প্রায় ৩০৬ বর্গকিলোমিটারজুড়ে থাকা ঢাকা মহানগরে প্রায় ২ কোটি মানুষ বসবাস করে। এ জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু ও তরুণ এবং প্রায় ১০ শতাংশের বয়স ষাটোর্ধ্ব। শিশু ও তরুণদের বেড়ে ওঠার এবং বয়স্কদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য পার্ক প্রয়োজন।
এ বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আছে মাত্র ৬টি খেলার মাঠ, ২১টি পার্ক, ৪টি শিশুপার্ক এবং ৩টি ঈদগাহ। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আছে মাত্র ২৮টি পার্ক ও ১২টি খেলার মাঠ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১২১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪১টি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ।
একইভাবে অনেক ওয়ার্ডেই নেই পার্ক। এ কারণে বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে এসেছে ঢাকা। বসবাসের যোগ্য শহরগুলোর তালিকায় ১৪০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭। পর্যাপ্তসংখ্যক ও সুবিধাসম্পন্ন পার্কের অভাব এর একটি অন্যতম কারণ।
সংখ্যাগত অপ্রতুলতা ছাড়াও বিদ্যমান পার্ক ও খেলার মাঠগুলোতে রয়েছে সুযোগ-সুবিধা, পরিবেশ ও নিরাপত্তার অভাব। নগরীর পার্কগুলো একসময় বেশির ভাগই ছিল যৌনকর্মী, নেশাজাত দ্রব্য বিক্রেতা ও অন্তরঙ্গ যুগলদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র, বিধায় শিশুদের জন্য অনিরাপদ।
এসব পার্কের ভিড়ে একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হলো শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি পার্ক। পার্কটি আগে গুলশান সেন্ট্রাল পার্ক নামে পরিচিত ছিল। প্রায় সাড়ে আট একর জায়গার ওপর অবস্থিত পার্কটি আধুনিকায়ন শেষে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম নেতার নামে রাখা হয়েছে। আজকের লেখায় সংস্কার-পরবর্তী পার্কটির আকর্ষণ ও শহীদ নেতার উন্নয়ন দর্শনের সঙ্গে এর সাযুজ্য তুলে ধরব।
আগের চেয়ে বড় পার্ক
আগে পার্কটি গুলশান ইয়ুথ পার্ক ও গুলশান সেন্ট্রাল পার্ক দেয়াল দিয়ে বিভক্ত ছিল। এখন তা একীভূত করা হয়েছে। আমাদের পার্কগুলোর একটি বড় সমস্যা হলো, এর ক্ষুদ্র আয়তন। পার্শ্ববর্তী দেশের কলকাতার সবচেয়ে বড় পার্ক ‘ময়দান’-এর আয়তন ৯৮৮ একর (৪ বর্গকিলোমিটার)। পক্ষান্তরে ঢাকার সবচেয়ে বড় রমনা পার্কের আয়তন মাত্র ৬৮ দশমিক ৫ একর। তাই দুই পার্ককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
পার্কটিকে আমি শহীদ নেতার উন্নয়ন–দর্শনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ প্রতীক বলে মনে করি। পার্কটি তাজউদ্দীনের শোষণমুক্ত এবং সব নাগরিকের সমানাধিকারের সমাজ গঠনের স্বপ্নের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। পার্কটির শ্যামল প্রকৃতি তাঁর জন্মস্থান কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়।
সবার জন্য পার্ক
পার্কটির যে বৈশিষ্ট্য আমার নজর কেড়েছে, তা হলো এটি সবার জন্য। সবার জন্য কথাটির দুটি তাৎপর্য আছে। প্রথমটি হলো, সব বয়সের মানুষের ব্যবহারের জন্য এখানে কিছু না কিছু আছে। শিশু-কিশোর ও প্রতিবন্ধীদের জন্য পার্কের তিন স্থানে খেলার জায়গা রাখা হয়েছে। প্রথমটি দুই-তিন বছর বয়সী শিশুদের। দ্বিতীয় ও তৃতীয়টিতে খেলতে পারবে আরেকটু বড় শিশুরা। এসব জায়গায় রয়েছে স্লাইড, দোলনাসহ খেলার নানা উপকরণ। বাইরে থেকে যাতে পথচারীরা পার্কটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে, এ জন্য নিচু করে প্রাচীর দেওয়া হয়েছে।
তরুণ ও যুবাদের জন্য ক্রিকেট, ফুটবল খেলার মাঠ, দর্শকদের বসার আসন, টেনিস, বাস্কেটবল কোর্ট আছে। আছে আচ্ছাদিত ব্যাডমিন্টনসহ অন্যান্য খেলার কোর্ট। বয়সীদের জন্য দেয়াল ঘেঁষে আয়তাকার হাঁটার পথ ছাড়াও আছে তিনটি দৃষ্টিনন্দন চক্রাকার হাঁটাচলার মাঠ, যাতে চলার পথে ভিড় না জমে এবং সবাই নিজ পছন্দের দূরত্ব হাঁটতে পারেন।
দ্বিতীয় তাৎপর্যটি হলো, পার্কটি ধনী-গরিব সবার জন্য উন্মুক্ত। সেদিন, বিদেশ থেকে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে আসা আমার নাতি ওরাইয়ন আমাকে পার্কে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিয়ে বলে, পার্কে তার জন্য বন্ধু অপেক্ষা করছে। পার্কে গিয়ে দেখি তার সমবয়সী একটি ছেলের সঙ্গে সে খেলছে, কিছুক্ষণ পর আমাদের বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া স্ন্যাক্স তার সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাচ্ছে। দুজনের ভাষা ও সামাজিক অবস্থান ভিন্ন হলেও তা বন্ধুত্বের অন্তরায় হয়নি!
সবুজ পার্ক
বাইরে দেখেছি পার্ক মানেই সবুজ ঘাস। যেমন লন্ডনের ‘বাওলিং গ্রিন’ একটি সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত পার্ক। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি পার্কের বিস্তৃত অংশজুড়ে সবুজ ঘাস। আগের গাছগুলো কাটা হয়নি; বরং নতুন করে লাগানো হয়েছে কয়েক শ গাছ।
সবই দেশি প্রজাতির বিভিন্ন ঔষধি, বনজ ও ফলদ গাছ। পার্কের মাঝের জায়গায় রয়েছে কিছু বড় গাছ। সেগুলো ঘিরে খনন করা হয়েছে বড় নালা। অংশটি দেখতে অনেকটা দ্বীপের মতো। অন্য সব নালার মতো ওই নালা কংক্রিট দিয়ে ঢালাই করে তৈরি করা হয়নি। পানিনিষ্কাশনের সুবিধার্থে নালাটি মাটি ও পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। গুলশানের অন্য তিনটি পার্ক থেকে সবুজ ঘাস নির্বাসিত।
অন্য পার্কগুলোর বেহাল অবস্থার কারণ কী
পার্কের তিন ধরনের শত্রু রয়েছে। এক. দখলদারি; দুই. কংক্রিট; তিন. বাণিজ্যিকীকরণ। এগুলো একে একে আলোচনা করা হলো।
দখলদারি
অবৈধ দখলদারেরা সুযোগ পেলেই পার্ক দখল করে। যেমন বনানী সি ব্লকের পার্কে রাজনৈতিক দলের অফিস, ডেসকোর পরিত্যক্ত সাবস্টেশন ও অফিস, বনানী সোসাইটির গার্ড শেড ছিল। মোহাম্মদপুর ত্রিকোণ পার্কে রাজনৈতিক দলের অফিস এবং নার্সারি, মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ পার্কে ক্লাব হাউস, টংদোকান ও রিকশা গ্যারেজ স্থাপন করা হয়েছিল। অন্য অনেক পার্কেই এমন দখলদারত্ব ছিল। এখন এগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
