গত মার্চ মাসে যখন শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দুর্দশার খবর আমরা পেতে শুরু করি, তখন সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা আমাদের জন্য একটি ‘সংবেদনশীল’ বিষয়ে পরিণত হয়। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে নানা সূচকে এগিয়ে থাকা শ্রীলঙ্কার এই পরিণতি আমাদের বিস্মিত করেছে। সেখানকার অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে এখানকার অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ তখন বাংলাদেশের ঝুঁকির দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এ নিয়ে যেসব লেখালেখি পড়েছি বা আলোচনা শুনেছি, তাতে কেউই এটা বলেননি যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে। তাঁরা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি, উন্নয়ন নীতি-কৌশলের নানা সমস্যার দিক ও সেখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি তুলে ধরে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের সতর্ক করে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমাদের কী কী করা উচিত, সে পরামর্শও অনেকে দিয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের আলোচনা সরকারের লোকজন ও তাঁদের সমর্থকদের তখন ভালো লাগেনি। ‘উন্নয়ন উন্নয়ন’ জিগিরের মধ্যে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আলোচনায় বাংলাদেশের প্রসঙ্গ বা তুলনা অনেকের কাছেই অপমানজনক মনে হয়েছে।
বোঝা যায়, দীর্ঘ দুই বছরের মহামারি ও ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা পরিস্থিতি যে কতটা পাল্টে দিয়েছে, সেই হিসাব-নিকাশ আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে তখন অতটা স্পষ্ট ছিল না। সামনে কী হতে যাচ্ছে, তা আঁচ-অনুমান করার দূরদৃষ্টিতে যে ঘাটতি ছিল, সেটা এখন টের পাওয়া যাচ্ছে। বাস্তবতা যে ভিন্ন এবং দুশ্চিন্তার যে কারণ রয়েছে, তা টের পেতে সরকার ও এর নীতিনির্ধারকদের সময় লেগেছে। শেষ পর্যন্ত ১৮ জুলাই যখন আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে ডলার বাঁচাতে ও জ্বালানির খরচ কমাতে কিছু উদ্যোগের কথা ঘোষণা করে, তখন বোঝা গেল বিষয়টি নিয়ে আর লুকোছাপা করার মতো জায়গায় সরকার নেই। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘উন্নয়ন’ ব্যয়েও কাটছাঁটের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। যেসব উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে, সেগুলোর অর্থ এখন হিসাব-নিকাশ করে ছাড়া হবে। কিছু প্রকল্প চলবে, কিছুর অর্থ বরাদ্দ কমবে, কিছু বন্ধ থাকবে। এরপর গত কয়েক দিনে বিভিন্ন পর্যায়ে খরচ কমানোর যে নির্দেশনা আসছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে যে পরিস্থিতি বেশ খারাপ।
এরই মধ্যে বিবিসির এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনের সূত্রে আমরা একটি তালিকা পেয়েছি। আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিভার বলেছেন, শ্রীলঙ্কা যে অভাবিত অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে, সেই একই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে পারে আরও কিছু দেশ। তিনি কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও ব্যয়বহুল অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য চীনের ঋণ গ্রহণ এবং আইএমএফ প্রধানের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বিবিসির সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এশিয়ার চারটি দেশ (লাওস, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশ) একই ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে। বিবিসির উল্লেখ করা ঝুঁকিপূর্ণ চারটি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের অবস্থা এরই মধ্যে শোচনীয় হয়ে পড়েছে। লেনদেন ভারসাম্যে ঝুঁকির মুখে থাকা পাকিস্তান ঋণখেলাপি হওয়া ঠেকাতে এমনকি রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রিরও উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি অধ্যাদেশ অনুমোদন করেছে দেশটির মন্ত্রিসভা। এই অধ্যাদেশে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিভিন্ন আইনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং কিছু বাধ্যবাধকতা যাতে মানতে না হয়, সেই বিধানও রাখা হয়েছে। পাকিস্তান কতটা বিপদে পড়েছে, তা এর মধ্য দিয়ে টের পাওয়া যাচ্ছে।
সংকট গভীর হওয়ার আগেই বাংলাদেশ পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। কৃচ্ছ্রতার নীতি গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে, উন্নয়ন প্রকল্পে কাটছাঁট করেছে, ঋণসহায়তা নেওয়ার পথ ধরেছে। শ্রীলঙ্কা থেকে পাওয়া শিক্ষা হয়তো বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট উতরে যেতে সহায়তা করবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা নিয়ে অর্থনীতির দুই অধ্যাপকের ‘রাজনৈতিক’ পর্যবেক্ষণগুলোকে আমরা কীভাবে উপেক্ষা করব?
বর্তমান বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতিতে অনেক দেশই আইএমএফের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করছে। সেই তালিকায় এখন বাংলাদেশও যুক্ত হয়েছে। লেনদেনে ভারসাম্য বজায় রাখা ও বাজেট সহায়তা হিসেবে আইএমএফের কাছে অর্থ চাওয়া হয়েছে। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, এর পরিমাণ ৪৫০ কোটি ডলারের মতো হতে পারে। পরিস্থিতির বদল বেশ দ্রুত হচ্ছে। গত মার্চ-এপ্রিলে সরকারের লোকজনের মুখে যা শোনা গেছে, এখন তা শোনা যাচ্ছে না। আমরা দেখলাম কত দ্রুত পাল্টে গেলেন আমাদের অর্থমন্ত্রী। গত সপ্তাহে (২০ জুলাই) ‘এই মুহূর্তে বিদেশি ঋণের প্রয়োজন নেই’ বলে ঘোষণা দেওয়ার পর এই সপ্তাহে আইএমএফের কাছে সহায়তা চেয়ে আবেদন করে বাংলাদেশ।
শ্রীলঙ্কার বিপর্যয় অনেক দেশকে সতর্ক হওয়ার ও আগাম ব্যবস্থা নেওয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকা একটি দেশ হিসেবেই বিবেচিত ছিল। কোনো একটি দেশ এমন একটি পর্যায়ে গেলে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে আর পতনের সুযোগ নেই। শ্রীলঙ্কা এই ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করেছে। আমাদের জন্য এটা এক বড় শিক্ষা। শুরুতে উপেক্ষার মনোভাব থাকলেও শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়েই যে শেষ পর্যন্ত আমাদের সরকার সতর্ক হয়েছে, নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছে, জাইকার কাছে সহায়তার অনুরোধ করেছে, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। শুধু আইএমএফ আর জাইকা নয়, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকেও সহায়তা নেওয়ার আলোচনা চলছে বলে আমরা জানতে পারছি। সেই হিসেবে শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা আমাদের বড় ধরনের সংকটে পড়া থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি শোচনীয় হওয়ার পর গত এপ্রিলে দুজন অর্থনীতিবিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। ওই সাক্ষাৎকার দুটির কিছু অংশ পাঠকদের আবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার বলে মনে করছি। কারণ, এসব আলোচনা তখন অনেকের কাছেই হয়তো অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল। দুজনের একজন ড. সেলিম রায়হান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক। তিনি তখন বলেছিলেন, ভুল অর্থনৈতিক নীতি, ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতি, গোষ্ঠীতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র ও দুর্নীতি একটি দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তার প্রমাণ শ্রীলঙ্কা।
আরেক জন ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ। তিনি কুয়ালালামপুরের মালায়া এবং মোনাশ মালয়েশিয়া ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক। শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন ছিল এ রকম: এই সংকটের এক দশক আগে যুদ্ধ-পরবর্তী শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সমৃদ্ধির পথে ছিল। এই পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে রাজনীতিবিদদের মধ্যে অতি মাত্রায় উচ্চাশা এবং অযৌক্তিক উদ্দীপনা তৈরি করে। সরকার জনপ্রিয় ও দৃশ্যমান হয়, এমন বৈদেশিক ঋণনির্ভর মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু প্রকল্প যথাসময়ে শেষ না হওয়া, এর বাণিজ্যিক অকার্যকারিতা, অর্থায়নের জন্য বিদেশি ঋণের নির্ভরতা এবং প্রতিকূল বৈশ্বিক পরিস্থিতি—সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
সংকট গভীর হওয়ার আগেই বাংলাদেশ পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। কৃচ্ছ্রতার নীতি গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে, উন্নয়ন প্রকল্পে কাটছাঁট করেছে, ঋণসহায়তা নেওয়ার পথ ধরেছে। শ্রীলঙ্কা থেকে পাওয়া শিক্ষা হয়তো বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট উতরে যেতে সহায়তা করবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা নিয়ে অর্থনীতির দুই অধ্যাপকের ‘রাজনৈতিক’ পর্যবেক্ষণগুলোকে আমরা কীভাবে উপেক্ষা করব?
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, গোষ্ঠীতন্ত্র এবং মেগা প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা ও অস্বাভাবিক খরচ—এসব রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান কীভাবে?
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক