যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলসের (ওটিইএক্সএ) সর্বশেষ তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে গত ১০ মাসে পোশাক রপ্তানি উল্লেখযোগ্য আকারে হ্রাস পেয়েছে। এ সময়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও ভিয়েতনামের রপ্তানি বেড়েছে। ৫৫ বিলিয়ন ডলারের এ শিল্পের মাধ্যমে তিন দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন হয়ে দেশটি দরিদ্র থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে শিল্পটি অনিশ্চয়তার সম্মুখীন।
ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বড় ব্র্যান্ড আগামী মৌসুমের পোশাকের জন্য অন্যত্র চলে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে, যারা ডিজনি, ওয়ালমার্ট ও অন্যান্য বৈশ্বিক পোশাকপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এ অবস্থায় বাংলাদেশের শুধু পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরশীল না থেকে অন্যান্য শিল্পের উন্নতিতেও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারলে বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতি, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ও দ্রুত ভোক্তাদের পছন্দের পরিবর্তনে উদ্ভূত সমস্যার ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের অন্যতম খাত কৃষি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০২৪ সালের বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশকে মারাত্মক বন্যার সম্মুখীন হতে হয়। যার কারণে প্রায় ১ দশমিক ১ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল নষ্ট হয়, যার মূল্য প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে চালের অভাবের পাশাপাশি চালের দামও বেড়েছে। পরিণামে সার্বিকভাবে বেড়েছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা। সেই সঙ্গে বন্যার কারণে ১৪ লাখ কৃষক বাসস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে জীবনযাপনের ঝুঁকিও প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতেও বড় অবদান রাখে। ২০২৪ সালে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি ডলার রেটের ৯ শতাংশ বৃদ্ধি এবং শেষ পাঁচ মাসে মুদ্রা পাচারের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার কারণে সম্ভব হয়েছে।
যদিও এই প্রবাসী আয় লাখ লাখ পরিবারের অস্তিত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; দেশের উন্নতির জন্য প্রবাসী আয়ের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা দেশকে ভবিষ্যতে অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হলে বা প্রবাসী আয় প্রদানকারী দেশগুলো তাদের নীতি পরিবর্তন করলে দেশে অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।
তাই দেশের এই প্রধান খাতগুলো, অর্থাৎ পোশাকশিল্প, কৃষি ও প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভর না করে অন্যান্য খাতের উন্নতিতেও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। যেমন প্রযুক্তি, উৎপাদন ও সেবা খাতের মতো খাতে বৈচিত্র্যকরণ প্রধান খাতের বাইরেও প্রবৃদ্ধি বজায় রাখবে এবং প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করবে। সর্বোপরি বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতার বিরুদ্ধে স্থিতিশীলতা আনয়নে একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে গত বছরগুলোয় ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। ২০২৯ সালের মধ্যে এটি ৩ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষেত্রে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানো হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রকারের স্টার্টআপ গড়ে তুলতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রের সার্বিক উন্নতির জন্য সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন, সংশ্লিষ্ট শিক্ষায় ও প্রশিক্ষণে বিনিয়োগের প্রয়োজন, যা দেশি ও বিদেশি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আকৃষ্ট করবে।
২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস, যেমন সূর্য, বাতাস, জলবিদ্যুৎ ও জৈব শক্তির মোট উৎপাদনক্ষমতা ছিল ১ হাজার ১৮৩ মেগাওয়াট, যা দেশের মোট উৎপাদনক্ষমতার প্রায় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সূর্য ও বায়ুর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শক্তি নবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব হবে। জার্মানি ও চীন নবায়নযোগ্য শক্তি সফলভাবে উৎপন্ন করছে এবং প্রচুর বিনিয়োগ করছে, যা বাংলাদেশ অনুসরণ করতে পারে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিলম্ব এবং খরচ কমাতে শুল্ক বিভাগের ব্যবস্থা উন্নত করা দরকার। বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ পণ্যের শুল্কের হার ১৫ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া উচ্চ শুল্ক ও রপ্তানিবিরোধী নীতি নতুন খাতের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সেই সঙ্গে সীমান্তে বাণিজ্যপ্রক্রিয়া যাতে দ্রুততার সঙ্গে সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়, সে ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভ্যালু চেইন অধিকতর উন্নত হবে।
বাংলাদেশের পর্যটন খাতে ২০২৪ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ যৌগিক বার্ষিক বৃদ্ধি হওয়া সম্ভব। এ খাত ব্যাপক সম্ভাবনাময়। এখানে কক্সবাজার, শ্রীমঙ্গল, সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা, সুন্দরবন, রাঙামাটি, বান্দরবান প্রভৃতি স্থানে পর্যটনের বেশ ভালো ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূ্র্ণ বিভিন্ন স্থাপনা ছাড়াও বাংলাদেশে আরও অনেক উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যেখানে পর্যটনের ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীভিত্তিক পর্যটনও অপার সম্ভাবনাময় একটি পর্যটন খাত। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সঠিকভাবে প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম প্রধান পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
এর ফলে হোটেল, পরিবহন এবং সংশ্লিষ্ট সেবা খাতের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
উৎপাদন খাতে ২০২৪ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে ৩ দশমিক ৭২ শতাংশ বৃদ্ধির হার অর্জন হলে ৭৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের বাজার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উচ্চমূল্যের উৎপাদন খাত, যেমন ইলেকট্রনিকস, অটোমোবাইল ও কেমিক্যাল খাতের জন্য প্রয়োজন দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে বৈদেশিক বিনিয়োগ।
কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণের পথে বেশকিছু বাধা রয়েছে। প্রথমত, সার্বিকভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এরপর রয়েছে রাস্তায়, সমুদ্রবন্দরে, রেলপথে যাতায়াতব্যবস্থার উন্নতি ও সার্বিক নিরাপত্তা। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বিক যোগাযোগের জন্য উন্নত ইন্টারনেটের ব্যবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো যাতে ঠিকমতো সেবা পায়। আইটি সেক্টর, ডিজিটাল সেবা ও ই-কমার্স সম্পূর্ণরূপে সবার কাছে পৌঁছানোর জন্য গতিশীল ইন্টারনেটের ব্যবস্থা প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিলম্ব এবং খরচ কমাতে শুল্ক বিভাগের ব্যবস্থা উন্নত করা দরকার। বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ পণ্যের শুল্কের হার ১৫ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া উচ্চ শুল্ক ও রপ্তানিবিরোধী নীতি নতুন খাতের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সেই সঙ্গে সীমান্তে বাণিজ্যপ্রক্রিয়া যাতে দ্রুততার সঙ্গে সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়, সে ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে বাংলাদেশের বৈশ্বিক ভ্যালু চেইন অধিকতর উন্নত হবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়ন একটি বিশেষ বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, ব্যাংকের ঋণদানের কঠোর শর্তাবলি ও উচ্চ সুদহার উদ্যোক্তাদের ব্যবসার সম্প্রসারণে বাধা সৃষ্টি করে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য সহজভাবে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা প্রয়োজন, যাতে ব্যবসাগুলোর দ্রুত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ হয়। ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে এটি আরও সহজে অর্জন করা যেতে পারে। একত্রে এসব অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাণিজ্যে বাধা কমাতে, রপ্তানিতে বৈচিত্র্যকরণ বাড়াতে এবং শিল্পগুলোর প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
এরপর রয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার, যেটি অত্যন্ত প্রয়োজন। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বহুমাত্রিক ও সৃজনশীল করে তুলতে হবে। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তি ও উন্নত উৎপাদন খাতের চাহিদা পূরণের জন্য দক্ষ কর্মশক্তি তৈরিতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সিপিডিতে বাংলাদেশে প্রযুক্তিগত শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও রূপান্তরের জন্য একটি উচ্চস্তরের কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছেন।
রাজনৈতিক ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কারণে প্রতিবন্ধকতাও বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করে। দুর্নীতি, প্রশাসনিক জটিলতা ও অস্থিতিশীল নীতিমালা ব্যবসার অনুকূল পরিবেশকে অনিশ্চিত করে তোলে, যা বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করে।
বাংলাদেশে টেকসই ও স্থিতিশীল অর্থনীতি একত্রে নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকরণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আলোচিত খাতগুলোর সংস্কার করতে পারলে দেশের বাইরের অর্থনৈতিক প্রভাবে কম প্রভাবিত হবে। নীতিনির্ধারকদের এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যেমন উচ্চ শুল্ক ও রপ্তানিবিরোধী নীতির সংস্কার। এভাবে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনয়নের মাধ্যমে শুধু যে বাংলাদেশের মানুষ উপকৃত হবে তা নয়, বরং একুশ শতকের দ্রুত পরিবর্তনশীল এই বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও স্বাবলম্বী একটি দেশ হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হবে।
শেখ আফনান বিরাহীম গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটিং সায়েন্স মাস্টার্স প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত