ইন্টেরিমের রোজা-ঈদ এবং ‘মধু মধু মধু...’

ঈদ আনন্দমিছিলে এক শিশুছবি : প্রথম আলো

এবার পবিত্র রমজান মাস যখন শুরু হলো, তখন অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখলেন ‘ফ্যাসিবাদমুক্ত রমজান’। একইভাবে ঈদের দিনেও লিখলেন, ‘ফ্যাসিবাদমুক্ত ঈদ’। এর মানে তো বোঝাই গেল, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এবার পবিত্র রমজান মাস ও ঈদুল ফিতর এসেছে আলাদা তাৎপর্য নিয়ে।

পনেরো বছর ধরে যে রাজনৈতিক পরিবেশে পবিত্র রমজান মাস ও ঈদ উদ্‌যাপন করা হলো, সেখান থেকে এবারের আনুষ্ঠানিকতা বা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বা উদ্‌যাপন ভিন্নতরই বলতে হবে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধানী অন্তর্বর্তী সরকার আসলে এবারের রমজান ও ঈদে মানুষকে কতটা স্বস্তি দিতে পারল, সেটি অবশ্যই আলোচ্য বিষয় হওয়ারই কথা। হয়েছেও।

রোজায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, ঈদযাত্রা, সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স—সবকিছু মিলিয়ে এবার রমজান পালন ও ঈদ উদ্‌যাপন নিয়ে বেশ প্রশংসিত হচ্ছে অন্তর্বর্তী বা ইন্টেরিম সরকার। প্রশংসার আগে সমালোচনার দিকগুলো উল্লেখ করা দরকার বলে মনে করি।

এবারের রমজানে দিনের বেলায় দোকানপাট খোলা-বন্ধ রাখার পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান, মোরাল পুলিশিংয়ের বিষয়গুলো বেশিই দেখা যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। মূলত কথিত ‘তৌহিদি জনতা’ ক্ষমতাচর্চারই প্রকাশ ঘটে এখানে। মাজার-ওরসে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় এই তৌহিদি জনতার নাম এসেছে বারবার। রমজান মাসের শুরুর আগে-পরেও মাজারে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

মাগুরায় শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনও দেখলাম আমরা। এরপর বেতন–ভাতার দাবিতে শ্রমিকের আন্দোলন ও অসুস্থ হয়ে এক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটল। উভয় আন্দোলনে পুলিশের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এসব ঘটনায় সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টিও সামনে এসেছে।

জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদি আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা যে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি সেই দেশ হোক কৃষকের, শ্রমিকের, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের। তাদের অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কিংবা দায় ও দরদের সমাজ গঠন কি আদৌ সম্ভব?

পবিত্র রমজানের আগমন মুহূর্তে অন্যান্য দেশের প্রেক্ষাপটে দুটি বিষয় এখানে আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। একটা হলো: পবিত্র মাসটিকে আনন্দ উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেওয়া। আরেকটি হলো: দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ। দুটিই যেন এ দেশের জন্য ‘বেমানান’। এখানে উল্টোটিই ঘটে। অন্যান্য মুসলিম দেশে, এমনকি মুসলিম সংখ্যালঘুর ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতেও সামাজিক পরিসরে আনন্দ উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে রমজান মাসকে বরণ করে নেওয়া হয়। এমনকি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজার মানুষদেরও আনন্দের কমতি ছিল না রমজানের আগমনে। এমন সংস্কৃতি এ অঞ্চলে একসময় ছিল চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে রোজা শুরুর হওয়ার আনন্দে। কংক্রিটের নগরীর ব্যস্ততম জীবনযাপনের প্রতিযোগিতায় সেই ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। আর ধর্মীয় বা সামাজিক নানা নতুন-পুরোনো বিধিনিষেধ তো আছেই।

এবার কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম দেখা গেল। রমজান মাসকে বরণ করে নিতে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে নারী-শিশু মিলে রংবেরঙের ফেস্টুন নিয়ে র‍্যালি হয়েছে। সামনের বছরগুলো হয়তো এর পরিসর বা ব্যাপকতা আরও বাড়বে।

বিরোধী রাজনীতি ও মানুষের চিন্তার স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে করতে আওয়ামী লীগ সরকার এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, ক্যাম্পাসগুলোয় ইফতার পার্টি পর্যন্ত করা যেত না। বিগত বছরে, বিশেষ করে গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অনেক ক্যাম্পাস ও এলাকায় ইফতার পার্টিতে হামলা করেছিল ছাত্রলীগ। এবার ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ভীতিমুক্ত ইফতার পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্যাম্পাসে মাসব্যাপী গণ–ইফতারের আয়োজন করেছিল। রমজানকে ঘিরে ছিল নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনও। ইসলামী সংগীতের আসর, পুঁথিপাঠ, ইফতার-সাহ্‌রির আঞ্চলিক ঐতিহ্যের খাবারের প্রদর্শনী, কাওয়ালির আসরের পসরা বসেছিল বিভিন্ন ক্যাম্পাসে।

