির্বাচন আগে—এ নিয়ে সরকারের ভেতরেই ত্রিমুখী মতামত ২০২৫ সালকে আরও অনিশ্চিত করবে। নির্বাচন হয়ে গেলেও সমস্যা কাটতে কাটতে ২০২৬ চলে আসবে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মূলে অর্থনৈতিক কারণ ছিল মূল্যস্ফীতির দহন ও বেকারত্বের যন্ত্রণা।

সরকারের উচিত ছিল এই দুটিকে প্রাথমিকভাবে বাগে আনা। অর্ধডজন সংস্কার কমিটির বানানোর চেয়েও জরুরি ছিল মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব নিয়ে দুটি টাস্কফোর্স তৈরি করা। মূল্যস্ফীতি এক স্বল্পমেয়াদি সমস্যা, যার মানে এই নয় যে স্বল্প মেয়াদে এটি চলে যাবে।

দ্রুত বা স্বল্প মেয়াদে একে নামিয়ে না আনলে অন্য জটিলতা শুরু হয়। সর্দি বা ঠান্ডাজনিত রোগ দীর্ঘস্থায়ী হলে অনেক সময় যেমন নিউমোনিয়া হয়ে যায়, মূল্যস্ফীতি লম্বা হলেও তেমনি ‘স্ট্যাগফ্ল্যাশন’ চেপে বসে, যার মানে অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও উচ্চ দামস্তরীয় অস্থিরতা। দীর্ঘ মূল্যস্ফীতিতে খোদ যুক্তরাষ্ট্র সত্তর থেকে আশির প্রথমার্ধ পর্যন্ত এই বদ্ধস্ফীতিতে আক্রান্ত ছিল। জিমি কার্টারের মতো প্রেসিডেন্টও অজনপ্রিয় হয়ে পড়েছিলেন।

অবশ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতির বড় অংশ আসছে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট থেকে। এ জায়গায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করার কিছুই নেই। সরকারকে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতেই হবে। সমস্যা সেখান থেকে আসছে। এ দায়িত্ব নিতে টাস্কফোর্স গড়ারও প্রয়োজন পড়ে না।

সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগটি এখন একপ্রকার ‘নিষ্ক্রিয়তা’ মন্ত্রণালয়ে পরিণত হয়েছে। এভাবে চললে প্রবৃদ্ধি আরও কমবে, যা এই সময়ে অনভিপ্রেত। কারণ, বৈশ্বিক অর্থনীতি ২০২৪ সালে বেশ ভালো করেছে। ২০২৫ সালের শুরুতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর চীনের সঙ্গে এক শীতল বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হলেও পশ্চিমা অর্থনীতি আরও ভালো অবস্থানে যাবে। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে সুদহার কমিয়ে অর্থনীতি আরও চাঙা করার মতো হাতিয়ারগত সুবিধা বা ‘মনিটরি স্পেস’ রয়ে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির দাপিয়ে বেড়ানোর কারণে বাংলাদেশের হাতে সে সুবিধা নেই। অতি উচ্চ সুদহার ইতিমধ্যে জোগানজনিত খরচ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির আগুনে আরও ঘৃতাহুতি দিচ্ছে।

জানুয়ারির মাঝামাঝি বিভিন্ন সংস্কার কমিটি এক এক করে প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করবে। তাতে অস্থিরতা বাড়বে বৈ কমবে না। প্রস্তাবগুলো যে গোষ্ঠীরই স্বার্থ সংরক্ষণ করবে না, তারাই রাস্তায় নেমে পড়বে। এ কাজ এখন সবচেয়ে সহজ। কারও জন্য ‘ফরজ’ও বটে। এরপরও সংস্কার কমিটিগুলোর কাজকর্মের তেমন পূর্বাভাস নেই। মনে হচ্ছে, হঠাৎ গ্রিনরুম থেকে বেরিয়ে মঞ্চে ‘নায়ক’ হয়ে যাবে। এমন প্রত্যাশা অবাস্তব।

বেকারত্ব হঠাৎ সমাধান করা যায় না। এটি এক মধ্যমেয়াদি সমাধানের বিষয়। সরকারের উচিত ছিল প্রথমেই এটিকে জাতির ‘এক নম্বর সমস্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সেভাবে টাস্কফোর্সগুলোকে সাজানো। স্বাধীনতার পর যদি তৎকালীন সরকার জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ‘এক নম্বর সমস্যা’ হিসেবে চিহ্নিত না করত, তাহলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হার সেদিনের ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে আজ ১ শতাংশে নামত না। পাকিস্তান সেভাবে এদিকে নজর দেয়নি বলে সেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রায় ২ শতাংশ, ভারতে এটি শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় এটি ঋণাত্মক সংখ্যায় পৌঁছে গেছে। ছোটবেলায় পড়েছিলাম, ‘উদ্যম বিহনে কার পুরে মনোরথ’। অর্থনীতিতেও কোনো সমস্যা সমাধানের পূর্বশর্ত হচ্ছে, প্রথমে এর স্বীকৃতি এবং এরপর যথাযথ উদ্যম। 

বিনিয়োগ ছাড়া বেকারত্ব কমানোর কোনো উপায় নেই—বিশেষত ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের সঙ্গে বিশ্বনেতাদের যত সুসম্পর্কই থাকুক না কেন, তাঁরা সেই সম্পর্কের জোরে অন্তত সরাসরি বিনিয়োগ বা এফডিআই বাড়াবেন না। নির্বাচিত সরকার এলে ওটির চরিত্র দেখে বিনিয়োগ পাঠাবেন। তাই সে আশায় আপাতত গুড়ে বালি। ভরসা অভ্যন্তরীণ ব্যক্তি বিনিয়োগ। সেটি স্থবির হয়ে আছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে কমছে।

বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া ও শ্রমিকের কাজ হারানোর খবর প্রায়ই আসছে। এর কোনো শ্বেতপত্র হয়নি। তাই বেকারত্ব কমা তো দূরের কথা, এটি বরং বেড়েই চলেছে গত পাঁচ মাসে। পত্রপত্রিকা তা–ই বলে। অতএব অস্থিরতা কমানোর জন্য নির্বাচনের দিনপঞ্জি প্রকাশিত হওয়া জরুরি। এ নিয়ে সরকারের ভেতরের গ্রিনরুমে কোথায় যেন একটা ভেজাল রয়েছে। তাদের ঘোষণাতেও বৈপরীত্য রয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের থামিয়ে রেখেছে। অন্যদিকে সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষমতাও নেই। কারণ, রাজস্ব আদায় এই অর্থবছরে গত বছরগুলোর তুলনায় দুর্বলতম হবে বলে শঙ্কা রয়েছে। 

রিজার্ভ যদিও ধীরগতিতে বাড়ছে, তার জন্য মূল্যস্ফীতি বা বেকারত্ব—কোনোটিই বেশি উপকৃত হবে না। রিজার্ভ বাড়ছে, কারণ বিনিময় হার এখন বাজারের যথেষ্ট কাছাকাছি বলে রেমিট্যান্স বাড়ছে। কিন্তু রপ্তানি সেভাবে বাড়ছে না। আমদানি কমছে বড়দাগে। ২০২৩ সালের জুলাই–নভেম্বরের কালপর্বের তুলনায় ২০২৪ সালের কালপর্বে ভোগ্যপণ্য আমদানির ‘এলসি সেটেলমেন্ট’ কমেছে ১৩ শতাংশ। মূলধনি পণ্যের বেলায় এটি কমেছে ২২ শতাংশ এবং মধ্যবর্তী পণ্যের বেলায় এটি কমেছে ১৫ শতাংশ।

অর্থাৎ রিজার্ভ বাড়ার এক বড় কারণ আমদানি কমে যাওয়া। ব্যায়াম করে ওজন কমানো আর না খেয়ে ওজন কমানো—দুটি দুই জিনিস। পরেরটি বিপজ্জনক। ভোগ্যপণ্যের আমদানি কমলে বাজারে জোগান কমে দাম বাড়ায়। অন্যদিকে মূলধনি ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমলে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও সক্ষমতা কমে যায়। এর কিছু বাতাস ইতিমধ্যেই পড়েছে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির ওপর, যা বিশ্বব্যাংকের মতে চলতি অর্থবছরে শতকরা ৪ ভাগে নামবে। এটি কোভিডের কথা বাদ দিলে গত ২২ বছরে সর্বনিম্ন।

জানুয়ারির মাঝামাঝি বিভিন্ন সংস্কার কমিটি এক এক করে প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করবে। তাতে অস্থিরতা বাড়বে বৈ কমবে না। প্রস্তাবগুলো যে গোষ্ঠীরই স্বার্থ সংরক্ষণ করবে না, তারাই রাস্তায় নেমে পড়বে। এ কাজ এখন সবচেয়ে সহজ। কারও জন্য ‘ফরজ’ও বটে। এরপরও সংস্কার কমিটিগুলোর কাজকর্মের তেমন পূর্বাভাস নেই। মনে হচ্ছে, হঠাৎ গ্রিনরুম থেকে বেরিয়ে মঞ্চে ‘নায়ক’ হয়ে যাবে। এমন প্রত্যাশা অবাস্তব।

শ্বেতপত্র কমিটি কী কাজ করছে, তা আগে থেকে অনেকটা ঠাওর করা গেলেও সংস্কার কমিটিগুলো ঠিক উল্টো, যা অস্থিরতার ‘টাইমবোমা’ হতে পারে। অনেক কমিটির সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। পাছে সব সংস্কার ভেস্তে গিয়ে নির্বাচনের বিষয়টি জরুরি হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিটি নির্বাচনকাল বা সরকার বদলের সময় হলেই অস্থিরতা বাড়ে, প্রবৃদ্ধি কমে যায়। প্রথম ১৯৪৩ সাল পোল্যান্ডের অর্থনীতিবিদ মাইকেল ক্যালেকি এই ‘রাজনৈতিক বাণিজ্যচক্র’ ধারণা প্রদান করেন। ১৯৭৫ সালে উইলিয়াম নর্ডাউস যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় এর প্রয়োগ দেখান।

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার উল্লেখযোগ্য বছরগুলো হলো ১৯৭৫, ১৯৮২, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০২ ও ২০০৯। এবারেও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। তাই সব মিলিয়ে ২০২৫ সালটি বাংলাদেশের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের বছর হবে। এরপরও সরকারের দায়িত্ব হবে গ্রিনরুমের জটলা ও মতবিরোধ কমিয়ে শক্ত ও সুস্পষ্ট অবস্থানে আসা। এরপর একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করে প্রবৃদ্ধির ক্ষয় যথাসম্ভব কমিয়ে আনা।

ড. বিরূপাক্ষ পাল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক