সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আসন্ন হুমকি ও উত্তরণের উপায় কী

টিকাদানকেন্দ্রগুলোতে সঠিকভাবে কোল্ড–চেইন, বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা, ইপিআই শিডিউল মেনে টিকাদান করা হচ্ছে কি না, এসব ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায়।ফাইল ছবি

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বাংলাদেশ সরকারের সফল উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি বিশ্বের প্রতিটি শিশুর জন্য টিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে ইপিআইয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এবং ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে বাংলাদেশে ইপিআই কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।

পরে ১৯৮৫ সালে ইপিআই কার্যক্রম সারা দেশে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং জাতিসংঘের কাছে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের প্রতিটি শিশুর জন্য টিকা নিশ্চিতকরণে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। ঢাকা শহরে ইপিআই কার্যক্রম ১৯৮৯ সালে প্রাথমিকভাবে যাত্রা করে এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিভাগীয় শহরে বিস্তৃত কর হয়। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় গত ৪৫ বছরে বাংলাদেশ টিকাদান কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে এবং ভ্যাকসিন-প্রতিরোধযোগ্য রোগ (ভিপিডি) নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণেও যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করতে সামর্থ্য হয়।

ইপিআই কাভারেজ ইভাল্যুয়েশন সার্ভে ২০১৯–এর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় বাংলাদেশে ১৯৮৪ সালে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির কভারেজ ছিল ২ শতাংশের নিচে, যা বর্তমানে ৮৩.৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তবে গ্রাম–শহরনির্বিশেষে কাভারেজের ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। ২০১৯ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় শহরাঞ্চলে পূর্ণ ভ্যাকসিন কাভারেজ ৭৯.২  শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে তা ছিল ৮৫ শতাংশ। তবে বিভাগগুলোর মধ্যে বরিশালে কাভারেজ ছিল সবচেয়ে বেশি (৯১.৮%) এবং সবচেয়ে কম ছিল ময়মনসিংহ বিভাগে (৮০.৪%)। সিটি করপোরেশন ভিন্নতায় কভারেজের তারতম্য দেখা যায় যেখানে রাজশাহী সিটি করপোরেশনে কাভারেজ সব থেকে বেশি (৯২.৪%) এবং সিলেট সিটি করপোরেশনে কাভারেজ সব থেকে কম (৬৩.৮%) পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন পৌরসভায় ফুল ভ্যাকসিন কাভারেজ ৮২.৯ শতাংশ যা জাতীয় কাভারেজের তুলনায় কম (কাভারেজ ইভাল্যুয়েশন সার্ভে- ২০১৯)।  

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নব্বইয়ের দশকে টিকা গ্রহণের ব্যাপ্তির তুলনায় গত ১৫ বছরের ব্যাপ্তি অনেক কম, পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০১০ সালে কাভারেজ ছিল ৭৯.৪ শতাংশ, যা ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৮৩.৯ শতাংশ, অগ্রগতি মাত্র ৪.৫ শতাংশ (ইপিআই, ডিজিএইচএস, কাভারেজ ইভাল্যুয়েশন সার্ভে ২০১৯, রিপোর্ট ডিসেম্বর ২০২০)। উল্লেখ্য, গত ১২ বছরে ইপিআই কাভারেজ ৮৪%–এর নিচে অবস্থান করছে এবং ১৬% শিশু টিকা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।  

টিকাদান কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো রোগপ্রতিরোধের মাধ্যমে জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি সুস্বাস্থ্যে বলীয়ান বাংলাদেশ গঠন করা। আমরা সবাই মিলে কাজ করলে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে শতভাগ টিকাদানের কাভারেজের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে এবং আমরা সারা বিশ্বের মধ্যে একটি ভ্যাকসিন প্রতিরোধযোগ্য রোগমুক্ত দেশ হিসেবে পরিচিত হব, যা বংলাদেশের মানুষের জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও জীবন রক্ষায় যেমন অবদান রাখবে, তেমনি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে।

ইপিআইয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে ১,৩৪,০০০টি আউটরিচ সেন্টারে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এসব টিকাকেন্দ্র সরকারি, বেসরকারি এবং উন্নয়ন সহযোগীদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। গ্রামে মূলত সরকারি টিকাদান কেন্দ্রের মাধ্যমে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালিত হলেও শহরে সরকারি টিকাদান কেন্দ্রের পাশাপাশি বেসরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, বেসরকারি হসপিটাল এবং এনজিও এর মাধ্যমে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়ে থাকে।

ইপিআই কর্মসূচি প্রবর্তনের আগে বাংলাদেশে ছয়টি প্রধান প্রাণঘাতী রোগে প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ শিশু মারা যেত; কিন্তু বর্তমানে সেই মৃত্যুহার কমেছে ৮১.৫ শতাংশ। ১৯৯০ সালে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর হার ছিল ১৪৬ যা ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৭ জন (ইউএন-আইজিএমই-চাইল্ড মরটালিটি রিপোর্ট-২০২৩)। টিকাদানের মাধ্যমে, বাংলাদেশ ১৯৮৭ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে আনুমানিক ২০ লাখ শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ করেছে এবং আজও প্রতিবছর প্রায় ২ লাখ শিশুমৃত্যু প্রতিরোধ করে চলেছে। টিকাদান এবং শিশু মৃত্যুহার হ্রাসের এই সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ ২০০৯ ও ২০১২ সালে  গ্যাভির ‘বেস্ট পারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন করে। এ ছাড়া টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (গ্যাভি) ২০১৯ সালে বাংলাদেশকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পদকেও ভূষিত করে।

বাংলাদেশে ইপিআইয়ের আওতায় ১০টি টিকা বিনা মূল্যে দেওয়া হয়, যেমন যক্ষ্মা (টিবি), ডিফথেরিয়া, হুপিংকাশি (পারটুসিস), ধনুষ্টংকার (টিটেনাস), হেপাটাইটিস বি, হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা বি, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া, পোলিও, হাম ও রুবেলা। ইপিআইয়ের জন্মলগ্নে ৬টি টিকার মধ্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু হলে ও গত কয়েক বছরে ভ্যাকসিন শিডিউলে আরও বেশ কিছু নতুন টিকা যোগ করা হয়েছে, ২০০৩ সালে হেপাটাইটিস বি, ২০০৯ সালে এইচআইবি, ২০১২ সালে রুবেলা ২০১৫ সালে পিসিভি এবং আইপিভি, এমআর দ্বিতীয় ডোজ ২০১৫ সালে এবং ২০১৭ সালে এফআইপিভি উল্লেখযোগ্য।

সম্প্রতি ২০১৬ সালে এইচপিভি ভ্যাকসিনের পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় এবং ২ অক্টোবর ২০২৩ সালে সফলভাবে এইচপিভি ভ্যাকসিন বাংলাদেশে চালু করা হয়েছে, যা মেয়েদের জরায়ু ক্যানসার প্রতিরোধে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ২০২৩ সালে এইচপিভি টিকাদান ঢাকা বিভাগে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং ২০২৪ সালের মধ্যে সারা দেশে একযোগে টিকাদান ক্যাম্পেইন পরিচালনা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এরপর এইচপিভি ভ্যাকসিনকে ২০২৫ সাল থেকে ইপিআই শিডিউলের আওতাভুক্ত করা হবে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে ইপিআই শিডিউলে আরও বেশ কয়েকটি নতুন টিকা যুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তার মধ্যে ডায়রিয়া নির্মূলে রোটাভাইরাসের টিকা, মস্তিষ্ক প্রদাহজনিত হলুদ জ্বর ঠেকাতে জাপানি এনসেফেলাইটিস টিকা এবং পানিবাহিত রোগ টাইফয়েড ঠেকাতে টাইফয়েড কনজুগেট টিকা (টিসিভি) উল্লেখযোগ্য।

সম্প্রতি ইউনিসেফ, ইপিআই এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই)–এর প্রতিবন্ধকতা এবং উত্তরণের উপায়সমূহ নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। সেখানে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় বাংলাদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে টিকা কার্যক্রমে জনবলের ঘাটতি, অঞ্চল ভিত্তিতে টিকাকেন্দ্রের অসম বণ্টন, অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, টিকার অপর্যাপ্ততা, টিকাদানকর্মীদের প্রশিক্ষণের অভাব, দুর্গম এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় টিকা পরিবহনজনিত সমস্যা, টিকাদান সম্পর্কিত প্রচারণার অভাব ইত্যাদি।

