বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা এখন সম্ভবত স্মরণকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যে দেশ তাদের সীমান্ত খুলে, মানবিক সাহায্য দিয়ে বাংলাদেশিদের জীবন বাঁচিয়েছিল; অস্ত্র, ট্রেনিং ও সামরিক সাহায্য দিয়ে ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি যুদ্ধ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে এ দেশকে মুক্ত করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল, আজ ৫৩ বছর পর কেন সে দেশের মানুষের মধ্যে ভারত বিরোধিতা এত প্রবল হয়ে উঠল দুই দেশের আগামী দিনের সম্পর্ক ও পররাষ্ট্রনীতির জন্য, সে উত্তর খোঁজার চেষ্টা জরুরি।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনে নয়; বরং সমসাময়িক ভারতের সরকারের সহযোগিতায় বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার বিরোধী দল ও মত নিষ্ঠুরভাবে দমনের মাধ্যমে দীর্ঘ সময়, বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে টিকে ছিল।
সাধারণের ভোটাধিকার ও মৌলিক মানবাধিকারের বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে কখনো ইসলামি ধর্মীয় মৌলবাদ রুখে দেওয়া, কখনো চীনের প্রভাব খর্ব করার কথা বলে ভারত সরকার শেখ হাসিনার হয়ে আন্তর্জাতিকভাবে একধরনের ব্যবস্থাপকের ভূমিকায় আবর্তিত হয়। যার জন্য ২০২১ সালে র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগপর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে তেমন কোনো আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের সম্মুখীন হতে হয়নি। যদিও অব্যাহতভাবে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো হত্যা, গুম, ও নির্যাতনের অভিযোগ করে আসছিল।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্টেট ডিপার্টমেন্টের এ সময়কালের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলোতেও এসব অভিযোগের ও ঘটনার বিবরণ রয়েছে। ভারত সরকারের যাঁরা অব্যাহতভাবে শেখ হাসিনা সরকারকে সমর্থন জুগিয়েছেন, তাঁরা সেটি ভারতের জাতীয় স্বার্থে করেছেন না অন্য কোনোভাবে সুবিধাভোগী হয়ে করেছেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। বাস্তবে বাংলাদেশিরা প্রত্যক্ষ করেছে যে ইসলামি জুজুর ভয় দেখিয়ে শেখ হাসিনা প্রথমে তাদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছেন এবং পরে তাদের অভিভাবকের রূপ ধরে তাদের কাছ থেকে ‘কওমি জননী’ উপাধি নিয়েছেন।
শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী কর্মকাণ্ডে অন্ধ সমর্থন ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষকে আরও সন্দিহান ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় সমতার ভিত্তিতে বৈদেশিক সম্পর্ক কোনো অমূলক চাওয়া নয়। গণ-অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ভারতকে তার ভাবনা ও আচরণ বদলাতে হবে।
আবার বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বেড়ে গেলে চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের নিরাপত্তাঝুঁকির যে আশঙ্কার কথা বলা হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে সহজেই যে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা যায়, তা হলো, শেখ হাসিনার ২০০৯-২০২৪ শাসনামলে বাংলাদেশে চীনের প্রভাব যতটা বেড়েছে, অতীতে এমনটা কখনোই ছিল না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির আঞ্চলিক সুবিধাভোগী ভারত পশ্চিমাদের কাছে শেখ হাসিনাকে সমর্থনের মাধ্যমে চীনের প্রভাব কমানোর যে যুক্তি দিয়ে যাচ্ছিল, তা বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, পররাষ্ট্র নীতির রীতিনীতি শিষ্টতা পাশে সরিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী কেবল আওয়ামী লীগ দলের সঙ্গে ও স্বার্থে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে গেল, বাংলাদেশের সঙ্গে নয়। শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধ মত, দমননীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন উঠলে ভারত সরকার তাকে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে এড়িয়ে যেত। স্বৈরাচারের প্রতি এই অন্ধ সমর্থন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনকে বিষিয়ে তিতিবিরক্ত করে তুলেছে।
সাবেক সাংবাদিক ও ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক অভিনাশ পালিওয়াল তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত ইন্ডিয়া’স নিয়ার ইস্ট: আ নিউ হিস্ট্রি’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, কীভাবে সামরিক হুমকি প্রদানের মাধ্যমে ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের সময় তদানীন্তন ভারত সরকার শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছিল। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান এমনকি চীনকে বোঝাতেও ভারত সরকার লবি করেছিল সে সময়।
নিজ দেশের ও জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও ভারতের সব আকাঙ্ক্ষা শেখ হাসিনা পূর্ণ করেছেন। ভারতের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট না পেয়েও বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছেন, আদানি গ্রুপের সঙ্গে দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি অলাভজনক বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করেছেন, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর স্থায়ী ভিত্তিতে ভারতকে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।
বিপরীতে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায্য চাওয়াগুলো যেমন বিএসএফ কর্তৃক সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা, তিস্তাসহ ৫৪টি নদীর পানিবণ্টন চুক্তি ও ন্যায্য হিস্যা দেওয়া, এসব বিষয় ১৪ বছর পরেও অমীমাংসিত থেকেছে। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ইস্যুতে হাসিনা সরকার ভারত সরকারের পাশে থাকলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি ভারত। বাংলাদেশিদের উদ্বেগ উপেক্ষা করে সুন্দরবনকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে তৈরি করা হলো পরিবেশবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র।
সর্বশেষ গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও পালিয়ে যাওয়ার পরবর্তী সময়ে ভারতের কিছু গণমাধ্যম বাংলাদেশে মন্দিরে আগুন দেওয়া ও হিন্দুদের ওপর হামলার ভুয়া ভিডিও দেখিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের খবর অতিরঞ্জন করে পরিবেশন করে, যা পরে ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব অপতথ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
নিজ দেশে মুসলিমবিদ্বেষ ও দাঙ্গায় মদদ দেওয়ার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, সেই মোদি সরকার এ সময় অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে একটি কমিটি গঠন করেছে। শেখ হাসিনার ২০০৯-২০২৪ শাসনামলে অনেক হিন্দু মন্দিরে হামলা ও সম্পত্তি দখলের ঘটনায় ভারত সরকারকে এত উদ্বিগ্ন মনে হয়নি। তাই তাদের উদ্বেগের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।
অর্থনীতির আকার, জনশক্তি, সামরিক শক্তি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ওপর ভর করে ভারত নিজেকে বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণ তাকে বন্ধুহীন করেছে।
শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী কর্মকাণ্ডে অন্ধ সমর্থন ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষকে আরও সন্দিহান ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় সমতার ভিত্তিতে বৈদেশিক সম্পর্ক কোনো অমূলক চাওয়া নয়। গণ-অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ভারতকে তার ভাবনা ও আচরণ বদলাতে হবে।
মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক, হিউবার্ট এইচ হামফ্রে ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড