প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ব্যর্থ ইস্তাম্বুল চুক্তি এবং ইউক্রেনে ভূখণ্ডের যে পরিবর্তন, তার ওপর ভিত্তি করে ইউক্রেনের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ইস্তাম্বুল চুক্তির ২০২২ সালের এপ্রিল মাসেই মৃত্যু ঘটে। সেই চুক্তির কি পুনর্জন্ম হবে? মৃত সেই চুক্তির ওপর ভিত্তি করে পুতিন কি সত্যিই ইউক্রেনের সঙ্গে একটি মীমাংসায় পৌঁছতে আগ্রহী?
আমরা কিন্তু এখন সেই ইস্তাম্বুল চুক্তির চেয়েও বড় চুক্তির কথা জানি। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে রুশ বাহিনী যখন বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিল এবং কিয়েভের চারপাশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল, সে সময় দুই পক্ষে একটি চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছেছিল।
দুই পক্ষই তখন চুক্তিটা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। চূড়ান্ত চুক্তির জন্য পুতিন ও জেলেনস্কির মধ্যে মুখোমুখি সমঝোতার দরকার ছিল এবং বেলারুশ ও ইস্তাম্বুল আলোচনায় ভূখণ্ড নিয়ে যে বিষয়গুলো অমীমাংসিত ছিল, সেগুলোর সমাধান করা দরকার ছিল। যাহোক, ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য চুক্তিটির বিরোধিতা করলে ইউক্রেন চুক্তি করা থেকে পিছিয়ে এসেছিল।
ইস্তাম্বুল চুক্তির মূল বিষয় ছিল ন্যাটোর মুক্ত একটা নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে ইউক্রেন। ইউক্রেনকে নিরপেক্ষকরণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ইউক্রেনকে রাশিয়া, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্য সদস্য রাষ্ট্র এবং ইসরায়েল, তুরস্ক, পোল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি ও কানাডা মিলে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করবে।
এই চুক্তির খসড়া নিয়ে যতটুকু জানা যায়, নিরাপত্তা–সংক্রান্ত বিধিটা ন্যাটো চুক্তির বিধি-৫–এর চেয়েও সুনির্দিষ্ট ছিল। নিরাপত্তার গ্যারান্টার প্রতিটি দেশ অন্য দেশের সহযোগিতা ছাড়াই নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে স্বাধীনভাবে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা দিতে পারবে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী হতে হবে আরও ছোট আকারের, অস্ত্রশস্ত্র থাকবে আরও কম এবং দূরপাল্লার কোনো অস্ত্র থাকবে না।
দুই পক্ষের ভূখণ্ড নিয়ে সবচেয়ে সংবেদনশীল ইস্যুটি হচ্ছে ক্রিমিয়া। চুক্তির খসড়ায় বলা হয়েছিল, ১০ থেকে ১৫ বছর পর দুই পক্ষ ক্রিমিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে ফয়সালা করবে। ক্রিমিয়া কি রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকবে, নাকি ইউক্রেনে যাবে সেই সিদ্ধান্ত তাদের নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। প্রসঙ্গক্রমে এই চুক্তির সারমর্ম হলো, ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ ও দেশটি থেকে ন্যাটোকে সরানোর বিনিময়ে পুতিন ক্রিমিয়ার ওপর একধরনের বাজি ধরতে রাজি হতে পারেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো সাম্প্রতিক নির্বাচন এবং যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচন এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে অদূর ভবিষ্যতে ইউক্রেনের জন্য সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে যেতে পারে। একইভাবে খারকিভের অঞ্চলের বাইরেও রাশিয়া আক্রমণ শুরু করতে পারে। যাহোক, সমঝোতার কথাবার্তা বাতাসেই কেবল ভাসছে, আয়নায় তার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে না।
ইউক্রেনের নিরাপত্তা গ্যারান্টি দেওয়ার ইচ্ছা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। সেটি করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের একটা চুক্তি করা লাগবে এবং সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন লাগবে; কিন্তু এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ন্যাটো সম্প্রসারণের প্রকল্পটি তাতে শেষ হয়ে যাবে।
বলা হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র এখন ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো সমঝোতার কথা ভাবছে না কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে রুশরা এখন জয় পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন ইউক্রেনকে আরও সাহায্য করার কথা ভাবছে, যাতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেন বড় কিছু অগ্রগতি অর্জন করতে পারে। একই সঙ্গে রাশিয়ায় ভেতরে ইউক্রেন যেন হামলার পরিমাণ বাড়াতে পারে।
ওয়াশিংটন ভেবে নিতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো যুদ্ধবিমান এবং সম্ভবত নতুন সেনাসহ বিশাল যে সমর্থন দিতে যাচ্ছে, তাতে রাশিয়া তাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেবে; পিছু হটে যেতে বাধ্য হবে। সে পরিস্থিতিতে একটা সমঝোতার পথ খুলে যাবে এবং যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাশিয়া রাজি হয়ে যাবে।
একটা যুদ্ধবিরতি হলে, ইউক্রেন তাদের সেনাবাহিনীর জনবল ও অস্ত্রশস্ত্রের ঘাটতি পূরণ করতে সময় পাবে। সাময়িক এই অচলাবস্থা ইউক্রেনের জন্য ভবিষ্যতের একটা সুযোগ এনে দেবে। সে ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই রুশ বাহিনীকে তাদের ভূখণ্ড থেকে বের করে দিতে পারবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটনের এই ভাবনা কাজে আসবে বলে মনে হয় না। আগের চেয়ে কিছুটা ধীরগতি হলেও রুশদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এটা সত্যি যে কেউই জানে না ইউক্রেনের ব্যাপারে পুতিনের সংকল্প আসলে কী এবং যুদ্ধে রুশরা কতটা মূল্য দিতে রাজি।
সম্প্রতি সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক পুতিনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ইউক্রেনে ন্যাটো অস্ত্র ও সেনা পাঠানোর আগেই কেন রাশিয়া তাদের আক্রমণের তীব্রতা বাড়াচ্ছে না? এর উত্তরে পুতিন বলেন, রাশিয়ার সেনারা একটা পরিকল্পনা থেকেই বর্তমান গতিতে সামনে এগোচ্ছে। সংক্ষেপে বলা যায়, যুদ্ধ নিয়ে তিনি কোনো তাগিদ বোধ করছেন না।
ইস্তাম্বুল চুক্তি ব্যর্থ হওয়ার পর ন্যাটোর দেশগুলো ইউক্রেনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে। কোনো দেশ অবশ্য ইউক্রেনের প্রতিরক্ষার জন্য সেনা পাঠানোর অঙ্গীকার করেনি। যুক্তরাষ্ট্রও নিজেদের মতো করে একটা নিরাপত্তা চুক্তি সূত্রবদ্ধ করতে পারেনি। কেননা, বাইডেন প্রশাসনের পক্ষে কংগ্রেসে এ রকম কিছু উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
পুতিন ভালো করেই জানেন যে নিরাপত্তার গ্যারান্টির ওপর ভিত্তি করে কোনো চুক্তি হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সেটি মেনে নেবে না। এর মানে হলো ইস্তাম্বুল চুক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা কোনো মডেল এখানে মানানসই হবে না।
প্রায় নিশ্চিতভাবেই পুতিন জানেন যে বর্তমানে ইউক্রেনের সঙ্গে কোনো চুক্তির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ইস্তাম্বুল চুক্তির ওপর ভিত্তি করে কোনো চুক্তিতে আসতে গেলেই নিরাপত্তার গ্যারান্টির বিষয়টি সামনে চলে আসে। এ ছাড়া রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনের বেশ কিছুটা ভূখণ্ড নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। সেসব ভূখণ্ড যদি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন আসে, তাহলে নিজ দেশের ভেতরে পুতিন বড় ধরনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো সাম্প্রতিক নির্বাচন এবং যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচন এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে অদূর ভবিষ্যতে ইউক্রেনের জন্য সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে যেতে পারে। একইভাবে খারকিভের অঞ্চলের বাইরেও রাশিয়া আক্রমণ শুরু করতে পারে। যাহোক, সমঝোতার কথাবার্তা বাতাসেই কেবল ভাসছে, আয়নায় তার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে না।
স্টিফেন ব্রায়েন, যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সাবেক কর্মকর্তা
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত