দেশে একটা সরকার পরিবর্তন হয়েছে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। এই ক্ষমতাচ্যুতিটা খুব স্বাভাবিক অবস্থায় হয়নি। নির্বাচন কিংবা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ তারা করেনি। বিশাল একটা গণ-আন্দোলনের মুখে সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। গণ-আন্দোলনটা প্রকৃতপক্ষে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এর কিছু পটভূমি রয়েছে।
এই গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা হয় জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে হাইকোর্ট বিভাগের একটা রায়কে কেন্দ্র করে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির নিয়োগে যে কোটাব্যবস্থা ছিল আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে সরকার বাতিল করে পরিপত্র জারি করতে বাধ্য হয়। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের মামলায় সেই পরিপত্রটা বাতিল করা হয়। অর্থাৎ, ৫৬ শতাংশ কোটা আবার বলবৎ হয়। এই রায়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশায় বড় ধরনের আঘাত করে, তারা তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখতে শুরু করে। তারা আন্দোলন শুরু করে।
অন্যদিকে সরকারের দিক থেকে আপিল বিভাগে আবেদন করার যে পদক্ষেপ, সেটি ছিল শ্লথ। আপিল বিভাগের প্রতিকার পাওয়া যাবে সেই আস্থাও শিক্ষার্থীরা রাখতে পারছিলেন না। এই পর্যায়ে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন থেকে ফিরে এসে যে সংবাদ সম্মেলন করেন, সেখানে কিছু মন্তব্য ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপমানসূচক। এই বক্তব্য ঘিরে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, তার সরকারের সময়-মুক্তিযোদ্ধা বনাম রাজাকার—একটা বড় বিভাজনরেখা টেনে গোটা জাতিকে বিভক্ত করে ফেলে।
এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা দিলেন, ছাত্রলীগই আন্দোলনকে মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট। দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে ছাত্রলীগ ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে আসছিল, তাদের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র অবস্থায় লেলিয়ে দেওয়া হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন যাঁরা করছিলেন, তাঁরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করছিলেন। কিন্তু তাঁদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকলে সরকার কারফিউ জারি করে ও সামরিক বাহিনীকে তলব করে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বসে কোটা সংস্কারের ব্যাপারে একটা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত দেন। কিন্তু সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়ের মতো সেটা অনেক দেরি হয়ে গেছে।
সরকারের সহিংস নীতির কারণে প্রায় চারশ মানুষ নিহত হয়, আহত হয় আরও কয়েক হাজার। গ্রেপ্তার করা হয় ১২ হাজারের বেশি মানুষকে। তাতে ছাত্র ও নাগরিক সমাজ আরও বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সর্বশেষ গত রোববার দলীয় কর্মসূচি দিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজনকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়। তারা সশস্ত্রভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে। এটা করতে গিয়ে গোটা ব্যবস্থাটা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল না। শেষে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। বিলুপ্ত হয় সরকার।
পরিস্থিতি এ অবস্থায় আসার পেছনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পটভূমিও রয়েছে। ২০০৮ সালের শেষে যে নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্য তিনি দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছিলেন, তাতে এ দেশের মানুষকে অনেক মাশুল দিতে হয়েছে।
অথচ ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন চালু করলেন। দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন করার স্বভাবতই বিরোধী দলগুলো মানেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দু-একটি দল ছাড়া কেউই অংশ নেয়নি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের ১৫৩ জন নির্বাচিত হন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিভিন্ন মহলের চাপে বিরোধী পক্ষ অংশ নিলেও আগের রাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নিয়ে আগের রাতেই সরকারি দলের প্রার্থীদের পক্ষে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়। ফলে নির্বাচনটাও ঠিকমতো হয়নি। আশা করা হয়েছিল, ২০২৪ সালের নির্বাচনটা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে। বিরোধী দল এ জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছিল এবং দাবি করেছিল একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপির একটা সমাবেশ ভন্ডুল করে দেয়। তাদের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
ফলে সর্বশেষ নির্বাচনটিও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। শুধু তা-ই নয়, বিরোধী দলগুলোর সভা-সমাবেশ করার সুযোগও বন্ধ করে ফেলা হয়। শেখ হাসিনা একটা কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা চালু করেন। এমনকি দলের মধ্যেও কোনো গণতন্ত্র নেই। আমাদের দেশে অন্য দলগুলোর অবস্থাও প্রায় একই।
শেখ হাসিনার আমলে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে মানুষ খুব সংক্ষুব্ধ হতে থাকে। ক্ষোভ প্রকাশের একটা মঞ্চ তারা খুঁজছিল। কোটা সংস্কার ঘিরে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেখানে এই সংক্ষুব্ধ মানুষেরা নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশের একটা পথ খুঁজে পায়। এ রকম একটা গণ-আন্দোলন যখন হয় তখন কেউ চাক বা না চাক বিভিন্ন গোষ্ঠী সেখানে যুক্ত হয়, তাদের বিভিন্ন এজেন্ডাও থাকে।
পরিশেষে আন্দোলনটা সফল হয়েছে। সরকার পদত্যাগ করেছে। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে এখন একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়া দরকার এবং দেশের নিয়ন্ত্রণভার তাদের হাতে নেওয়া প্রয়োজন। বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য সামরিক বাহিনী আগে থেকেই মাঠে রয়েছে। সংখ্যা বাড়িয়ে এখন সেনাসদস্যদের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত নিয়োগ করা যায়। সেনাবাহিনীর সহায়তায় দ্রুত প্রশাসনব্যবস্থা চালু করা দরকার।
গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ঢুকে যেভাবে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে, সেটা ঘটতে দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর জাদুঘর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটা প্রতীক। সেটা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। বিভিন্ন জায়গায় ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের লোকদের বাড়িঘর ও স্থাপনায় আগুন দেওয়া হচ্ছে। পুড়িয়ে, পিটিয়ে অনেককে মেরে ফেলা হয়েছে। এসব সহিংসতা অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক।
ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গায় থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশের স্থাপনায় আক্রমণ করা হয়েছে। পুলিশকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। পুলিশ সম্পর্কে আমাদের অনেকের অনেক অভিযোগ থাকতে পারে। কিন্তু পুলিশ ছাড়া তো রাষ্ট্র চলবে না। এটা ঠিক, পুলিশের মধ্যে কিছু বিতর্কিত ব্যক্তি রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়েছেন। প্রয়োজনে তাঁদের আলাদা করে রাখতে হবে। এ ছাড়া কারাগার ভেঙে আসামি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কারাগার একটা রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতীক। এটি কেপিআই স্থাপনা। অবিলম্বে কারাগারগুলোয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগ করে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার।
দেশে যদিও এখন একজন রাষ্ট্রপতি আছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সোমবার দুপুর থেকে দেশে একটা সরকার অনুপস্থিত। সামরিক বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরায় চালুর জন্য পুলিশকে সহায়তা করতে হবে। কিন্তু সবার আগে দরকার একটা সরকার প্রতিষ্ঠা। যাঁদের রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এ রকম ব্যক্তিদের নিয়ে দ্রুত সরকার গঠন করতে হবে। অরাজকতা যদি একবার ছড়িয়ে পড়ে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়।
সোমবার দুপুরে যতটা আনন্দিত হয়েছিলাম, বিকেল থেকে সেই আনন্দটা বিষাদের দিকে যাচ্ছিল। মঙ্গলবার সকালের দিকে সেই বিষাদের ব্যাপ্তিটা আরও ব্যাপকতর হয়ে হতাশার দিকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এত বড় আন্দোলন যাঁরা সফল করেছেন, তাঁদেরও বিরাট দায়িত্ব রয়েছে।
কোটা সংস্কারে তাঁদের যে দাবি, সেটা তো আগেই সফল হয়েছে। সর্বশেষ তাঁদের দাবি ছিল, বাংলাদেশ যেন নতুনভাবে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করতে পারে, একটা অন্তর্বর্তী সরকার যেন গঠিত হয়। তাদের মূল দায়িত্ব সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। এর মাধ্যমে তাদের দায়িত্বটা শেষ করতে হবে। তখনই তাদের আন্দোলনটার সফল পরিসমাপ্তি ঘটবে। এখানে বিরাট দায়িত্ব রয়ে গেছে আন্দোলনের সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষকদের।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা ও লুটপাটের খবর পাওয়া গেছে। এটা অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত, দুঃখজনক ঘটনা। দ্রুত এটা বন্ধ করতে হবে। ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটা গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র গঠনের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, তা থেকে কোনোভাবেই যেন আমরা বিচ্যুত না হই।
আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]