সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান বলেছিলেন মূল্যস্ফীতি খুনির মতোই প্রাণঘাতী। মূল্যস্ফীতি যে কতটা প্রাণঘাতী হতে পারে, তার আঁচ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সরকারি হিসাবেই মাসের পর মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯-এর ঘরে। গরিব, নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তদের বড় একটা অংশ নানাভাবে কাটছাঁট করে, জোড়াতালি দিয়ে জীবন চালাচ্ছে। ঘরে ঘরে কান পাতলেই এখন নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর আর কায়দা করে জীবন চালানোর ফন্দিফিকিরের কাহিনিগুলো শোনা যাবে।
এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ৬-এর ঘরে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না, যাতে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আসতে পারে। জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আদায়ে বাংলাদেশ নিচের সারির দিকে বিশ্বের সবচেয়ে চ্যাম্পিয়ন দেশগুলোর একটি। এর কারণ হলো আমাদের বৈষম্যমূলক রাজস্ব নীতি। মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট এবং আমদানি শুল্ক এখনো আমাদের রাজস্ব আদায়ের প্রধান দুই খাত।
এখানকার বিত্তবানদের কাছ থেকে সম্পদের হিস্যা অনুপাতে কর আদায় করা হয় না। রাজস্ব নীতি বিত্তবানদের সহায়ক। ফলে রাজস্বের চাপটা সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এবারের বাজেটেও সেটা দৃশ্যমানভাবে লক্ষণীয়। সরকারি সেবা নিতে ২০০০ টাকা আয়কর রিটার্ন দাখিলের যে বাধ্যবাধকতা করা হয়েছে। ফলে আয়কর দেওয়ার মতো আয় না থাকলেও রিটার্ন ঠিকই দিতে হবে। এ ধরনের নীতি শুধু বৈষম্যমূলক নয় প্রচলিত আইনের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতির ভুল এবং কিছু মানুষকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নীতির কারণেই আজকে লোডশেডিংয়ের এই চরম পরিস্থিতি। গ্যাস, কয়লা আমদানি করতে না পারায় বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এখন জুন মাস চলছে। মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ আসতে আরও কয়েক দিন বাকি। প্রাক্-বর্ষার এই সময়টাতে দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলেই চলছে দাবদাহ। এই দাবদাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাড়ছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। দিনেরাতে নিয়ম করেই চলছে লোডশেডিং। রাজধানীর যেসব এলাকায় সচরাচর বিদ্যুৎ যায় না, সেসব এলাকাতেও এখন দিন কয়েক ঘণ্টার লোডশেডিং হচ্ছে। আর গ্রামাঞ্চলে কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ না থাকাটাই স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিদ্যুতের দেখা পাওয়াটা যেন সত্যি সত্যি মিরাকেল।
দেশে বিদ্যুতের যে চাহিদা তার চেয়ে উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ হওয়ার পরও প্রতিদিনই কয়েক হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। প্রাথমিক জ্বালানির উৎস নিশ্চিত না করেই বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোয় দেখা দিয়েছে এই সংকট। দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় মজুত থাকার পরও জ্বালানিকে আমদানিনির্ভর করে তোলা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও বসিয়ে বসিয়ে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির এই ভুল এবং কিছু মানুষকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার এই নীতির কারণেই আজকে লোডশেডিংয়ের এই চরম পরিস্থিতি। গ্যাস, কয়লা আমদানি করতে না পারায় বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র।
কোভিড মহামারির পরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানির বৈশ্বিক বাজার অস্থির হয়ে উঠেছিল। বেশির ভাগ খাদ্যপণ্য ও কাঁচামালের দামও ছিল ঊর্ধ্বমুখী। সে সময়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হওয়ায় দ্রুত কমে আসতে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পর অধিকাংশ খাদ্যপণ্য ও কাঁচামালের দাম যুদ্ধ-পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে এসেছে। মন্দা পরিস্থিতির কারণে চাহিদা কমে যাওয়ায় অনেক পণ্যের দাম আগের চেয়েও কমেছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য, কাঁচামালের দাম কমার কোনো সুফল দেশের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো সয়াবিন তেল, চিনির মতো পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে। এর একটাই কারণ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা ডলার-সংকট। আমদানি করার মতো ডলার আমাদের নেই। ফলে দেশের বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমছে না। কমছে না মূল্যস্ফীতির চাপও।
জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দামের যে তেজিভাব ছিল, তা বেশ কয়েক মাস আগেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। যে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩৪ ডলারে উঠেছিল, তা এখন ৭৫ ডলারের নিচে নেমেছে।
বাংলাদেশে গত আগস্ট মাসে হঠাৎ অকটেন, ডিজেল, পেট্রলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৩৩ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। এরপর গ্যাস-বিদ্যুতের দামও কয়েক দফায় বাড়ানো হয়। জ্বালানির মতো কৌশলগত পণ্যের দাম একলাফে বাড়ানোয় মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়াও ছুটতে থাকে সমানতালে।
মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের যখন এই ত্রাহি অবস্থা, সে সময় জ্বালানিতে দিব্যি মুনাফা করে চলেছে বর্তমানে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কেনার পর বর্তমানে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রতি লিটার ডিজেলে ৫ টাকা এবং প্রতি লিটার অকটেনে ১৩ টাকা মুনাফা করছে।
সিপিডি আরও বলেছে, ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত এই ৭ বছরে বিপিসি মোট ৪৩ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা লাভ করেছে। কর দেওয়ার পর নিট মুনাফা ৩৬ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। অথচ কয়েক মাস ভর্তুকি দিতে হচ্ছে এই যুক্তি দিয়ে একলাফে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল।
সে সময়ে প্রশ্ন উঠেছিল বিপিসি সাত বছরে যে ৩৬ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে, সেই টাকাটা কোথায় গেল? তা দিয়ে কয়েক মাসের দুঃসময়টা কি কাটিয়ে দেওয়া যেত না? প্রশ্ন সহজ হলেও এর উত্তর কে দেবে? যেমন উত্তর দেওয়ার কেউ নেই, উচ্চ মূল্যস্ফীতি যখন চলছে, তখন বিপিসি কী করে মুনাফা করে? আমরা কয়েক মাস আগেই দেখেছি বিপিসির মুনাফা সংকটে কোনো কাজে আসে না। তাহলে বিপিসির মুনাফা কার স্বার্থে? যদি এই মুনাফা লোডশেডিং কমাতে ভূমিকা পালন করতে পারত, তাহলে নাহয় ‘পেটে খেলে পিঠে সয়’-এর মতো কিছু একটা বুঝ থাকত।
দেশে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের একটা ব্যাপার আছে। মূলত বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দাম সমন্বয় হয়। দাম কমে গেলে সমন্বয়ের তত্ত্ব সাধারণত খাটে না। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশে জ্বালানির দাম সমন্বয়ের কোনো ব্যবস্থা চালু হয়নি। এ ক্ষেত্রে সরকার তার সুবিধামতোই মূল্য নির্ধারণ করে।
জ্বালানির মতো কৌশলগত পণ্যের দাম কমলে নিশ্চিতভাবেই সবকিছুর ওপর তার প্রভাব পড়বে। মূল্যস্ফীতির চাপটাও কিছুটা কমে আসবে। সাধারণ মানুষ আর কত দিন মূল্যস্ফীতি নামের খুনিটার সঙ্গে বাস করবে?
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী