এত মানুষ মারা গেছে! এত মানুষ! বাবার কোলে শিশু মারা গেছে, দাদির পাশে গুলিবিদ্ধ হয়েছে শিশু। চারদিকে কান্নার রোল। এত এত সম্পত্তির বিনাশ! অর্থনীতির এত বড় ক্ষতি!
এই সমূহ ক্ষতি কি ঘটত? যদি...
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর-উত্তর সংবাদ সম্মেলনটা না হতো?
তাতে যদি দুই সাংবাদিক দুটো প্রহসনমূলক প্রশ্ন না করতেন?
প্রধানমন্ত্রী যদি বলতেন, আমরাই তো কোটা চাই না, তাই তো আমরা হাইকোর্টে আপিল করে আগের প্রজ্ঞাপন বহাল রেখেছি! শিক্ষার্থীদের কথা তো আমাদেরই শুনতে হবে। শিক্ষার্থীদের কথাই তো শুনব, আপনার মতো সাংবাদিকের উসকানিতে টলব নাকি!
ওবায়দুল কাদের যদি না বলতেন, ছাত্রলীগই যথেষ্ট!
ছাত্রলীগ যুবলীগ যদি লাঠিসোঁটা-অস্ত্র হাতে ছাত্রদের দমানোর কাজে না নামত!
ওবায়দুল কাদের যদি না বলতেন, ‘শুট অন সাইট’, দেখামাত্র গুলির নির্দেশ জারি করা হয়েছে!
ছাত্রলীগ যদি ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ বলে শিক্ষার্থীদের পাশে গিয়ে দাঁড়াত, শিক্ষার্থীদের ফুল দিত!
রংপুরে আবু সাঈদকে যদি পুলিশ গুলি না করত!
কিন্তু এসবই ঘটে গেছে! আমাদের তো টাইমমেশিন নেই যে আমরা ১২ জুলাইয়ে ফেরত যাব, আর ঘটনার গতিপথ পাল্টে দেব!
ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে, বধির করে, নিঃসঙ্গ করে। ১৩ জুলাই ২০২৪ যখন আয়মান সাদিক স্ট্যাটাস দিলেন, ‘কোটা সংস্কার চাই, মেধা হোক সবচেয়ে বড় কোটা’; তখন তাঁর ওপরে আক্রমণ শুরু হলো। ১০ মিনিট স্কুলের ৫ কোটি টাকার অনুদানের প্রস্তাব বাতিল করে দেওয়া হলো।
মন্ত্রীরা দম্ভভরে সেই বিজ্ঞপ্তি শেয়ার করলেন! এটা হাঁড়ির একটা ভাত। এ থেকে তো বোঝা যায়, সরকার তার বন্ধুদেরও বিশ্বাস করছিল না। শুধু আয়মান সাদিক নন, যাঁরাই শিশু-কিশোর-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা সবাই পরিস্থিতির তীব্রতা বুঝতে পেরে সরকারকে সঠিক পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
ক্ষতিকর স্তাবকতা না করে উপকারী পরামর্শ দিচ্ছিলেন যাঁরা, তাঁদের ওপরে চালানো হচ্ছিল সংগঠিত আক্রমণ।
পলিটিকস ইজ দ্য আর্ট অব কম্প্রোমাইজ। অনেক মায়ের বুক খালি হয়েছে, জনপদে জনপদে কান্নার রোল। শিশুরা ভয়ার্ত। মানুষ আতঙ্কিত, এই বুঝি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ আসে। মানুষের ভয় দূর করুন। আর একজন মায়ের বুক যেন খালি না হয়! আর একটাও অপমৃত্যু নয়!
এখন কোথায় সেই স্তাবকেরা! তাঁদের কুপরামর্শ না শুনে দেশের প্রকৃত অবস্থা জানার চেষ্টা করুন। মন্ত্রীদের ফেসবুক পোস্টে এক লাখ রিঅ্যাকশন, এর মধ্যে ৯৯ হাজার হা হা। তাঁরা লজ্জা পান না, কিন্তু আমরা লজ্জা পাই।
কাঙালের কথা কেউ শুনবে না। তবুও মনে হয়, যদি...
সরকারের উচ্চমহল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের সবাইকে ডেকে নিয়ে বসেন এবং তাঁদের দাবির যৌক্তিক অংশগুলো মেনে নেন;
যদি এখনই ঘোষণা দিয়ে গ্রেপ্তারকৃত সব ছাত্রকে মুক্তি দেওয়া হয়;
যদি এখনই গণগ্রেপ্তার বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়;
এবং যদি দাবা খেলায় রাজা বাঁচানোর জন্য দু-চারটা হাতি-ঘোড়া বিসর্জন দেওয়া হয়;
তাহলে কি পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে না?
২৯ জুলাই ২০২৪ ফেসবুক যে লালে লাল হয়ে গিয়েছিল, তার মানেটা কি শাসকেরা বুঝতে পারছেন? দেয়ালের লিখন কি পড়তে পারছেন? এটা কি বুঝতে পারছেন, ১০-১২ জুলাই এক ফোঁড়ে যা করা যেত, এখন ৯ ফোঁড়েও তা আর জোড়া লাগছে না!
এখন ৯ সেলাইয়ের জায়গায় ১০ সেলাই দিলে হয়তো টিকবে, কিন্তু এরপর সেলাইমেশিন অবিরাম চালিয়েও আর কাপড় বাঁচানো যাবে না।
ডিবি অফিস থেকে ভিডিও প্রচারের মশকরা বন্ধ করুন।
সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মীমাংসার উদ্যোগ নিন।
পলিটিকস ইজ দ্য আর্ট অব কম্প্রোমাইজ। অনেক মায়ের বুক খালি হয়েছে, জনপদে জনপদে কান্নার রোল। শিশুরা ভয়ার্ত। মানুষ আতঙ্কিত, এই বুঝি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ আসে। মানুষের ভয় দূর করুন। আর একজন মায়ের বুক যেন খালি না হয়! আর একটাও অপমৃত্যু নয়!
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক