৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এখনো থামেনি। এরই মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে কথা-বার্তা শুরু হয়েছে। আগামী মার্চ থেকে কয়েক ধাপে উপজেলা নির্বাচন করতে চায় নির্বাচন কমিশন—সংবাদমাধ্যমে এমন খবর এসেছে।
এরপর গত সোমবার (২২ জানুয়ারি) এক জরুরি বৈঠক করে উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় দলীয়ভাবে মনোনয়ন (নৌকা প্রতীক) না দেওয়ার কথা জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। (প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০২৪)
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো আগে নির্দলীয়ভাবে বা দলীয় প্রতীক ছাড়াই হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ২০১৫ সালে এটা পরিবর্তন করা হয়। এরপর থেকে এ নির্বাচনগুলো দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাহলে আওয়ামী লীগ কেন এবার দলীয়ভাবে মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল? ক্ষমতাসীনদের এ সিদ্ধান্ত কি এটাই প্রমাণ করে, দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি ‘ভুল’ ছিল?
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের পর টানা দ্বিতীয় দফা সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ।
এরপর দলটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। পরে দলটির শীর্ষ নেতাও এ বিষয়ে সায় দেন। (স্থানীয় নির্বাচনও দলীয়ভাবে চান শেখ হাসিনা, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ১ এপ্রিল ২০১৫)
দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি শুরু থেকেই বিতর্ক তৈরি করেছিল। সেই সময় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল, বিশ্বের সব উন্নত দেশে দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়। তাই বাংলাদেশেও তেমনটা হওয়া উচিত। অপরদিকে বিএনপিসহ বেশ কিছু বিরোধী দল এর বিরোধিতা করেছিল। তাদের মতে এটা ছিল, ‘দুরভিসন্ধিমূলক’ এবং সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিজ দলীয় নেতাদের জিতিয়ে আনার একটি কৌশল।
শুধু বিরোধী দলগুলো নয়, বেশ কিছু নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে নানারকম আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল; কিন্তু বিরোধী দল বা নাগরিক সমাজ—কারও কথাই তখন পাত্তা দেওয়া হয়নি। দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য আইন সংশোধন করা হয়।
এরপর ২০১৫-১৬ ও ২০২০ সালে পৌরসভা, ২০১৬ ও ২০২১-২২ সালে ইউনিয়ন পরিষদ, ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ এবং বিভিন্ন সময়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়। এসব প্রতিটি নির্বাচনই দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে অনেকগুলো নির্বাচনে বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেয়নি।
দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর এর পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন তৎকালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেছিলেন, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলে সংঘাত-সহিংসতা বন্ধ হবে। (স্থানীয় নির্বাচনে মারামারি এবার হবেই না: মন্ত্রী, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৪ অক্টোবর ২০১৫)।
বাস্তবে ঘটে উল্টোটা। ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নজিরবিহীন সহিংসতা হয়। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী নির্বাচনী সহিংসতায় প্রায় ১৫০ জন নিহত হন।
সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনে সহিংসতা খুব বেশি না হলেও নানারকম অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, সরকার দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ। এসবের ফল হিসেবে এ নির্বাচনগুলোতে প্রার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় কম দেখা যায় এবং বেশ কিছু জায়গায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে জয়ী হন মূলত ক্ষমতাসীন দলের দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীরা। ফলে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোও হয়ে পড়ে ‘একতরফা’।
২০১৪ সালের একতরফা জাতীয় নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো, ২০২৪ সালে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের পর দলটি কেন তাদের অবস্থান পরিবর্তন করল?
৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অভিযোগগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি আওয়ামী লীগ। কিন্তু এ নির্বাচনের পরপরই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে দলটির বাস্তবসম্মত ‘আশঙ্কা’ তৈরি হয়েছে এবং এতে তাঁরা তাদের কৌশলে পরিবর্তন এনেছে। এটা কি ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে ওঠা প্রশ্ন ও অভিযোগগুলোর অনানুষ্ঠানিক ‘স্বীকৃতি’?
এবারের জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘ডামি প্রার্থী’ কৌশল অবলম্বন করেছিল।
এই ‘ডামি প্রার্থী’ কৌশলের ফল হিসেবে অনেক স্থানেই দলের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। নিজেদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনেও সংঘাত-সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হন। দলটির তৃণমূল পর্যায়ে বিরোধ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
গত সোমবার আওয়ামী লীগের জরুরি বৈঠকে দলটির নেতারা এই দলীয় বিরোধ নিয়ে আলোচনা করেন। ‘তাঁদের বক্তব্যের সারমর্ম হলো, কদিন আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় তৃণমূলে বিভেদ তৈরি হয়েছে। এখন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে একজনকে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দিলে অন্যরা স্বতন্ত্র ভোট করবে। এতে বিভেদ আরও বাড়বে।’ (উপজেলাসহ স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে নৌকা দেবে না আওয়ামী লীগ, প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০২৪)
শুধু দলীয় কোন্দল বা বিরোধ সামাল দেওয়া নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো বা নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করাও আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য। সোমবারের ওই বৈঠকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী একই রকম কথা বলেন। ‘তিনি বলেন, আপাতত স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে দলীয়ভাবে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। এতে ভোট উৎসবমুখর ও অংশগ্রহণমূলক হবে।’ (প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি ২০২৪)
লক্ষণীয়, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ৪১ দশমিক ৮০ ভাগ বলা হলেও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। (ভোটের হার নিয়ে সন্দেহ, প্রশ্ন, প্রথম আলো ৯ জানুয়ারি ২০২৪)। শুধু বিরোধী দলগুলো নয়, এ নির্বাচনে অংশ নেওয়া বেশ কিছু দল ও প্রার্থীর পাশাপাশি দেশি-বিদেশি গবেষকরাও ভোটার উপস্থিতি নিয়ে এ প্রশ্ন ও নানারকম অভিযোগ তুলেছেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অভিযোগগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি আওয়ামী লীগ। কিন্তু এ নির্বাচনের পরপরই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে দলটির বাস্তবসম্মত ‘আশঙ্কা’ তৈরি হয়েছে এবং এতে তাঁরা তাদের কৌশলে পরিবর্তন এনেছে। এটা কি ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে ওঠা প্রশ্ন ও অভিযোগগুলোর অনানুষ্ঠানিক ‘স্বীকৃতি’?
পরপর তিনটি (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে দুটি (২০১৪ ও ২০২৪) একতরফা এবং আরেকটি (২০১৮) প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হয়েছে। যাদেরকে উপলক্ষ করে এই নির্বাচন, সেই ভোটাররা ভোটদানে আগ্রহ অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। যেনতেনভাবে জয়লাভ করাই নির্বাচনী সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে শুধু কৌশল পাল্টিয়েই ক্ষমতাসীনেরা এ নির্বাচনী সংস্কৃতির পরিবর্তন করবেন, এমন আশা কতটা বাস্তবসম্মত?
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলো’র জেষ্ঠ্য সহ-সম্পাদক