সারা দুনিয়াতেই রেল নিরাপদতম যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশে সড়কপথের মতো রেলপথেও জীবন ও সম্পদহানিকর দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। গণমাধ্যমকর্মীদের সংগঠন শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) দেওয়া তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই দেশে ১৩৭টি রেল দুর্ঘটনায় ১৩১ জন নিহত ও ১১০ জন আহত হয়েছেন।
রেলপথে সর্বশেষ মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ২৩ অক্টোবর সোমবার ভৈরবে দুই ট্রেনের সংঘর্ষের কারণে।
এদিন বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আন্তনগর এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেন ও একটি মালবাহী ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষে ১৮ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে যে বিষয়গুলো আলোচিত হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে—মালবাহী ট্রেনের চালক কর্তৃক সিগন্যাল অমান্য করা, ঢাকার লোকোশেডে ইঞ্জিন ঘোরানোর যন্ত্র (টার্ন টেবিল) নষ্ট থাকায় উল্টো ইঞ্জিন চালানোর কারণে ইঞ্জিনের পেছন দিক থেকে সময়মতো সিগন্যাল দেখতে না পাওয়া, মালবাহী ট্রেনের বগির ডিস্ট্রিবিউটর বাল্ব কার্যকর না থাকায় বগির ব্রেক কাজ না করা ইত্যাদি। তবে এর মধ্যে যে কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটুক না কেন, এগুলো সবই প্রতিরোধযোগ্য। ফলে মূল কারণ হলো নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি।
এ ধরনের গাফিলতির কারণে দুটি ট্রেনের সংঘর্ষে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা এর আগেও অনেকবার ঘটেছে। ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মন্দবাগ স্টেশনে অপেক্ষমাণ সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেসকে ধাক্কা দেয় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস। এতে ১৭ জন নিহত ও ৫৪ জন আহত হন। দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে তূর্ণা নিশীথার চালকের গাফিলতিকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, চালক তিনটি সিগন্যাল অমান্য করে স্টেশনে প্রবেশ করে ‘উদয়ন এক্সপ্রেস’কে ধাক্কা দেয়।
এ বিষয়ে ট্রেন চালকদের বক্তব্য হলো, চালক সংকটের কারণে তাঁরা যথাযথ বিশ্রাম না পাওয়ায় অনেক সময় এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো ছিল—ট্রেনের ইঞ্জিনে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, চালকদের শূন্য পদ দ্রুত পূরণ করা, স্টেশন ও ট্রেনের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা চালু করা এবং স্বয়ংক্রিয় ট্রেন থামানোর পদ্ধতি চালু করা। এই সুপারিশগুলোর কোনোটি কি বাস্তবায়িত হয়েছে?
এর আগে ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর নরসিংদীতে গোধূলি ও চট্টলা—এই দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল। কারণ চট্টলার চালক সিগন্যাল অমান্য করেছিল। রেলওয়ের তদন্ত রিপোর্টে তখন বলা হয়েছিল, চালক ভৈরব স্টেশনে চা পান করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় নাকি এ সংকেত অমান্য করার ঘটনাটি ঘটেছিল! (‘চা পানে চালক অজ্ঞান’, প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর ২০১০) চালক অজ্ঞান হোক, ঘুমিয়ে পড়ুক বা অবহেলা করুক, প্রশ্ন হলো, একই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার কেন ঘটবে? এত দিনেও কেন ট্রেন চালনার সময় চালকদের ওপর নজরদারি, স্টেশন ও ট্রেনের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা চালু করা কিংবা স্বয়ংক্রিয় ট্রেন থামানোর ব্যবস্থা চালু করা হলো না?
যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে দুই ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা নিয়মিতই ঘটে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি নীলফামারীর চিলাহাটি রেলস্টেশনে মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনের সঙ্গে রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং ১৬ এপ্রিল কুমিল্লার হাসানপুর স্টেশনে কনটেইনারবাহী মেইল ট্রেনের সঙ্গে সোনার বাংলা এক্সপ্রেসের সংঘর্ষের কথা বলা যায়।
উন্নয়ন বাবদ খরচের একটা বড় অংশ করা হয়েছে নতুন রেললাইন ও স্টেশন ভবন নির্মাণের পেছনে। পুরোনো রেললাইন মেরামত গুরুত্ব পায়নি। পর্যাপ্ত ইঞ্জিন-কোচের ব্যবস্থা না করেই একের পর এক নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও কোচ, পুরোনো ও জীর্ণ রেললাইন ও ঝুঁকিপূর্ণ সেতু, পুরোনো ও ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যাল ব্যবস্থা, অরক্ষিত রেলক্রসিং, অপর্যাপ্ত লোকবল ও যথাযথ নজরদারির অভাবের কারণে রেলের দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।
এ রকম সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য বাংলাদেশে স্বয়ংক্রিয় ট্রেন থামানোর ব্যবস্থার কথা অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, ট্রেনের সংঘর্ষ এড়াতে বাংলাদেশ রেলওয়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রেন নিরাপত্তাব্যবস্থা (এটিপিএস) চালু করার পরিকল্পনা করেছে। এই পরিকল্পনা অনুসারে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি সম্ভাব্যতা জরিপ করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে আর কোনো অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে পদ্ধতিটি বাস্তবায়িত হলে, কোনো লাইনে একাধিক ট্রেন থাকলে বা চালক ভুলে সিগন্যাল অমান্য করলে ট্রেনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে গিয়ে দুই ট্রেনের সংঘর্ষ এড়ানো যাবে।
ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা জাপানের মতো দেশে বহু আগে থেকেই এটিপিএস ব্যবস্থা চালু রয়েছে, এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ২০২০ সাল থেকে এটি চালু হয়েছে। ভারতীয় রেলওয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ডিজাইন অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অর্গানাইজেশন (আরডিএসও) স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘কবচ’ নামের এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা তৈরি করেছে। যাত্রীবাহী ট্রেনে ‘কবচ’-এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয় ২০১৬ সাল থেকে। ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত ভারতীয় রেলওয়ের ১ হাজার ৪৬৫ কিলোমিটার এবং ১২১টি ইঞ্জিন কবচের সুরক্ষার আওতায় এসেছে। এ জন্য কিলোমিটারপ্রতি ৫০ লাখ রুপি এবং ইঞ্জিনপ্রতি ৭০ লাখ রুপি ব্যয় হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশের রেল খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের পরও রেলপথ ঝুঁকিমুক্ত হচ্ছে না। উন্নয়ন বাবদ খরচের একটা বড় অংশ করা হয়েছে নতুন রেললাইন ও স্টেশন ভবন নির্মাণের পেছনে। পুরোনো রেললাইন মেরামত গুরুত্ব পায়নি। পর্যাপ্ত ইঞ্জিন-কোচের ব্যবস্থা না করেই একের পর এক নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও কোচ, পুরোনো ও জীর্ণ রেললাইন ও ঝুঁকিপূর্ণ সেতু, পুরোনো ও ত্রুটিপূর্ণ সিগন্যাল ব্যবস্থা, অরক্ষিত রেলক্রসিং, অপর্যাপ্ত লোকবল ও যথাযথ নজরদারির অভাবের কারণে রেলের দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশে রেল দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে আর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় এক ট্রেনের সঙ্গে অন্য ট্রেনের সংঘর্ষ কিংবা অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষে, নিরাপত্তাব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হলে যা সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
দৃশ্যমান নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি রেলওয়ের বিদ্যমান অবকাঠামো, রেলপথ, সেতু, ইঞ্জিন ও বগির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, রেলওয়ের সিগন্যাল ও নিরাপত্তাব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা না হলে এবং পর্যাপ্তসংখ্যক লোকবল ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে যথাযথ তদারক করা না হলে রেলপথে দুর্ঘটনা ও জীবনহানি বন্ধ করা যাবে না।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
[email protected]