যেকোনো উৎসবের ক্ষেত্রে পৃথিবীজুড়ে একটা প্রবণতা দেখা যায়, দ্রব্যমূল্যে বা পণ্য ছাড় দেওয়া। আর আমাদের এখানে রোজা বা ঈদের আগে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে। ভোজ্যতেল ও চাল ছাড়া এবারের অধিকাংশ পণ্য ও শাকসবজির দাম অবিশ্বাস্যভাবে কম ছিল। উপযুক্ত আবহওয়ার কারণে এবারের শাকসবজির ব্যাপক ফলন হয়েছে। দুঃখজনক হচ্ছে, বেশির ভাগ কৃষিপণ্যের এতটাই দাম পড়ে গেছে যে ভোক্তা বেশ উপকৃত হলেও মাথায় হাত পড়েছে কৃষকের। সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণের জন্য এতটাই খুশি যে কৃষকের দুঃখের বিষয়টি বরাবরের মতো গুরুত্বহীনই থেকে গেল। সরকার যায়, সরকার আসে কৃষকের সুদিন আর ফিরে না, আদৌ ফিরবে কি না, জানি না।

কৃষিপণ্যের বাইরে বাকি নিত্যপণের দাম কমার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা সরকারের। ছোলা, মটর ডাল, মসুর ডাল, খেজুর, চিনি, গম, সয়াবিন ও পাম তেল ইত্যাদি পণ্য আমদানিতে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে পারায় সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর সুযোগ ছিল না। অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার তিন শতাধিক বেশি প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানি করেছে। এতে পণ্য আমদানি গতবারের তুলনায় ৯ লাখ টন বেড়ে সাড়ে ৩৫ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রোজার চাহিদার চেয়ে বাড়তি পণ্য আমদানি হয়েছে এবার। এতে রোজার পণ্যের কোনোটির দাম কমেছে, কোনোটি স্থিতিশীল রয়েছে। তবে চাল ও ভোজ্যতেলের সিন্ডিকেট বা বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব বিস্তারে সেই অর্থে কিছু করতে পারেনি সরকার। অন্যান্য পণ্যের দাম কম থাকায় ভোক্তারা এ দুটি প্রধান পণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি একপ্রকার সইয়ে নিয়েছে বললে চলে।

নিত্যপণ্যের মধ্যে কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ বা ইফতারি তৈরির আইটেমগুলোর দাম কম থাকায় অনেকে আগের বছরগুলোর পরিস্থিতির নিয়ে হাস্যরস করেছেন। মানে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন খাদ্যের রেসিপি দেওয়ার বিষয়গুলো হয়ে ওঠে ট্রল বা মিমের বিষয়বস্তু।

ফলফলারির দামও ছিল তুলনামূলক কম। মনে আছে, গত বছর গোটা রমজান অনেককে পার করতে হয়েছে খেজুরহীন ইফতারের মধ্য দিয়ে, আমার নিজেরও একই করুণ অভিজ্ঞতা ছিল। এবার খেজুরের দামও ছিল তুলনামূলক কম। সরকার খেজুর আমদানিতে বাড়তি খরচ কমিয়ে দিয়েছে। তার সুফল পেয়েছেন এবার নাগরিকেরা। অধিক ফলন ও চাঁদাবাজের দৌরাত্ম্য কম থাকায় এবার রমজানে তরমুজের দামও ছিল অবিশ্বাস্যরকম কম। এ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যতম আলোচিত চরিত্র হয়ে ওঠে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের এক তরমুজ বিক্রেতা মোহাম্মদ রনি। কেটে লাল তরমুজ দেখিয়ে তাঁর চিৎকার: ‘ওই কীরে, ওই কীরে...মধু, মধু, মধু, রসমলাই, রসমলাই।’

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল সেই রনি, তাঁর সেই বিজ্ঞাপনমূলক ডায়ালগ। আনকোরা ভাষায় উপমা ব্যবহারের ইনোভেটিভ আইডিয়ার এই বিজ্ঞাপনমূলক ডায়ালগ হাওয়ার বেগে ছড়িয়ে যায়। যেকোনো কিছুতেই মানুষ এই ডায়ালগ দেওয়া শুরু করেছে এখন। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত—সব ধরনের মানুষ। যেকোনো বিক্রিতেই এই বিজ্ঞাপন এখন হিট। ফার্মগেটে ঝালমুড়ি বিক্রি থেকে শুরু করে নিউমার্কেটে কাপড় ব্যবসায়ীর মুখে মুখে রনির সেই মধুময় বাক্য।

খ্যাতির বিড়ম্বনাও চরমভাবে পেতে হলো রনিকে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের অপেশাদারি আচরণের কারণে। কিন্তু রনির এই ডায়ালগ ছিল এবারের ঈদে আলাদা এক আনন্দময় বা রসময় উপাদান।

ঈদের শপিংয়ে মার্কেটে মার্কেটে বরাবরের মতোই ছিল ভিড়। ছিনতাইয়ের আতঙ্ক কমে আসাটা স্বস্তিদায়ক ছিল। রোজার শেষের দিনগুলোতে মানুষ সাহ্‌রির আগপর্যন্ত শপিং করে ঘরে ফিরতে পেরেছে নিরাপদে। আবার ডাকাতির আতঙ্কে অনেক মানুষ এবার ঈদে ঢাকা শহরে থেকে গেছেন বা গ্রামে ঈদ করতে যাননি, এটিও সত্য। এই নিরাপত্তাহীনতা তৈরিতে পুলিশের ব্যর্থতা তো আছেই। কারণ, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর এখনো পুলিশকে কার্যকরীভাবে সচল করা যায়নি। ছিনতাইকারী, ডাকাতদের ধরা হচ্ছে; দ্রুত তারা ছাড়াও পেয়ে যাচ্ছে। এইভাবে নাগরিকদের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করবে ইন্টেরিম সরকার, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

এবারের ঈদের আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছে লম্বা ছুটি। মানুষ ধাপে ধাপে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলো ছেড়েছে পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করতে। এতে সড়কের ওপরে, ট্রেন বা বাসের ওপরে কম চাপ পড়েছে।

ঈদযাত্রায় সরকারের কিছু পদক্ষেপ বা তদারকিও সুফল দিয়েছে মানুষকে। আগের মতো এবারও ঈদের আগে কয়েক জায়গায় কমিউটার ট্রেন চালু করেছে। ঈদের টিকিটে কালোবাজারি তুলনামূলক কম হয়েছে। টিকিট পেতে সারারাত ধরে মানুষকে রেলস্টেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়নি। ট্রেনের চিরায়ত যে ভয়াবহ ভিড়, বিশৃঙ্খলাও এবার কম ছিল।

শিশুদের আনন্দ ছিল চোখে পড়ার মতো
ছবি : প্রথম আলো

ঈদযাত্রায় বাড়তি ভাড়ার বিড়ম্বনা বা অনিয়ম এবারও ছিল। তবে এবার অনেক জায়গায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন-বিআরটিসির কর্মকর্তারা বাড়তি ভাড়া বন্ধে যে ভূমিকা রেখেছেন, তা অতীতে দেখা যায়নি বললেই চলে। বিআরটিসির ‘মাসুদ’ও ভালো হয়ে গেছেন দেখলাম। স্টেশনে স্টেশনে অভিযান চালিয়েছেন তিনি।

সড়কে শৃঙ্খলা থাকায় এবার অনেক মানুষ নিরাপদে ঈদ উদ্‌যাপন করতে ফিরতে পেরেছেন পরিবারের কাছে, স্বজনের কাছে, আপনজনের কবরের কাছে। প্রতিবছর ঈদযাত্রায় যে পরিমাণ সড়ক দুর্ঘটনা দেখতে হয়, সেটাও তুলনামূলক কম দেখা গেল। এটা নিঃসন্দেহে বড় স্বস্তিদায়ক ব্যাপারই ছিল। কিন্তু একসঙ্গে তিন ভাইয়ের মৃত্যুর জানাজায় তিন সন্তানের খাটিয়া ধরে মায়ের আর্তচিৎকার এই স্বস্তিদায়ক বিষয়কে ম্রিয়মান করে দেয় যেন। একজন মায়েরও কোল খালি হবে না, এমন নিরাপদ সড়ক আমাদের কবে হবে?

যাক, ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নানা জল্পনা–কল্পনা, সৌদি আরব-মিসরের মতবিরোধের মধ্য দিয়ে অবশেষে ঈদের চাঁদের দেখা পেলাম আমরাও। সেই সঙ্গে বাজল প্রায় শত বছর আগে কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দীনের অমর সৃষ্টি ‘ও মন রমজানের ঐ রোজা শেষে এল খুশীর ঈদ’। বাঙালি মুসলমানের ঈদ উৎসবের অপরিহার্য এই গান ছাড়া যে ঈদের খুশিই অধরা থেকে যায়।

এবার রাষ্ট্রীয়ভাবে ঈদের নামাজের জামাত ছাড়াও ঈদ–আনন্দ আয়োজন বা সাংস্কৃতিক আয়োজন করা হলো। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঈদ র‍্যালি আমরা দেখতে পেলাম আবারও ফিরে এসেছে নতুন রূপে, নতুন প্রজন্মের হাত ধরে। শুধু ঢাকা শহর নয়, আরও অন্যান্য শহরেও ঈদ র‍্যালি হলো। ঈদের নামাজের জামাত শেষে অনেক মানুষ নারী-শিশু সবাই মিলে পরিবারসহ যোগ দিল ঈদ র‍্যালির বাহারি আয়োজনে। ঈদের দিনে এই স্বতঃস্ফূর্ততা, এই খুশির বহিঃপ্রকাশ, এ উচ্ছ্বাসের জোয়ার নিকট অতীতে আমরা কবে দেখতে পেয়েছিলাম! দীর্ঘদিন ভয়ের রাজত্ব ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকুচিত পরিবেশে থাকা মানুষ যেন মুক্ত পাখি হয়ে ডানা মেলে দিল ঈদের রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে। আর এমন খুশির দিনে জুলাইয়ের শহীদদের আমরা স্মরণ করি৷

ওহ, চানরাতের কথা তো বলাই হলো না। চাঁদ দেখার ঘোষণায় গোটা দেশের এলাকায় এলাকায় মহল্লায় যে উদ্‌যাপন দেখা গেল, তা ছিল অভূতপূর্ব। সন্ধ্যার পর ‘ঈদ মোবারক’ লেখা ফেস্টুন নিয়ে র‍্যালির আয়োজন, কাওয়ালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, মিষ্টি বিতরণ, শিশুদের চকলেট উপহার, নারীদের মেহেদি উৎসব, ব্যান্ড পার্টিসহকারে ঈদের আগমনকে স্বাগত জানিয়ে স্লোগানে মুখর ছিল মহল্লা বা এলাকাগুলো। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর কমিউনিটি চর্চার আরেকটি নিদর্শন দেখতে পেলাম আমরা। উৎসবকে ঘিরে মানুষে মানুষে হৃদ্যতা ও সৌহার্দ্য বাড়ার মধ্য দিয়ে সমাজে সহিষ্ণুতা, ভালোবাসা ও পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের চর্চা হবে, এটাই তো অন্তিম চাওয়া আমাদের।

চানরাতের র‍্যালির আনন্দ কেমন উপভোগ্য ছিল, তা চট্টগ্রামের এক তরুণীর মুখেই শোনা যাক। নগরীর আন্দরকিল্লা মোড়ে সাবরিনা নবী সাবাহ দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে চানরাতের র‍্যালিতে যোগ দিয়ে বলেন, ‘এত বছ‌রের জীব‌নে আমার দে‌শে প্রথম ঈদ মি‌ছিল দেখলাম। সন্তান‌দের দেখালাম। নাম না–জানা সক‌লে সকল‌কে শু‌ভেচ্ছা জানা‌চ্ছে, বাচ্চা‌দের ১০, ২০ টাকা বক‌শিশ দি‌চ্ছে, চ‌কলেট বি‌লি কর‌ছে। সঙ্গে চাঁদ–তারা খেলনা, ঈদ কার্ড আরও কত কী যে পেল বাচ্চারা! জানতামই না, এত সুন্দর হ‌তে পা‌রে ঈদ মি‌ছিল! কত আনন্দ সবার চো‌খে! আল্লাহ এই আনন্দ অক্ষুণ্ন রাখুক। আমার দে‌শের সব মানুষ‌কে ভালো রাখুক। বি‌শ্বে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক দেশে চাঁদ দেখার পর এমন ঈদ মি‌ছিল হয়। আমার দে‌শে প্রথম দেখ‌ছি। সবার জন্য এল খুশির ঈদ। আমা‌দের সবার ঈদ।’

আসলেই এটাই তো আমাদের ঈদ। এমন ঈদই আমরা আজীবন কামনা করেছি যেন। এমন ঈদ উদ্‌যাপনই সামনের বছরগুলোতে জারি থাক। সেই ঈদে বেতন বোনাস না পেয়ে শ্রমিকদের কান্না এবং তাঁদের নিয়ে পুঁজিপতি শোষক মালিক, রাষ্ট্র ও সরকারের ছলচাতুরিও আমাদের দেখতে না হোক। জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদি আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা যে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি সেই দেশ হোক কৃষকের, শ্রমিকের, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের। তাদের অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কিংবা দায় ও দরদের সমাজ গঠন কি আদৌ সম্ভব?

রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই-মেইল: rafsangalib1990@gmail.com