ঢাকাকে যানজটমুক্ত করতে সরকার উড়ালসেতু, উড়ালসড়ক, মেট্রোরেল, বিআরটিসহ নানা প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর মধ্যে ৯টি উড়ালসড়ক ও সমজাতীয় অবকাঠামো নির্মাণে ১৯ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা, মেট্রোরেল নির্মাণে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা এবং বিআরটি নির্মাণে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
কিন্তু তাতে ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধান হয়নি, উল্টো যানবাহনের গড় গতিবেগ ২০০৭ সালের ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে কমে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ ও ২০২৩ সালে প্রকাশিত প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার–এর বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে এসব তথ্য আমরা পাই।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে ঢাকা। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকাবাসীকে সড়কে প্রতি ২ ঘণ্টায় ৪৬ মিনিট কাটাতে হয় যানজটে বসে। বছরে জনপ্রতি গড়ে ২৭৬ ঘণ্টা নষ্ট হয় যানজটে।
ঢাকার যানজট সমস্যার সমাধান না হওয়ার মূল কারণ হলো গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িবান্ধব ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণে জোর দেওয়া। একটি বাস রাস্তার যতটুকু জায়গা দখল করে অন্তত ৪০ জন মানুষ পরিবহন করে, ততটুকু জায়গা দখল করে দুটি ব্যক্তিগত গাড়িতে হয়তো ৪ থেকে ৫ জন মানুষ যাতায়াত করে। ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের জরিপ অনুসারে, মাত্র ৬ শতাংশ যাত্রী বহন করে রাস্তার ৭৬ শতাংশ জায়গা দখল করে থাকে এসব ব্যক্তিগত গাড়ি। কিন্তু তারপরও ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ের মতো অবকাঠামো নির্মাণে জোর দেওয়া হয়েছে, যেগুলো ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে।
ঢাকার যানজটের সমস্যা নিরসনে নেওয়া সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) বলা হয়েছে, বর্তমানে বাস যেমন যাত্রী চলাচলের প্রধানতম বাহন, ভবিষ্যতেও তা-ই থাকবে। এমনকি সাতটি এমআরটি-বিআরটি তৈরির পরও এগুলো সব মিলিয়ে ২০ শতাংশের বেশি যাত্রী পরিবহন করতে পারবে না। এ কারণে আরএসটিপিতে বাসের মাধ্যমে যাত্রী পরিবহনের ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়েছে এবং এ জন্য তিন থেকে পাঁচটি কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনার কথা বলা হয়েছে।
আমরা দেখছি, একটি এমআরটি ও একটি বিআরটি নির্মাণের কাজ চলছে, কিন্তু বাকিগুলো কবে শুরু হয়ে কবে শেষ হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এদিকে ঢাকার বাসব্যবস্থা ঢেলে সাজানোরও কোনো অগ্রগতি নেই। অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর তিনটি রুটে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে একটি কোম্পানির মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি চালু করা হয়। কিন্তু একই রুটে ব্যক্তিমালিকানাধীন অন্য কোম্পানির বাস চলাচল অব্যাহত থাকায় সড়কে শৃঙ্খলা ফিরছে না। বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজিও সফল হতে পারছে না।
ঢাকায় চলাচলকারী বাসকে গণপরিবহনব্যবস্থা বলা মুশকিল। এসব বাস চলাচলের অনুমোদন থেকে শুরু করে পরিচালনপদ্ধতি, পুরোটাই সমস্যাসংকুল। এখানে কোনো রুটে বাস চালানোর প্রধান যোগ্যতা হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা। ক্ষমতার জোরে প্রভাবশালীরা বাস রুটের অনুমোদন নিয়ে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন বাসমালিককে সেই রুটে বাস চালানোর অনুমোদন দেন। বাসমালিকেরা আবার চুক্তিভিত্তিক পরিবহনশ্রমিকদের হাতে বাস তুলে দেন। দিন শেষে মালিককে দেওয়ার জন্য জমার টাকা, জ্বালানি খরচ, টোল, চাঁদা ও ঘুষের ব্যবস্থা করার পর যা থাকে, তা ভাগাভাগি করে নেন চালক ও তাঁর সহকারী। এই টাকা তোলার জন্য অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, যত্রতত্র থেমে যাত্রী ওঠানামা করা, বাড়তি ভাড়া আদায় থেকে রেষারেষি করে বেপরোয়া গতিতে বাস চালানো—সবই চলে।
ঢাকায় চলা বেশির ভাগ বাস-মিনিবাস রংচটা ও লক্কড়ঝক্কড়। বাসগুলোয় দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে গাদাগাদি করে যেতে হয়। প্রয়োজনের সময় বাস পাওয়া এবং সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। নারী, শিশু ও বয়স্কদের জন্য ঢাকার বাসে চলাচল তো এক বীভৎস অভিজ্ঞতা। ফলে কোনো ব্যক্তির যদি ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার মতো আর্থিক সামর্থ্য তৈরি হয়, তাহলে তিনি তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ যাতায়াতের জন্য তা কিনবেন না কেন? বাস্তবে ঘটছেও তা-ই।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটি) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন গড়ে ৪০টি করে ব্যক্তিগত গাড়ি নামছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার, যা ২০২৩ সালে হয়েছে ৩ লাখ ৩৬ হাজার। এভাবেই হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত ফ্লাইওভার আর এক্সপ্রেসওয়েগুলো ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়ে ভরে গিয়ে ঢাকার গতি আরও কমেছে। যেমন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে প্রায় শতভাগই ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে এবং এসব গাড়ি দ্রুতগতিতে ঢাকার উত্তরাংশ থেকে ফার্মগেটে এসে নামার কারণে ফার্মগেট হয়ে গেছে ঢাকার যানজটের নতুন কেন্দ্র।
জাইকার এক সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকায় দরকারি যাতায়াত বা কাজে যাওয়ার জন্য ৬০ শতাংশ মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করে। এর ৬৭ শতাংশের বাহন বাস-মিনিবাস। ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থা ঠিক করতে হলে তাই প্রথম বাস ও মিনিবাস চলাচলের ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে। যেমন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ১২টি মেট্রোলাইন, ২৮৮টি স্টেশন এবং ৩৯৩ কিলোমিটার বৃহৎ মেট্রোরেলের ব্যবস্থা থাকার পরও পাবলিক বাসগুলো মেট্রোর চেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহন করে।
রাজধানী ঢাকার গণপরিবহন সমস্যার সমাধান করতে হলে শুধু ব্যয়বহুল ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল বা বিআরটি ঘিরে পরিকল্পনা করলে হবে না; অধিকাংশ যাত্রী পরিবহন করে যে বাসব্যবস্থা, সেটি ঢেলে সাজাতে হবে। বেসরকারি মালিকদের একচেটিয়া কর্তৃত্বের বদলে সর্বজনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যথাযথ বিকল্পের ব্যবস্থা করে রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল নিরুৎসাহিত করতে হবে। বাস, মেট্রোরেল, বিআরটি, সাইকেল, হাঁটার ব্যবস্থাসহ সমন্বিত জনবান্ধব পরিকল্পনা করতে হবে।
● কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক