বিশ্লেষণ
প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার যেভাবে হতে পারে
প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল লক্ষণ হলো সেটির প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কতটা দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো। প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ আব্দুল হামিদ
প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার তিনটি অংশ রয়েছে—প্রমোটিভ, প্রিভেন্টিভ ও কিউরেটিভ। এর মধ্যে প্রথম দুটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রমোটিভ ও প্রিভেন্টিভ সেবা শক্তিশালী, সেই স্বাস্থ্যব্যবস্থাই বেশি কার্যকর। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার তিনটি ধারা চালু আছে—ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক সহায়তা ট্রাস্টের অধীন কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন পর্যায়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীন ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার সেন্টার এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন হেলথ সাব সেন্টার।
মাঠপর্যায়ে এই তিন ধরনের সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার বিভাগের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, পরিবার পরিকল্পনাসেবা এবং মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যসেবার একটি অংশ পরিচালিত হয় স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার বিভাগের অধীন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাধ্যমে। ফলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত, যা কোনো ভালো স্বাস্থ্যব্যবস্থার লক্ষণ নয়!
এত সব প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও জনগণ কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর মূলে রয়েছে দ্বৈত ব্যবস্থা, জনবলের অভাব, উপযুক্ত তদারকির অভাবসহ নানা সীমাবদ্ধতা। অন্যদিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ শহরে বসবাস করলেও শহরাঞ্চলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার তেমন কোনো কাঠামো নেই। হাতে গোনা কয়েকটি ‘গভর্নমেন্ট আউটডোর ডিসপেনসারি’র মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের যৎসামান্য ব্যবস্থা আছে।
‘সিটি করপোরেশন অ্যাক্ট-২০০৯’ ও ‘মিউনিসিপ্যালিটি অ্যাক্ট-২০০৯’ অনুযায়ী শহরাঞ্চলে প্রাথমিক সেবার দায়িত্ব বর্তায় সিটি করপোরেশন ও মিউনিসিপ্যালিটির ওপর। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের এসব প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা নেই; সদিচ্ছারও অভাব রয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সাল থেকে ‘আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্রজেক্ট’ নামের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সিটি করপোরেশন এবং কিছু মিউনিসিপ্যালিটিতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়।
এ প্রকল্পের একদিকে যেমন স্থায়িত্ব নেই, অন্যদিকে এর কার্যক্রম শহরে বসবাসকারী জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। ফলে টিকাদানসহ স্বাস্থ্যের বেশ কিছু সূচকে শহরাঞ্চল গ্রামাঞ্চলের তুলনায় ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব স্বাস্থ্যের সামগ্রিক সূচকে পড়ছে, যার দায়ভার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপরেই বর্তায়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কার্যকরভাবে করতে না পারার দায়ভার যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই নিতে হয়, করোনাকালই তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও কথাটি অনুরূপভাবে প্রযোজ্য।
তাই সংগত কারণেই গ্রাম ও শহর উভয় অঞ্চলেরই স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর থাকা উচিত। এ ক্ষেত্রে ‘সিটি করপোরেশন অ্যাক্ট-২০০৯’ ও ‘মিউনিসিপ্যালিটি অ্যাক্ট-২০০৯’-এ প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা প্রয়োজন। ‘স্বাস্থ্য’ যেহেতু প্রমোটিভ, প্রিভেন্টিভ, কিউরেটিভ, রিহ্যাবিলিটেটিভ ও প্যালিয়াটিভ সেবাসংবলিত একটি ব্যাপক বিষয়, তাই জনগণকে সঠিকভাবে এসব স্বাস্থ্যসেবা (বিশেষ করে প্রমোটিভ ও প্রিভেন্টিভ সেবা) পৌঁছে দেওয়ার জন্য দেশের অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে।
এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের গ্রাম ও শহর অঞ্চলের প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য যেসব সংস্কার প্রয়োজন, তা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।
গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে দুই ধরনের উপায় চিন্তা করা যায়। একটি হলো শ্রীলঙ্কার মতো মাঠপর্যায়ে পাবলিক হেলথ সেবা ও ক্লিনিক্যাল সেবা আলাদাভাবে প্রদান করা। পাবলিক হেলথের মধ্যে স্বাস্থ্যশিক্ষা, শিশু টিকাদানকারী কর্মসূচি, বয়ঃসন্ধিকালীন সেবা, পুষ্টিসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা সেবাসহ সব ধরনের প্রমোটিভ ও প্রিভেন্টিভ কেয়ার অন্তর্ভুক্ত থাকবে। মাঠপর্যায়ে ইউনিয়ন ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার সেন্টারকে উপযুক্ত জনবল সমন্বয়ে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে এসব সেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিদ্যমান জনবলের (যেমন ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার অ্যাসিট্যান্ট, ফ্যামিলি প্ল্যানিং ইন্সপেক্টর, ফ্যামিলি প্ল্যানিং ভিজিটর, হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেলথ ইন্সপেক্টর ও হেলথ ইন্সপেক্টর) দায়িত্ব পুনর্নিরূপণ করা যেতে পারে। তবে অধিক কার্যকরভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে বর্তমান ওয়ার্ডভিত্তিক ‘ক্যাচমেন্ট’ এলাকার পরিবর্তে জনসংখ্যাভিত্তিক ‘ক্যাচমেন্ট’ এলাকা নির্ধারণ করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার সেন্টারকে ‘ইউনিয়ন পাবলিক হেলথ সেন্টার’ এবং উপজেলা ফ্যামিলি প্ল্যানিং অফিস পুনর্গঠন করে ‘উপজেলা পাবলিক হেলথ অফিস’ নামে অভিহিত করা যেতে পারে। একজন পাবলিক হেলথ ফিজিশিয়ানের (চিকিৎসক) নেতৃত্বে মাঠপর্যায়ে পাবলিক হেলথ সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। উপজেলা পর্যায়ে বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনার জন্য যে মেডিকেল অফিসার (এমসিএইচ-এফপি) আছেন, তাঁকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান সাপেক্ষে এই দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে।
বর্তমানে বিসিএস পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডার থেকে উপজেলা পর্যায়ে যে পরিবার পরিকল্পনা অফিসার নিয়োগ করা হয়, তাঁকে উপজেলা পর্যায়ে সামগ্রিক পাবলিক হেলথ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। তবে ভবিষ্যতে বিসিএস পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডার রূপান্তর করে ‘বিসিএস পাবলিক হেলথ ধারা’ প্রবর্তন করতে হবে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ম্যাটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সেন্টারগুলো ক্লিনিক্যাল ধারার সঙ্গে একত্র করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন পরিচালিত হতে হবে।
বর্তমান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় পুনর্গঠন সাপেক্ষে ‘পাবলিক হেলথ অধিদপ্তর’ হিসেবে নামকরণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার বিভাগের পুনর্গঠন সাপেক্ষে নাম পরিবর্তন করে ‘পাবলিক হেলথ বিভাগ’ রাখা যেতে পারে। আর ক্লিনিক্যাল সেবার জন্য উপযুক্ত জনবল সমন্বয়ে একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের নেতৃত্বে ইউনিয়ন হেলথ সাব সেন্টারকে শক্তিশালী করতে হবে। যেহেতু ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি চিকিৎসক থাকতে চান না, তাই ‘পারফরম্যান্স বেজড কন্ট্রাকচুয়াল রিক্রুটমেন্ট’ কিংবা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে চিকিৎসক, মিডওয়াইফ, নার্সসহ অন্যান্য জনবল নিয়োগ করা যেতে পারে।
বর্তমানের মতো ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকে উভয় প্রকার সেবা প্রদানের জন্য ব্যবহার করা যায়। এ ক্ষেত্রে পাবলিক হেলথ সেবা প্রদানের জন্য পাবলিক হেলথ মিডওয়াইফ বা পাবলিক হেলথ ওয়ার্কার এবং ক্লিনিক্যাল সেবার জন্য প্যারামেডিক নিয়োজিত করা যেতে পারে। অন্য উপায় হলো, সব প্রকার (প্রমোটিভ, প্রিভেন্টিভ ও কিউরেটিভ) প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা একটি একক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রদানের জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ের তিন ধরনের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রকে (কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ও ইউনিয়ন হেলথ সাব সেন্টার) একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসা। ফলে একদিকে যেমন দ্বৈত ব্যবস্থা এড়ানো সম্ভব, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় জনবলের একটি উপযুক্ত মিশ্রণ নিশ্চিত করা সহজ হবে। এ ক্ষেত্রেও ওয়ার্ডভিত্তিক ‘ক্যাচমেন্ট’ এলাকার পরিবর্তে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যাচমেন্ট এলাকা নির্ধারণ করতে হবে।
ইউনিয়ন পর্যায়ে এসব সেবা কার্যক্রম ‘জেনারেল প্র্যাকটিশনার (জিপি) সিস্টেম’ প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রদান করা যেতে পারে। আবার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমেও করা যেতে পারে। যে পদ্ধতিই গ্রহণ করা হোক, প্রমোটিভ, প্রিভেন্টিভ ও কিউরেটিভ সেবা কার্যকরভাবে প্রদানের জন্য জনবলের একটি উপযুক্ত মিশ্রণ থাকতে হবে। যেমন ক্লিনিক্যাল সেবার জন্য এমবিবিএস চিকিৎসক, মিডওয়াইফ, নার্স ও প্যারামেডিকস এবং পাবলিক হেলথ সেবার জন্য পাবলিক হেলথ ইন্সপেক্টর, পাবলিক হেলথ মিডওয়াইফ বা পাবলিক হেলথ ওয়ার্কার থাকা প্রয়োজন। ইউনিয়ন পর্যায়ে বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার, ইউনিয়ন হেলথ সাব সেন্টারে যেসব জনবল নিয়োজিত আছেন, তাঁদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ সাপেক্ষে যোগ্যতা অনুযায়ী ক্লিনিক্যাল সেবা ও পাবলিক হেলথ সেবার জন্য নিয়োজিত করতে হবে।
একজন এমবিবিএস চিকিৎসকের নেতৃত্বে ইউনিয়ন পর্যায়ে এ ধরনের সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবার পরিকল্পনা অফিসকে পুনর্গঠন করতে হবে। পুনর্গঠিত অফিসকে ‘প্রাইমারি হেলথ কেয়ার অফিস’ নামে অভিহিত করা যেতে পারে।
কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ দায়ভার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ারের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরকে পুনর্গঠন করে ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর’ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার বিভাগকে পুনর্গঠন করে ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ’ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। তবে বর্তমানে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীন উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ম্যাটারনাল অ্যান্ড চাইল্ড ওয়েলফেয়ার সেন্টারগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে।
উল্লিখিত দুটি পন্থারই তুলনামূলক সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। যেমন প্রথমটির ক্ষেত্রে দেশের প্রায় সব ইউনিয়নে ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার সেন্টার বিরাজমান থাকায় আলাদাভাবে পাবলিক হেলথ ধারাটির প্রচলন করা যেমন সহজ, দেশের বেশির ভাগ ইউনিয়নে হেলথ সাব সেন্টার না থাকায় ক্লিনিক্যাল ধারাটি আলাদাভাবে প্রচলন করা তেমনই কঠিন। দ্বিতীয়টির সুবিধা হলো, ইউনিয়ন পর্যায়ে ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার সেন্টার বা ইউনিয়ন সাব সেন্টারের যে ভৌত অবকাঠামোটি বেশি ব্যবহার উপযোগী, তা ব্যবহার করে সহজে এ পন্থার কার্যক্রম শুরু করা যায়।
