চিন্তা যেখানে ‘অপরাধ’সেখানে চিন্তা-পুলিশেরও বিস্তার ঘটবে

কোনো ডকুমেন্টস রাখবে না বলে বই সরাসরি নিষিদ্ধ না করে মেলায় স্টল না দেওয়া, বইয়ের বড় অনলাইন বিক্রয়কেন্দ্র থেকে সরানো কিংবা প্রকাশনাকে বই প্রত্যাহার করার শর্ত এসেছে।
ছবি : প্রথম আলো

১৯৪৯ সালে প্রকাশিত জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসটি চিন্তাকে অপরাধ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার কর্তৃত্ববাদী ধারণাকে উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করেছে। উপন্যাসটি সামাজিক বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পকাহিনি হলেও, মূলত সতর্কতামূলক। ওশেনিয়া নামের কাল্পনিক এক সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রকে ঘিরে এ উপন্যাসের গল্প। রাষ্ট্রটিতে দেখা যায়, বিগ ব্রাদারের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দল নাগরিকদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করে। নায়ক উইনস্টন স্মিথ সরকারের পক্ষে কাজ করে এবং পরে অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। উইনস্টন সমাজে প্রচারণা এবং দ্বন্দ্ব দেখে মোহভঙ্গ হয় এবং একটি ডায়েরিতে তার চিন্তাভাবনা লিখতে শুরু করে, যদিও বিগ ব্রাদারের চোখে এটি নিষিদ্ধ কাজ। সে জুলিয়া নামের এক রহস্যময় ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করে এবং দুজনের মধ্যে একটি প্রেমের সম্পর্ক শুরু হয়, ফলে উইনস্টনের মধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে আরও ভিন্নমত তৈরি হয়। সে একটি নাশকতামূলক গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত থট পুলিশের দ্বারা বন্দী ও নির্যাতনের শিকার হয়। যতক্ষণ না সে সম্পূর্ণরূপে সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে, ততক্ষণ পর্যন্ত নির্যাতিত হয়।

পুরো উপন্যাসে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও কারসাজির হাতিয়ার হিসেবে ভাষার বিশেষ ব্যবহার একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। জর্জ তাঁর উপন্যাসে ‘ডাবল থিংক’ এবং ‘নিউজ স্পিক’ ধারণা চালু করেছেন, যেখানে নাগরিকদের চাপিয়ে দেওয়া পরস্পরবিরোধী ধারণাগুলোকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয় এবং ভিন্নমত প্রতিরোধে ভাষাকে কৌশল হিসেবে নেওয়া হয়। উপন্যাসটি টোটালিটারিয়ান বা কর্তৃত্ববাদী সরকারের সর্বগ্রাসিতার বিপদ এবং জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করতে ভাষা ও তথ্যের চরম অপব্যবহার সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক ভাষ্য দাঁড় করিয়েছে। এটি সর্বগ্রাসীবাদের উত্থান এবং সরকারি নজরদারি ও কারসাজির বিপদের বিরুদ্ধে একটি সতর্কতা হিসেবে আধুনিক সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক আবেদন রেখে চলেছে।

‘১৯৮৪’ উপন্যাসের থিম আজও প্রাসঙ্গিক বহু দেশে, দেশের এজেন্সিগুলোর জন্য, বিশেষ করে সরকারি নজরদারি এবং তথ্যের অপব্যবহার ও হেরফের সংক্রান্ত বিষয়ে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার বিপদের কালে ব্যক্তি তার নিরাপত্তার মায়ায় স্বাধীনতা ত্যাগ করে এবং এই স্বাধীনতা ত্যাগের পরিণতি সম্পর্কে উপন্যাসটি একটি সতর্কতামূলক গল্প হিসেবে বেশ আলোচিত।

সরকারপন্থী প্রকাশক ও বুদ্ধিজীবীদের ইন্ধনে বাংলা একাডেমিকে চাপ দিয়ে আদর্শ প্রকাশনীর স্টল বরাদ্দ বন্ধ করা হয়েছিল। আপিল করে আদর্শের পক্ষে উচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ও স্থগিত করা হয়েছে। চিন্তাকে অপরাধ হিসেবে দেখিয়ে পুলিশ ও আদালতকে ব্যবহারের নজির আরও আছে। পাশাপাশি আছে সরকারি নজরদারি, গোয়েন্দাগিরি, হয়রানি, ভিন্নমত দমনের সব কলা কানুন। নতুন যে তথ্য সুরক্ষা আইনের খসড়া, সেখানে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আওতামুক্ত রাখা হয়েছে, অর্থাৎ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসের মতোই এজেন্সি এখানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার আইন লঙ্ঘন করবে।

প্রশ্ন হচ্ছে, জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসটির প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কতটুকু? বাংলাদেশে অতীতের প্রায় সব সরকারই ক্ষমতা নিশ্চিত রাখতে কম-বেশি বলপ্রয়োগ করেছে। তবে ২০১৪ থেকে এখানে চলছে ভিন্ন ধরনের এক শাসনব্যবস্থা। বাংলাদেশে ২০১১ সালে নির্বাচনকালীন ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিশ্চিত করা হয়। ২০১৪ সালে একটি একদলীয় জাতীয় নির্বাচন দেখেছি, যেখানে ভোটের আগেই সরকার গঠনের উপযোগী আসনে সরকারি দলের জয় নিশ্চিত হয়েছে।

২০১৮ সালে দিনের ভোট আগের রাতেই হয়ে গেছে বলে নানাভাবে আমরা জানতে পারি। বিরোধীরা কোনো এক অলৌকিক কারণে আন্দোলন করতে পারে না, আন্দোলন ও নির্বাচনের সঙ্গে আদালতের জামিন নামঞ্জুরের একটা সম্পর্ক দেখা যায়, বিরোধী নেতাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, আয়কর ফাইল ও আর্থিক বিবরণীতে নজরদারিরও সংযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, ব্যাংক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ‘শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায়’ হস্তান্তর, দখল হয়েছে কিংবা বন্ধ হয়েছে।

সরকারের রয়েছে শক্তিশালী আড়ি পাতার নেটওয়ার্ক, গোয়েন্দা নজরদারি প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিগ ডেটা প্রসেসিং সফটওয়্যার। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে নিয়মিত গ্রেপ্তার হচ্ছেন বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী এবং সাংবাদিক। এই আইনে গ্রেপ্তার লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু হয়েছে কারাগারেই। ‘আর্টিকেল নাইনটিন’ শুধু ২০২১ সালের উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ওই বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছে মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে। এর অর্থ দাঁড়ায়, শীর্ষ নেতৃত্ব অর্থাৎ বিগ ব্রাদারের বিরুদ্ধে কিছুই বলা যাবে না!

বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার লম্বা তালিকা রয়েছে। হংকংভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসাবে, ২০০৯ সালে থেকে, অর্থাৎ বর্তমান আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬১৯ জন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটকের পর লাপাত্তা হয়েছেন। এ সময় কমপক্ষে ২ হাজার ৬৫৮ জনকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের এলিট ফোর্স র‍্যাবের ওপর দুটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসে।

আরও পড়ুন

২০২৩ সালে শুরু হয়েছে ভিন্নমত ও বাক্‌স্বাধীনতা দমনের নতুন কৌশল। জানুয়ারিতে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন, ‘ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটরিংয়ের (নজরদারি) মাধ্যমে দেশ ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে এনটিএমসিতে (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির (ওএসআইএনটি) মতো আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে। একই সঙ্গে একটি ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম (আইনসম্মতভাবে মুঠোফোন ও ইন্টারনেট মাধ্যমে যোগাযোগে আড়ি পাতার ব্যবস্থা) চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

২০২৩ সালে তিনটি বই প্রকাশের দায়ে বাংলাদেশে একটি অন্যতম শীর্ষ পুস্তক প্রকাশককে একুশে বইমেলায় নিষিদ্ধ করা হয়। একটি বইতে সরকারের চাপিয়ে দেওয়া জাতিবাদী জাতীয়তাবাদের সমালোচনা আছে। অন্য দুটি বই গবেষণা ও একাডেমিক ধারার উন্নয়ন ও নীতি সমালোচনাকেন্দ্রিক। সরকার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কয়েক বছর ধরেই প্রতিকূল সময় পার করছে। সেখানে প্রকাশিত পুস্তকের বিরুদ্ধে এমন কঠোর সেন্সরশিপ সরকারের জন্য বিপদের। কোনো ডকুমেন্টস রাখবে না বলে বই সরাসরি নিষিদ্ধ না করে মেলায় স্টল না দেওয়া, বইয়ের বড় অনলাইন বিক্রয়কেন্দ্র থেকে সরানো কিংবা প্রকাশনাকে বই প্রত্যাহার করার শর্ত এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, এর মাধ্যমে একই ধারার নতুন লেখক-সমালোচক তৈরির পথ বন্ধের উদ্দেশ্য আছে কি?

অপরাপর প্রকাশকদের সরকার ও উন্নয়ন সমালোচনাধর্মী বই প্রকাশ বন্ধের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে কি? বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে পত্রিকার বিজ্ঞাপন বন্ধ করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তির্যক মন্তব্যকারক কিংবা সমালোচক লেখকদের চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ জমা দেওয়ার প্রমাণ রয়েছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অধ্যয়নকেন্দ্রে সরকারি বরাদ্দ কমিয়েছে। খোদ মন্ত্রীপর্যায় থেকে প্রবাসী সমালোচনাকারীদের পাসপোর্ট বাতিল, নিয়োগদাতাকে দিয়ে ভিসা বাতিলের হুমকি এসেছে (১৩ জানুয়ারি ২০২২ প্রথম আলো)।

সরকারপন্থী প্রকাশক ও বুদ্ধিজীবীদের ইন্ধনে বাংলা একাডেমিকে চাপ দিয়ে আদর্শ প্রকাশনীর স্টল বরাদ্দ বন্ধ করা হয়েছিল। আপিল করে আদর্শের পক্ষে উচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ও স্থগিত করা হয়েছে। চিন্তাকে অপরাধ হিসেবে দেখিয়ে পুলিশ ও আদালতকে ব্যবহারের নজির আরও আছে। পাশাপাশি আছে সরকারি নজরদারি, গোয়েন্দাগিরি, হয়রানি, ভিন্নমত দমনের সব কলা কানুন। নতুন যে তথ্য সুরক্ষা আইনের খসড়া, সেখানে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আওতামুক্ত রাখা হয়েছে, অর্থাৎ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসের মতোই এজেন্সি এখানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার আইন লঙ্ঘন করবে।

আরও পড়ুন

শুধু তা-ই নয়, অরওয়েলের উপন্যাসের মতো এখানেও একইভাবে ভাষাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন, সংবিধানসম্মত নির্বাচন, দেশপ্রেম ও ভাবমূর্তি, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন’, ‘বিকল্প কে?’, ‘ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুন’এসব প্রপঞ্চ ও বয়ান দিয়ে খারিজ করা হচ্ছে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যেকোনো উদ্যোগ ও আন্দোলনকে, সুশাসনের প্রয়োজনীয়তাকে। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারহীনতাকে সমর্থন করা হচ্ছে, ‘তাতে কী! উন্নয়ন তো হচ্ছে’।

সরকারের সব গণবিরোধী কাজকে ‘উন্নয়ন’-এর ভাষ্যে মাপা হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পের ভুল এবং যৌক্তিক সমালোচনাও এখানে ভিন্নমত কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহের মতো অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এসব কারণে মামলা-হামলা-জেল-জরিমানাও হচ্ছে। সব মিলে, জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ যেন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে শুরু করেছে। সরকার তার জবাবদিহিহীন ক্ষমতা নিশ্চিত করতে চিন্তাকে অপরাধ গণ্য করে চিন্তা পুলিশ ধারণার বিস্তৃতি ঘটিয়েছে।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য।
[email protected]