এখন অবশ্য দখলদারত্বের ধরন পাল্টেছে। পার্কভিত্তিক বিভিন্ন ক্লাবের নাম করে গুলশান ও অন্যান্য পার্কে নিজেদের ব্যবহারের জন্য জায়গির (ফিএফ) প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এসব নতুন অনাচার বন্ধ করতে হবে। পার্কের প্রতি ইঞ্চি জমি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে।
কংক্রিট
কংক্রিট থেকে বাঁচার জন্যই পার্কে আসা। কিন্তু পার্কেও গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থাপনা। শৌচাগার, বর্ষাকালে ব্যবহারের ইনডোর কোর্ট ও ন্যূনতম অফিস ছাড়া পার্কে আর বিশেষ কোনো স্থাপনা অপরিহার্য নয়। কিন্তু এখন পার্কগুলোতে খাবারের দোকান, এমনকি প্যাথলজিক্যাল টেস্ট ল্যাবও গড়ে উঠছে। কংক্রিটের এসব স্থাপনা নির্মাণ করতে বৃক্ষনিধন হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ ঘাস। এসব অনাবশ্যক স্থাপনা পার্কের বাইরে উপযুক্ত স্থানে সরিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
বাণিজ্যিকীকরণ
আলোচ্য পার্কটিতে আগে ওয়ান্ডারল্যান্ড নামের একটি বাণিজ্যিক শিশুপার্ক ছিল। কেবল দর্শনীর বিনিময়ে এখানে প্রবেশ করা যেত। বর্তমান পার্কটিতে তার পরিবর্তে একটি ভবনে স্থাপিত হয়েছে গরিবদের জন্য বিনা মূল্যের চিকিৎসাকেন্দ্র, সেলাই প্রশিক্ষণকেন্দ্র, পাঠাগার, টেবিল টেনিস ও বোর্ডগেম খেলার ব্যবস্থা। পার্ক কর্তৃপক্ষ এ জন্য আমাদের সাধুবাদ পেতে পারে।
সামনের কাজ
আমি পার্কের স্থপতি ও ঢাকা সিটি করপোরেশনকে তাদের প্রচেষ্টার জন্য অভিনন্দন জানাতে চাই। তারা একটি দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেছে। কিন্তু তাদের কাজ শেষ হয়ে যায়নি। বাকি কাজগুলো সমাপ্ত করতে হবে।
সামনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পার্কের রক্ষণাবেক্ষণ করা, যাতে সব বয়সের নাগরিকেরা অব্যাহতভাবে প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাগুলো ব্যবহার করতে পারে, পার্কের সবুজ ও নিরাপদ পরিবেশ অব্যাহত থাকে। দখলদারেরা যাতে নতুন কৌশলে পার্ক দখল না করতে পারে এবং বেনিয়ার লোলুপ দৃষ্টি থেকে পার্ক মুক্ত থাকে। এ জন্য প্রয়োজনবোধে গুলশান ইয়ুথ পার্ক কর্তৃপক্ষের সহায়তা নিতে পারে। স্থানীয় সরকার বিভাগ অথবা সিটি করপোরেশন সব আধুনিকায়ন করা পার্কের দেখাশোনার জন্য অন্যান্য দেশের মতো ‘পার্ক ও বিনোদন’ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
পার্কটিকে আমি শহীদ নেতার উন্নয়ন–দর্শনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ প্রতীক বলে মনে করি। পার্কটি তাজউদ্দীনের শোষণমুক্ত এবং সব নাগরিকের সমানাধিকারের সমাজ গঠনের স্বপ্নের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। পার্কটির শ্যামল প্রকৃতি তাঁর জন্মস্থান কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয়।
পরিশেষে আমি বিজয়ের মাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রূপকার শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