গবেষণা প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে মন্ত্রণালয়ের অধীন শহর ও গ্রামে টিকাদান প্রকল্পে বরাদ্দকৃত জনবলের মধ্যে ৫৭.৩৭ শতাংশ পদ এখনো শূন্য রয়েছে, যা ১৭,৯৪২ জন। বরাদ্দকৃত জনসংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় কম, কারণ আরবান ইমিউনাইজেশন স্ট্র্যাটেজি-২০১৯ এবং ইপিআই মাইক্রো প্ল্যান-২০২৪ অনুসারে প্রতি ৫০ হাজার জনসংখ্যার জন্য ৬ জন টিকাদানকর্মী প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। তা ছাড়া জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুসারে টিকাদানকেন্দ্রের অসম বণ্টন লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে দুর্গম এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যে সংখ্যায় টিকাদানকেন্দ্র থাকা দরকার, সেসংখ্যক টিকাদানকেন্দ্র নেই।

ইপিআই প্রকল্পে অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, আন্তর্জাতিক অর্থায়ন এবং এনজিও পরিষেবার ওপর অত্যধিক নির্ভরতা টিকাদানে উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অন্তরায়। আগামী ২০২৯ সালের পর গ্যাভি (GAVI) টিকাদান প্রকল্পে সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে সরকারকে নিজস্ব অর্থায়নে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করতে হবে। শহর থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ভ্যাকসিনের অপর্যাপ্ততা টিকাদানের লক্ষ্য অর্জনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। ইপিআইয়ের সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে অক্টোবর ২০২৪ সাল পর্যন্ত টিকায় বাজেট বরাদ্দ থাকলেও বিশেষ কিছু অ্যান্টিজেন যেমন পিসিভি, ওপিভি এবং এমআর টিকার সংকট দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া এমআর টিকা অক্টোবর ২০২৪ পর্যন্ত, বিসিজি ও ওপিভি টিকা নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত, টিডি ও পেনটা টিকা ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত, আইপিভি টিকা জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত এবং পিসিভি টিকা মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত বরাদ্দ আছে।

তা ছাড়া অক্টোবর ২০২৪ সালের পর টিকায় সরকারি বরাদ্দ নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও সময়মতো টিকা এসে পৌঁছাবে কি না, সে বিষয় অনিশ্চিত। টিকাদানকর্মীদের নিয়োগের পর টিকাদান বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও রিফ্রেশার প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তা ছাড়া সারা দেশে শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে টিকাদানকেন্দ্র পরিদর্শন, টিকাদান পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে সঠিক পদ্ধতিতে টিকাদান পরিচালনা হচ্ছে কি না, টিকাদানকেন্দ্রগুলোতে সঠিকভাবে কোল্ড–চেইন, বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা, ইপিআই শিডিউল মেনে টিকাদান করা হচ্ছে কি না, এসব ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায়। দুর্গম ও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় টিকা পরিবহন একটি বড় সমস্যা।

বিশেষ করে পাহাড়ি, হাওর ও নদীতীরবর্তী এলাকায় যানবাহনের সমস্যা থাকায় সঠিক সময়ে টিকাদানকেন্দ্রে টিকা পরিবহন সম্ভব হয় না। এ ছাড়া আবহাওয়ার (ঝড়, বন্যা, ভূমিধস) জন্যও অনেক সময় টিকা পরিবহনে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বস্তিবাসী, ভাসমান জনগোষ্ঠী, পাহাড়ি, হাওর ও নদীতীরবর্তী এলাকায় টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা অজানা থাকায় জিরো ডোজ এবং মিসড ডোজ শিশুদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। টিকাদান বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিবিষয়ক পদক্ষেপের অভাব, টিকাদানকেন্দ্র নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা রাখা হয়, যা কর্মজীবী মহিলাদের তাঁদের শিশুদের টিকা দিতে না পারার কারণ।

ওপরে উল্লিখিত গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) উচ্চ কাভারেজ নিশ্চিত করা এবং ইপিআই প্রোগ্রামকে আরও বেগবান করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ সুপারিশ বা পরামর্শ তুলে ধরে।

সুপারিশগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন শহর ও গ্রামে টিকাদান প্রকল্পে বরাদ্দকৃত জনবলের মধ্যে যে শূন্যপদ আছে, সেখানে দ্রুত নিয়োগ দেওয়া, জনসংখ্যাভিত্তিক জনবলনীতি অভিযোজন করা, জনসংখ্যার ঘনত্বের ওপর ভিত্তি করে টিকাকেন্দ্রের সুষম বণ্টন, প্রতিটি টিকাদানকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, ভ্যাকসিন সরবরাহ ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা, তা ছাড়া অদূর ভবিষ্যতে ভ্যাকসিনের যে সংকট দেখা দিতে পারে, সে ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া ইপিআই প্রোগ্রাম মনিটরিং এবং মূল্যায়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের অনুপ্রাণিত করে মানসম্পন্ন তত্ত্বাবধান এবং পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচিকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন।

তা ছাড়া ভৌগোলিক এবং আর্থসামাজিক বৈষম্য চিহ্নিত করতে এবং শহুরে টিকাদান নীতিকে শক্তিশালী করার জন্য নিয়মিত মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। টিকাদানের ক্ষেত্রে একটি ডেটাবেজ তৈরি এবং কার্যকর করা, যা জাতীয় কর্মশক্তি পরিকল্পনার জন্য সঠিক তথ্য নিশ্চিত করবে। বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা এবং নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মানুষের মধ্যে টিকাদান নিশ্চিত করার জন্য নির্দিষ্ট কৌশলের পরিকল্পনা (ম্যাপিং, মোবাইল ক্লিনিক, ডোর-টু-ডোর টিকাদান) বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এবং টিকাদানের জন্য সর্বোত্তম বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করার পাশাপাশি অ্যাডভোকেসি, বিকল্প তহবিল উৎসের জন্য নীতি সংস্কার এবং সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্ব নিশ্চিত করাও জরুরি। দুর্গম এবং উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় টিকা পরিবহন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিবহনব্যবস্থা জোরদার করা, পোর্টারদের জন্য পরিবহন বাজেট সংশোধন, কোল্ড-চেইন মেইনটেইন ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করতে হবে। এ ছাড়া টিকাদানে সন্ধ্যাকালীন সেশনের ব্যবস্থা করা, সাপ্তাহিক অবকাশে টিকাদান সেশনের পরিকল্পনা করা জরুরি।  

ইপিআই কর্মসূচিকে বেগবান-এ দাতা সংস্থার অবদান অনস্বীকার্য। ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার বৈশ্বিক জোট গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন ইনিশিয়েটিভ (গ্যাভি) ২০০১ সাল থেকে জাতীয় টিকাদান কার্যক্রমে বাংলাদেশকে সহায়তা করে আসছে। বাংলাদেশের টিকাদান কার্যক্রমে গ্যাভির অর্থায়ন ২০২৬ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ‘বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিং’–এর অনুরোধে তা ২০২৯ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত গ্যাভি বাংলাদেশের সম্প্রসারিত টিকাদান কার্যক্রমে ১.০৯ বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদান করেছে এবং কোভিড-১৯ টিকাদানে ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রদান করেছে। টিকাদান কর্মসূচিকে দীর্ঘস্থায়ী এবং সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় গঠন করতে হবে।  

টিকাদান কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো রোগপ্রতিরোধের মাধ্যমে জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি সুস্বাস্থ্যে বলীয়ান বাংলাদেশ গঠন করা। আমরা সবাই মিলে কাজ করলে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে শতভাগ টিকাদানের কাভারেজের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে এবং আমরা সারা বিশ্বের মধ্যে একটি ভ্যাকসিন প্রতিরোধযোগ্য রোগমুক্ত দেশ হিসেবে পরিচিত হব, যা বংলাদেশের মানুষের জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন ও জীবন রক্ষায় যেমন অবদান রাখবে, তেমনি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে।

  • ডা. নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ
    সিনিয়র জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
    চেয়ারম্যান-গ্যাভি সিএসও স্টিয়ারিং কমিটি
    ই–মেইল: [email protected]