আজ ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার অবসান দিবস। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নানারূপে ও প্রকৃতিতে আবির্ভূত হয়। এর মধ্যে রয়েছে স্ত্রী-নিপীড়ন থেকে শুরু করে ধর্ষণ, যৌতুকের জন্য হত্যা, অ্যাসিড ছুড়ে মারা, যৌন হয়রানি, যৌন দাসত্বের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নারী পাচার ইত্যাদি। গৃহাভ্যন্তরে নারীরা অনেক সময়েই শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নিগৃহীত হন।
নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার নানা কারণ আছে। এর মধ্যে রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কর্তৃত্ব, জোর করে বিয়ে, নারীর প্রতি প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংবেদনশীলতার অভাব, বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতি, অসম ক্ষমতার সম্পর্ক, বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও বঞ্চনা, নারী পাচার। যে সমাজে পুরুষ কর্তৃত্ববাদভিত্তিক একটি দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধের একটি ইতিহাস রয়েছে, সেখানে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রত্যাশিত। বিশ্বের বিভিন্ন সমাজে নারীবিরোধী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যবোধ নারীদের অধীনতাকে আরও সুপ্রথিত করে। পারিবারিক সম্মান রক্ষার্থে এবং পুরুষের কর্তৃত্ব মেনে চলার লক্ষ্যে সমাজ মেয়েদের নিপীড়ন সহ্য করার জন্য চাপ দেয়। গৃহাভ্যন্তরে নারী নির্যাতনকে একটি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে চিত্রায়িত করার পেছনে এসবের একটি বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুসারে, বিশ্বের প্রতি তিনজন নারীর একজন (৩৫ শতাংশ) তাঁদের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের দ্বারা বা অন্য মানুষদের দ্বারা জীবনের কোনো একটি সময়ে যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। বিশ্বে ৪৫ লাখ নারী বা কিশোরী বিভিন্নভাবে যৌন শোষণের শিকার হয়। তথাকথিত ‘পারিবারিক সম্মান রক্ষার’ নামে প্রতিবছর বিশ্বে আত্মাহুতি দেন পাঁচ হাজার তরুণী।
গৃহাভ্যন্তরের সহিংসতা বড়ই বিধ্বংসী। যাঁরা এর শিকার, তাঁরা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং সেই সঙ্গে তাঁদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিরতা নষ্ট হয়। গৃহাভ্যন্তরের সহিংসতা মানুষের জ্ঞানীয় দক্ষতাকে নষ্ট করে এবং নির্যাতিত নারীদের ওপরে এর ক্ষতিকারক স্বাস্থ্য প্রভাব রয়েছে। যেসব শিশু গৃহাভ্যন্তরের নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছে, তাদের মানসিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। বড় হলে, তাদের নিজের সংসারেও তারা ঠিক একই আচরণ করতে পারে নারীদের সঙ্গে।
বহু মেয়ে সহিংসতা-ভীতির কারণে শিক্ষাস্থলে যেতে, কর্মস্থলে কাজ করতে কিংবা তাঁদের রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগ করতে ভয় পান।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে প্রতি দুজন বিবাহিত নারীর মধ্যে একজন তাঁদের জীবনকালের কোনো এক সময়ে গৃহাভ্যন্তরীণ সহিংসতার শিকার হয়েছেন। কিশোর-কিশোরীদের বিরুদ্ধে সহিংসতাও আমাদের দেশের একটি উদ্বেগজনক সামাজিক সমস্যা। পরিসংখ্যান ব্যুরোর আরও বিস্তৃত উপাত্তে দেখা যায় যে বৈবাহিক অবস্থান নির্বিশেষে, কিশোরীরা নানা রকমের সহিংসতার মুখোমুখি হয়। গৃহাভ্যন্তরীণ সহিংসতার যারা শিকার, তাদের একটি লুকোনো লড়াই লড়তে হয়। সেই সঙ্গে তারা ভবিষ্যতে আরও বেশি নির্যাতন ও প্রতিশোধের আশঙ্কা করে, লজ্জা ও সংকোচে আরও কুঁকড়ে যায়।
বৈশ্বিকভাবে গৃহাভ্যন্তরীণ সহিংসতার মোকাবিলা করার জন্য একটি সামগ্রিক কৌশল প্রয়োজন। এ কৌশলের তিনটা মাত্রিকতা থাকা দরকার—আইনগত ও নীতিগত পরিবর্তন, দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের বদল এবং সহিংসতাভোগীদের ক্ষমতায়ন। যাঁরা সহিংসতার শিকার, তাঁদের নিরাপত্তা এবং যারা নিপীড়ক, তাদের দায়ভোগ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য গৃহাভ্যন্তরীণ সহিংসতা রোধের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ এবং বিচার বিভাগীয় প্রতিক্রিয়াকে উন্নত করা প্রয়োজন এবং নিপীড়িত নারীরা যাতে আইনগত সাহায্য পেতে পারেন, সে জন্য নিরাপত্তা নির্দেশ নিশ্চিত করতে হবে।
নিপীড়নের চক্র ভাঙতে হলে গৃহাভ্যন্তরীণ সহিংসতার ব্যাপারে সামাজিক মনোভাবের রূপান্তর অত্যন্ত জরুরি।
গৃহাভ্যন্তরীণ সহিংসতার যাঁরা শিকার, তাঁদের জন্য সেবাদান প্রসারিত করা যায়। এসব সেবার মধ্যে থাকা উচিত সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়, তাঁদের পরামর্শ এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, তাঁদের জীবনকে পুনর্নির্মাণে সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের কর্মসূচি। নির্যাতিত নারীদের ভৌগোলিক কিংবা আর্থসামাজিক অবস্থান-নির্বিশেষে তাঁরা যাতে এসব সেবা পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।
চূড়ান্ত বিচার, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার বিষয়, যার জন্য তাৎক্ষণিক এবং চলমান ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। এর জন্য সরকার, নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং ব্যক্তিমানুষেরও যৌথ প্রয়াস অতিপ্রয়োজন। এর মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধকে বদলানো সম্ভব। এবং সেটা করলেই যাঁরা সহিংসতার শিকার, তাঁদের সহায়তা প্রদান ও তাঁদের নিরাপত্তা বিধান এবং সেই সঙ্গে যাঁরা সহিংসতা ঘটান, তাঁদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব। মানবাধিকারের সুরক্ষার কোনো বিকল্প নেই, এটি আমাদের একটি দায়িত্ব।
● সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি