আমাদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। একদিকে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়, অন্যদিকে হঠাৎ অতিবৃষ্টি আর উজানের পানিতে সৃষ্ট বন্য। এ রকম বহুমুখী জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের। যার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে স্বাভাবিক জীবনযাপনে, খাদ্য উৎপাদনে ও অর্থনীতিতে।
বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে নানা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বলছে, বঙ্গোপসাগরে পানির তাপমাত্রা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার পৃথিবীর অন্য সব সাগরের তুলনায় বেশি। আমাদের রয়েছে দীর্ঘ ৬৫৪ কিলোমিটার উপকূল, বড় বড় সব নদীর মোহনা ও পাড়সহ হিসাব করলে এটা ১ হাজার ৩২০ কিলোমিটারের বেশি।
বেশির ভাগ উপকূলে টেকসই বাঁধ নেই। এমন নয় যে উপকূল রক্ষায় সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে শুধু বাঁধ নির্মাণে আর মেরামতে। কিন্তু উপকূলের মানুষের হাহাকার দিন দিন বেড়েই চলেছে। উপকূলে মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে নিয়মিত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অনেক লেখালেখি হচ্ছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির এই যুগে যখন পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন আর সমস্যার সমাধানকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, এই সময় টেকসই বাঁধ বলতে কী হতে পারে। এখনো আমরা বেশির ভাগ সময় কঠিন সব ইঞ্জিনিয়ারিংকে টেকসই বলে মনে করি। যেমন কংক্রিটের ব্লক বা ওয়াল দিয়ে উঁচু করে বেড়িবাঁধ, জিও ব্যাগ দিয়ে বেড়িবাঁধ রক্ষা ইত্যাদি।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের একটা উপকূলীয় এলাকায় আমার জন্ম। সমুদ্রের ভাঙন ও উপকূলের মানুষের হাহাকার দেখে দেখে বড় হয়েছি। পরিবেশবান্ধব–পদ্ধতি ব্যবহার করে বাঁধকে সুরক্ষিত করা না হলে বেড়িবাঁধকে দুর্বল বা ভেঙে ফেলা সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের জন্য কোনো ব্যাপার না, যা আমরা প্রতিনিয়ত কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন উপকূলে দেখছি।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে কীভাবে সুন্দরবন আমাদের বাঁচায়, তা গত মে মাসে দেখেছি যখন সাইক্লোন রেমাল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ভয়াবহভাবে আঘাত করেছিল। চলমান ঘূর্ণিঝড় দানা খবরে আসছে ভারতের ওডিশা-পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হেনেছে। কিন্তু সমুদ্রের ভাঙন ও ক্ষয় থেকে বাঁচার পরিবেশবান্ধব বা নেচার বেজড কী কী সমাধান আছে? উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্র সৈকতে ঝাউগাছ ও সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট উপকূল রক্ষায় ভূমিকা রেখে আসছে, যা আমরা সবাই জানি।
উপকূল রক্ষায় এ রকমই একটা ক্ষুদ্র কিন্তু শক্তিশালী উদ্ভিদ হচ্ছে সি-গ্রাস বা সামুদ্রিক ঘাস, যা উপকূলের অগভীর লবণ পানিতে বা ইন্টারটাইডাল জোনে জন্মায়। সামুদ্রিক ঘাসের অনেক প্রজাতি বা ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে একটা সল্ট মার্স, যা জোয়ার এলাকায় বা উপকূলের যেসব জায়গা জোয়ারের পানিতে নিয়মিত তলিয়ে যায়, সেখানে জন্মায়। সামুদ্রিক ঘাসের আরও কিছু প্রজাতি আছে, যেগুলো সব সময় উপকূলের অগভীর পানিতে থাকে।
সামুদ্রিক ঘাস ও প্যারাবন এখন যেভাবে হারিয়ে যাওয়া এলাকা পুনরুদ্ধার করে চলছে, এটা একটা অসাধারণ উদাহরণ যে উপকূল রক্ষায় প্রচলিত যেসব কার্যকর সমাধান প্রয়োগ করা হয় সেসবের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব এই সল্যুশান বাঁধ রক্ষা, উপকূলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনতে অনেক বেশি কার্যকর।
বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবিলায় উপকূলের তিনটি উদ্ভিদের দিকে গবেষকেরা এখন অপার সম্ভাবনা দেখছেন ও মনোযোগ দিচ্ছেন। ম্যানগ্রোভ, সল্ট মার্স ও সি-গ্রাস। কারণ, এরা শুধু উপকূল ও উপকূলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে তা নয়, এগুলোর রয়েছে পরিবেশ থেকে কার্বন শোষণ করার অতুলনীয় ক্ষমতা। গবেষণা বলছে, সাধারণ বনাঞ্চল থেকে এগুলোর রয়েছে অন্ততপক্ষে পাঁচ গুণ বেশি পরিবেশ থেকে কার্বন শোষণের ক্ষমতা। তা ছাড়া এই ঘাস ম্যানগ্রোভের জন্য বীজতলাস্বরূপ।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপকূলের রত্নপুর পয়েন্টে সল্ট মার্স বা উপকূলের সামুদ্রিক ঘাস যেভাবে পুরো উপকূলের চেহারা বদলে দিচ্ছে, তা সত্যি অবাক করার মতো। বছর দশেক আগেও ওখানে সমুদ্রের ভাঙনের ফলে ঝাউবন থেকে শুরু করে খেতের ও ফসলের অনেক জমি সমুদ্রে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। বড় বড় সব বালুর পাহাড়সহ মাছ ঘোনার অনেক জমি সমুদ্র কেঁড়ে নিয়েছে।
সামুদ্রিক ঘাস ও প্যারাবন এখন যেভাবে হারিয়ে যাওয়া এলাকা পুনরুদ্ধার করে চলছে, এটা একটা অসাধারণ উদাহরণ যে উপকূল রক্ষায় প্রচলিত যেসব কার্যকর সমাধান প্রয়োগ করা হয় সেসবের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব এই সল্যুশান বাঁধ রক্ষা, উপকূলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনতে অনেক বেশি কার্যকর।
বাঁশখালী উপকূলের এই ঘাস, প্যারাবন ও আরও ওপরে ঝাউবন বিকশিত হওয়ার পেছনে বন বিভাগের পাশাপাশি এলাকার শিক্ষিত সচেতন অনেক ব্যক্তিদের রয়েছে সক্রিয় ভূমিকা। এসবের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে নিজের গোত্রের লোকজনের শত্রু হয়েছেন এমন উদাহরণও আছে।
উল্লেখ্য, পরিবেশবান্ধব এসব পদক্ষেপ সাফল্যের মুখ দেখে না যদি স্থানীয় মানুষ এটার গুরুত্ব না বোঝে ও সম্পৃক্ত করা না যায়। বাঁশখালী উপকূলে এই ঘাসের অস্তিত্ব নতুন নয়, অনেক আগে থেকেই সেখানে হালকা পরিসরে এই ঘাস ছিল, কিন্তু তা নানা কারণে বৃদ্ধি পায়নি। অন্যতম প্রধান কারণ ওই এলাকার বাসিন্দারা এগুলোর উপকারিতা ও বৃদ্ধির জন্য ঐক্যবদ্ধ ছিল না।
বাঁশখালী উপকূলের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রায় ৩-৪ কিলোমিটার জোয়ার ভূমি আছে সেখানে। দেশের আরও অনেক উপকূলীয় এলাকায় এ রকম আছে। কয়েক বছর আগেও বাঁশখালীতে সমুদ্রের ভাঙনের কারণে হাজার হাজার মানুষ নিজের ভিটেমাটি হারিয়েছেন। এখনো অনেক এলাকা অরক্ষিত। প্রতি বর্ষায় উপকূলের মানুষের দিন কাটে নানা উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায়।
উপকূলের বাঁধ ও পরিবেশ রক্ষায় এই ঘাস ইতিমধ্যে বাঁশখালী উপকূলের একটি অংশের চেহারা বদলে দিয়েছে। বাঁশখালীতে এই ঘাস যে উদাহরণ সৃষ্টি করছে, তা জলবায়ু পরিবর্তনের এই দিনে গবেষণার ও পরে অন্য এলাকায় প্রয়োগের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে। এই ঘাস অনেক সংবেদনশীল, তাই এই ঘাসকে বাছাতে মানুষের অতিরিক্ত চলাফেরা, কাটা ও পর্যটকের অবাধ ঘোরাঘুরি কমাতে প্রশাসনের সুদৃষ্টি জরুরি।
পাশাপাশি উপকূলবাসীর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করা ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোকাবিলা করার জন্য উৎসাহিত করার অনেক কাজ এখনো বাকি। প্রতিটি এলাকায় একটা শিক্ষিত যুবসমাজ গড়ে উঠেছে, যারা নিজ নিজ এলাকায় ভূমিকা রাখতে পারে। সে জন্য দরকার এলাকার সামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা। দেশীয় ও বিদেশি সংস্থাগুলো বাঁশখালীর মতো অবহেলিত উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে সামাজিক সংগঠনগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে।
পারভেজ উদ্দিন চৌধুরী উন্নয়নকর্মী ও লেখক