ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ক গত রোববার এক ভিডিও বার্তায় তাঁদের সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা জানান। নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলে তাঁদের তুলে নেওয়া এবং ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থায় তাঁদের দেওয়া বিবৃতি নিয়ে খুব সংগত কারণেই সন্দেহ ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
গত শুক্রবার বিকেলে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের সঙ্গে আবু বাকেরকে তুলে নিয়ে আসেন সাদাপোশাকের একদল ব্যক্তি। পরে ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, তিন সমন্বয়কের নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁদের মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়েছে।
এরপর শনিবার সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে নিজেদের কার্যালয়ে নিয়ে আসে ডিবি। রোববার সকালে আনা হয় নুসরাত তাবাসসুম ও আরিফ সোহেলকে। এঁদের কাউকে ৭২ ঘণ্টা আবার কাউকে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় ডিবির ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ রাখা হয়।
গতকাল (রোববার) সচিবালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ডিবির হেফাজতে নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। পুলিশ যদি মনে করে তাঁরা ঝুঁকিমুক্ত, তখনই তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
আন্দোলনকারীদের এভাবে তুলে নিয়ে এসে ডিবি হেফাজতে রাখার বিষয়টি কতটা আইনসম্মত হয়েছে তা জানতে চেয়েছিলাম সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিকের কাছে। তিনি বলেন, সংবিধানের ৩৩(১) ও ৩৩(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো মামলা বা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করা যায় না। কাউকে গ্রেপ্তার বা আটক করলেও তাঁকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। কিন্তু তাঁদের তো গ্রেপ্তার বা আটক করার কথা বলা হচ্ছে না।
তিনি এর সঙ্গে আরও যুক্ত করেন, ডিবি তাঁদের নিরাপত্তা হেফাজতে রাখার যে দাবি করেছে, সেটা সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ‘নিরাপত্তা হেফাজত’ বলে বাংলাদেশের আইনেও কিছু নেই। অগণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে দমন-পীড়ন চালানোর জন্য এ ধরনের বেআইনি কাজ করা হয়।
ডিবিপ্রধানের এই পোস্ট সম্পর্কে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটনের মন্তব্য জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেন, নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলা হলেও এটা স্পষ্ট যে আন্দোলনের সমন্বয়কদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁদের তুলে নেওয়া হয়েছে। এভাবে তুলে নেওয়া সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনের পাশাপাশি মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের মজুমদারকে এর আগেও একবার তুলে নেওয়া হয়েছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা দাবি আদায়ে সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি দেওয়ার পর ১৯ জুলাই মধ্যরাতে খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া থেকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়। ২১ জুলাই ভোরে পূর্বাচল এলাকায় তাঁকে ফেলে যাওয়া হয়। নাহিদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছিল আঘাতের চিহ্ন। এর পর থেকে তিনি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
অপর দুই সমন্বয়ক আসিফ ও বাকেরকেও ১৯ জুলাই তুলে নেওয়া হয়েছিল। পাঁচ দিন পর ২৪ জুলাই আসিফকে হাতিরঝিল ও বাকেরকে ধানমন্ডি এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়। এর পর থেকে আসিফ ও বাকের গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
রোববার রাতে ছয় সমন্বয়কের ওই ভিডিও বার্তা আসার কিছুক্ষণ আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন।
তাতে লেখা হয়, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই তাঁদের ডিবি কার্যালয়ে এনে কথা বললাম, কী কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁদের কথা শুনে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের নানা পরিকল্পনার কথা জানানোর পর তাঁদের উদ্বেগ দূর হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টিম ডিবি, ডিএমপি বদ্ধপরিকর।’
ডিবিপ্রধানের এই পোস্ট সম্পর্কে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটনের মন্তব্য জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেন, নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলা হলেও এটা স্পষ্ট যে আন্দোলনের সমন্বয়কদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁদের তুলে নেওয়া হয়েছে। এভাবে তুলে নেওয়া সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনের পাশাপাশি মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন।
ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থায় দেওয়া সমন্বয়কদের দেওয়া বিবৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পত্রিকায় খবর অনুসারে নাহিদের মা ডিবি কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে তাঁর ছেলের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন শিক্ষক ডিবি কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। ডিবিপ্রধান তাঁদের সঙ্গেও দেখা করেননি।
এ রকম অবস্থায় ডিবির হেফাজতে থেকে ছয় সমন্বয়কের দেওয়া বিবৃতি নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। তাঁরা স্বেচ্ছায় বিবৃতি দিয়েছেন, নাকি তাঁদের কাছ থেকে জোর করে বা ভয়ভীতি দেখিয়ে তা আদায় করা হয়েছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।’
এরই মধ্যে ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থায় দেওয়া ছয় সমন্বয়কের বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করেছেন কয়েকজন সমন্বয়ক। তাঁরা বলেন, ‘জোর করে ওই বিবৃতি দেওয়ানো হয়েছে। সে কারণে এটি গ্রহণযোগ্য নয়।’ (বিবৃতি প্রত্যাখ্যান আরেক সমন্বয়ক কাদেরের, কালবেলা অনলাইন, ২৯ জুলাই ২০২৪)
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘কথিত আটক’ ছয় সমন্বয়ককে অবিলম্বে মুক্তি দিতে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালাতে নির্দেশনা চেয়ে সোমবার হাইকোর্টে একটি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী। এদিন শুনানি নিয়ে আদালত মঙ্গলবার আদেশের দিন ধার্য করেছেন।
আদালত আদালতের সিদ্ধান্ত দেবেন। কিন্তু আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন, যে অসংগতির কথাগুলো বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকার কি তা আমলে নেবে? নাকি ভবিষ্যতে আবারও কাউকে তুলে নেওয়া হবে, বেআইনিভাবে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ রাখা হবে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের জানা নেই।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক