চালের দাম: গণৎকার না হয়ে হিসাবে বসুন

ক্ষমতার আসনে বসলে কেউ মেজাজ হারান, কারও চলে যায় হুঁশ। একবার এক সাবেক, ক্যামেরার সামনেই রেলের এক অতি সাধারণ কর্মীকে থাপ্পড় মেরে পরে বলেছিলেন, ‘মেজাজ ঠিক ছিল না।’ অনেকে আবার দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পান আগাম ভবিষ্যৎ। 

গত বছরের এই সময় (১৭ জানুয়ারি ২০২৪) চাল বিষয়ে যিনি তখন বর্তমান ছিলেন, তিনি বলেছিলেন, চার দিনের মধ্যে বেড়ে যাওয়া চালের দাম আবার কমে আগের জায়গায় চলে আসবে। চাল ব্যবসায়ীদের ডেকে বলেছিলেন, ‘যেভাবে চার দিনে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম তুলেছেন, তেমনই চার দিনে কমিয়ে স্বস্থানে নিয়ে আসবেন।’ কয়েকজন ব্যবসায়ী সেদিন সমস্বরে বলে ছিলেন, ‘ইয়েস স্যার।’ কিন্তু দাম আর আগের জায়গায় ফেরেনি।

এ রকম হম্বিতম্বি ভবিষ্যদ্বাণী জারির চলন বহুদিনের। ’৬৫-এর ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের পর হঠাৎ চালের দাম বাড়তে থাকে। ১৭ দিনের সেই যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরাট সাফল্য সিনেমা হলে আর সন্ধ্যার পর পাড়ায় পাড়ায় খোলা মাঠে সাদা পর্দা টাঙিয়ে দেখানো হতো। বলা হতো, ভারত প্রায় পাকিস্তানের দখলে চলে আসছিল কিন্তু জাতিসংঘের কথায় পাকিস্তান সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এসব প্রচার মানুষ বিনোদন হিসেবেই নিত। ১০ আনার (প্রায় ৬২ পয়সা) চাল তখন ৫ সিকে (১২৫ পয়সা) ছাড়িয়ে গেছে।

একদিন মিলের ছাঁটাই শ্রমিক মন্টু দাস সিনেমা দেখতে দেখতে বলেই ফেলল, ‘এতই যখন মুরোদ, তখন চালের দাম ঠেকাও না ক্যানে।’ মন্টু দাসকে নিয়ে বিস্তর থানা-পুলিশ হয়েছিল। কিছুদিন পর মোনায়েম খান এলেন বক্তৃতা করতে। চালের দাম নিয়ে মানুষের তখন নাভিশ্বাস। প্রকাশ্য জনসভায় মোনায়েম খান বললেন ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের কথা। বললেন, তখনকার চাইতে এখন চাল সস্তা। ভবিষ্যদ্বাবাণী করলেন, যত যা-ই হোক, চালের দাম কোনো অবস্থাতেই দুই টাকার ওপরে যাবে না। তখন দৈনিক মজুরি ছিল দেড় থেকে দুই টাকা। এটা শুনে ভাড়া করা লোকের সেই জনসভাতেও তালির বদলে দুয়ো ওঠে প্রতিবাদের।

বর্তমানের অনেকেই একই রকম বাণী দিচ্ছেন। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় গিয়ে কেউ বলছেন, ‘চালের দাম আর বাড়বে না। দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হওয়ায় দাম বেড়েছে।’ কেউ তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ীতে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘দাম বাড়ার পেছনে রয়েছে সাময়িক মজুতদারি।’ অন্য এক উপদেষ্টা চালের দাম বাড়ার জন্য দায়ী করেছেন তাঁর ভাষায় ‘সামর্থ্যবানদের’। তাঁর পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ভর্তুকির পণ্যের প্রতি সামর্থ্যবানেরা হাত বাড়িয়েছেন। তাঁরা এসব পণ্য কিনে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছেন। বোধ হয় তাঁর ধারণা, তথাকথিত সামর্থ্যবানদের চাপে পড়ে চালের দাম কমছে না।

চালের দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে পুঁজিবাদবিরোধী ‘প্রগতিশীলদের’ একটা বিশ্লেষণ আছে। তাঁরা মনে করেন, ‘দেশের চালের বাজারে বড় বড় প্রতিষ্ঠান ঢুকেছে। বিপুল পরিমাণ ধান মজুত করে বাজার নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা তাদের রয়েছে। তারা চাইলেই ব্যাংকের ঋণ পায়। তাদের কারসাজিতেই চালের দাম ভরা মৌসুমেও ঊর্ধ্বমুখী।’

খুচরা ও পাইকারেরা বলছেন, অতিরিক্ত দামের জন্য দায়ী মিলমালিকেরা। কুষ্টিয়া আর নওগাঁর মিলমালিকেরা দায়ী করছেন ধানের অস্বাভাবিক মূল্যকে। হয়তো কারও কারও কথায় যুক্তি আছে। দুর্যোগ তো হয়েছিল। বড় পুঁজি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চাল কিনে রাখে গুদামে। অফিসফেরত সামর্থ্যবান ট্রাকের পেছনে ময়লা কাপড়ের মানুষের ভিড়ে মিশে যান একটু সাশ্রয়ের জন্য। ‘সাময়িক মজুতদারি’ও করেন কেউ কেউ। কিন্তু আসল হিসাবটা কি কেউ করে দেখেছেন? এ দেশের মানুষ সব দেশের চাল খেতে পারে কি? সেদ্ধ চালের উৎস সীমিত কিন্তু চাহিদা বেশি। মিয়ানমার চাল বেচতে চায় কিন্তু আগের পথ আকিয়াব এখন অবরুদ্ধ। কতটা নিরাপদ সেই বাণিজ্য?

আমাদের নিজের কানটাতেও হাত দিয়ে দেখা প্রয়োজন চিলের পেছনে ছোটার আগে।

সরকার এ বছর প্রতি কেজি ধানের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করেছে ৩৩ টাকা, আতপ চালের দাম ৪৬ এবং সেদ্ধ চালের দাম ৪৭ টাকা। সে হিসাবে এক মণ (৪০ কেজি) ধানের দাম দাঁড়ায় ১ হাজার ৩২০ টাকা। কিন্তু দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, মাঝারি ব্রি-৪৯ জাতের ধান প্রতি মণ ১ হাজার ৬০০ টাকা; ব্রি-৫১ ও ব্রি-৫২ জাতের ধান ১ হাজার ৫০০; ব্রি-২২ জাতের ধান ১ হাজার ৪০০ এবং মোটা হাইব্রিড হীরা ধান বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ টাকা মণ দরে। নওগাঁ, কুষ্টিয়ার মতো দিনাজপুরেও একই অবস্থা।

যে যার মতো অন্ধকারে ঢিল না ছুড়ে একটু যদি খাতা-কলম বা ক্যালকুলেটর নিয়ে বসি, তাহলে বিষয়টা খোলাসা হবে। চালের বর্তমান দামের পক্ষে যে ধানের মূল্যবৃদ্ধি একটা অজুহাতমাত্র, তা বোঝা যাবে। এক মণ আমন ধান থেকে কমপক্ষে ২৯ কেজি চাল পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে মেলে প্রায় ১০ কেজি তুষ ও খুদ, যার আনুমানিক মূল্য ১০০ টাকা। প্রতি মণ ধানের দামের সঙ্গে ধান ভাঙা, বস্তা ভর্তি ও পরিবহন খরচ ৫০ টাকা যোগ করে এবং খুদ ও তুষের মূল্য ১০০ টাকা বাদ দিলে প্রতি কেজি চালের মিল গেটে উৎপাদন খরচ কোনো অবস্থাতেই ৫৩ টাকার বেশি হবে না। এরপর মিলমালিক, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের লাভ প্রতি কেজিতে ১ টাকা করে মোট ৩ টাকা যোগ করলেও প্রতি কেজি ব্রি-৪৯ চালের খুচরা মূল্য ৫৬ টাকার বেশি হওয়ার পেছনে সব যুক্তিই অসাড়। বেশি লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকেই ৫৬ টাকা কেজির চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৮ টাকায়। (১৪ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখের হিসাব)

নিজেরা গণৎকার বা জ্যোতিষী না হয়ে আমাদের উচিত হবে মিলমালিক আর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাগজ-কলম নিয়ে বসা। হিসাবের বাইরে কিছুই নেই। তবে কে কার মেশিনে হিসাব কষেন, সেটা আমাদের বুঝতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক গবেষক