অসুবিধা হলো পাবলিক হেলথ সেবা ও ক্লিনিক্যাল সেবা একই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রদান করা হলে পাবলিক হেলথ সেবার ওপর গুরুত্ব কমে যায়। ফলে জনগণ প্রয়োজীয় পাবলিক হেলথ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। তবে বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী, দ্বিতীয় পন্থাটিই তুলনামূলকভাবে বেশি যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত।
শহরাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনার মতো বড় শহরগুলোকে (যেসব স্থানে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের আধিক্য রয়েছে) এক দলে এবং অন্যান্য বিভাগীয় শহর, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক মিউনিস্যাপিলিটিগুলোকে অন্য দলে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। দ্বিতীয় দলের ক্ষেত্রে ওপরে বর্ণিত দুটি পন্থার যেটিই গ্রহণ করা হোক না কেন, তা প্রযোজ্য হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলে ইউনিয়ন পর্যায়ের সেবাপ্রতিষ্ঠানের আদলে শহরাঞ্চলের ওয়ার্ডে একই ধরনের সেবাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর শহরাঞ্চলে ওয়ার্ডকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে গ্রামাঞ্চলের ওয়ার্ড পর্যায়ের সেবাপ্রতিষ্ঠানের আদলে একই ধরনের সেবাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
প্রথম দলের জন্য শহরের ওয়ার্ডকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে কয়েকটি ‘ক্যাচমেন্ট’ এলাকায় ভাগ করে এবং একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) অনুসরণ করার মাধ্যমে বেসরকারি সেবাকেন্দ্রগুলো থেকে স্ট্র্যাটেজিক পারচেজিং পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রতিকারমূলক প্রাথমিক সেবা প্রদান করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইউনিসেফের অর্থায়নে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রণীত ‘আলো ক্লিনিক’ মডেলের এসওপি অনুসরণ করা যেতে পারে। আর সিটি করপোরেশন ও মিউনিসিপ্যালিটির সমন্বয়ে প্রমোটিভ ও প্রিভেন্টিভ সেবা প্রদান করা যেতে পারে।
আবার উভয় দলের জন্য ‘আলো ক্লিনিক’ মডেলের মূল ধারণা অনুসরণ করা যেতে পারে। আলো ক্লিনিকের মূল ধারণায় প্রমোটিভ, প্রিভেন্টিভ ও কিউরেটিভ সেবা দেওয়ার জন্য শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে তিন বা ততোধিক ‘ক্যাচমেন্ট এরিয়া’তে ভাগ করা হয়। প্রতিটি ক্যাচমেন্ট এলাকায় একটি করে প্রাথমিক সেবাকেন্দ্র ও রেফারেল সেবার জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি সম্প্রসারিত সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ধারণার কথা বলা হয়েছে। উভয় প্রকার সেবাকেন্দ্রে, এসওপি অনুসরণ করে দুই শিফটের মাধ্যমে উপযুক্ত জনবলের সমন্বয়ে ডায়াগনস্টিক সেবাসহ বহির্বিভাগীয় প্রাথমিক সেবা, টিকাদান সেবা, গর্ভকালীন সেবা, গর্ভ-পরবর্তীকালীন সেবা প্রদানের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে।
পাশাপাশি কমিউনিটি পর্যায়ে প্রমোটিভ ও প্রিভেন্টিভ সেবা প্রদানের জন্য মোবাইল ক্লিনিক চালুর ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। মেডিসিন, গাইনি ও অবস, পেডিয়াট্রিকসহ প্রধান ক্লিনিক্যাল গ্রুপের রেফারেল সেবা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত জনবল ও সরঞ্জামাদি সমন্বয়ে ওয়ার্ড পর্যায়ে সম্প্রসারিত সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। ডিজিটাল টেকনোলজির মাধ্যমে ‘ইন্টিগ্রেটেড হেলথ এমআইএস’ পদ্ধতি অনুসরণ করে এ সেবা কার্যক্রম তদারক করার ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। এসব পরামর্শের আলোকে উপযুক্তভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার করতে পারলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং আহ্বায়ক, অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি)