বছরজুড়ে নিয়মিতভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির খবর ছিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে একেক সময় একেক যুক্তি সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।
প্রথমে শোনানো হয়েছে করোনা ভাইরাসের প্রভাবের কারণে বিধিনিষেধের (লকডাউন) কথা; তারপর শোনানো হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা। বিভিন্ন সময় মধ্যস্বত্বভোগীদের অসাধু আচরণের কথা তো আছেই। আর ডলার-সংকট এখনো চলছে, যার প্রভাবের কারণে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে।
এখন বলতে পারেন, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশও জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারেনি। যে কানাডা ছিল মানুষের স্বপ্নের দেশ, সেখান থেকে দলে দলে অভিবাসী চলে আসছেন। বাসাভাড়া থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে যে আয় করছেন, তা দিয়ে তাঁরা আর পেরে উঠছিলেন না।
অস্ট্রেলিয়া থেকে অভিবাসী চলে যাওয়ার খবর না পেলেও প্রতি সপ্তাহে বাজার করতে গেলেই টের পাচ্ছিলাম, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এ-ই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
সব স্বাভাবিক থাকলেও জনগণের পকেটে যখন টাকা থাকে না বা বেশি খরচের কারণে পকেট দ্রুত খালি হয়ে যায়, তখন সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিনিয়ত মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টা অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। জনগণকে এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় নিশ্চিত করতে পারে সরকারের ঘোষিত বাজেট।
অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিবছর বাজেট পাসের মাধ্যমে সরকার জনগণের জীবনমানকে সহজ করার চেষ্টা করে থাকে।
বাংলাদেশে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৬ জুন যখন সংসদে বাজেট উত্থাপিত হতে যাচ্ছে, তখন ইতিমধ্যেই ১৪ মে অস্ট্রেলিয়া সরকারের ট্রেজারার জিম চ্যামার্স বাজেট ঘোষণা করেছেন। ট্রেজারার বাজেট উত্থাপন করার আগে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তিনি প্রতিটি সাক্ষাৎকারেই যে কথা বারবার বলেছেন, তা হলো এবারের বাজেটে অস্ট্রেলীয়দের জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় করাই হলো তাঁদের প্রধান দায়িত্ব।
এখন এই যে দায়িত্বের কথাটা জিম বলছেন, এতে করে তাঁর সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জনগণের জন্য কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে?
প্রতিবছরই বিভিন্ন মহল থেকে ব্যক্তি করদাতাদের আয়করের পরিমাণ সহনীয় করার জন্য দুটি দাবি ওঠে। এক. করযোগ্য আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা এবং দুই. করহার হ্রাস করা। কিন্তু বাংলাদেশের করব্যবস্থার কারণে এই দুটি ফ্যাক্টর বৃদ্ধি বা কমানো হলেও নিম্ন আয়ের মানুষের কোনো সুবিধা হয় না।
প্রথম পদক্ষেপ হলো ব্যক্তি করদাতাদের আয়করের পরিমাণ হ্রাস করার কথা বলা হয়েছে। গড়ে প্রতি করদাতার বছরে ১ হাজার ৮৭২ ডলার আয়কর হ্রাস পাবে এবং ১ দশমিক ৩৬ কোটি করদাতা এ সুবিধা পাবেন। এর সঙ্গে আগামী বছর ৩০০ ডলার বিদ্যুৎ/গ্যাস বিলে ছাড় পাবেন আর ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো পাবে ৩২৫ ডলার।
এ ছাড়া স্বল্প মূল্যে ওষুধ, শিক্ষাঋণের সুদের পরিমাণ কমানোসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বাজেটে উল্লেখ রয়েছে। মোটকথা, এবারের বাজেটে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় করার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
যে ১ দশমিক ৩৬ কোটি করদাতার কথা বলা হচ্ছে, তাঁদের মধ্য থেকে আয়ের ধাপ অনুযায়ী কতজন করদাতা বছরে কত ডলার করে আয়কর কম দেবেন এবং অন্যান্য আর্থিক সুবিধাসহ মোট কত ডলার সুবিধা পাবেন, তা হিসাব করে বাজেটে দেখিয়েছে।
আগামী বাজেটে আমাদের দেশের মানুষ কত টাকা আর্থিক সুবিধা পাবেন? ব্যক্তি করদাতার আয়কর ও ইউটিলিটি বিলের পরিমাণ কি কমবে?
কোম্পানির কর কমানোর ইঙ্গিত দেওয়া হলেও ব্যক্তি করদাতাদের জন্য এখনো কোনো সুখবর পাওয়া যায়নি। আর ইউটিলিটি বিল হ্রাস করার পরিবর্তে বেড়েই চলেছে। তাহলে জীবনযাত্রার ব্যয় কমবে কী করে? মানুষ যে আয় করেন, তা দিয়ে কীভাবে বাড়তি খরচ ম্যানেজ করবেন?
একজন পুরুষ ব্যক্তির করযোগ্য আয় যদি সাড়ে তিন লাখ টাকা হয়, তাহলে তাঁকে বাধ্যতামূলকভাবে ন্যূনতম কর দিতে হয়। এখন এই করযোগ্য আয়ের পরিমাণ এ বছর বাড়িয়ে চার লাখ টাকায় উন্নীত করার দাবি উঠেছে।
প্রতিবছরই বিভিন্ন মহল থেকে ব্যক্তি করদাতাদের আয়করের পরিমাণ সহনীয় করার জন্য দুটি দাবি ওঠে। এক. করযোগ্য আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা এবং দুই. করহার হ্রাস করা। কিন্তু বাংলাদেশের করব্যবস্থার কারণে এই দুটি ফ্যাক্টর বৃদ্ধি বা কমানো হলেও নিম্ন আয়ের মানুষের কোনো সুবিধা হয় না।
যাঁদের আয়ের পরিমাণ বেশি, সাধারণত উচ্চমধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে ধনী ব্যক্তিরা এই দুটি সুবিধাই সম্পূর্ণ ভোগ করতে পারেন। ধরুন, একজন বেসরকারি চাকরিজীবী শুধু চাকরি করে সংসার চালিয়ে থাকেন। করযোগ্য আয় সাড়ে তিন লাখ টাকা হতে হলে তাঁকে বছরে বেতন পেতে হবে সোয়া পাঁচ লাখ টাকা। কারণ, একজন বেসরকারি চাকরিজীবী তাঁর বেতন খাতে মোট আয় থেকে এক-তৃতীয়াংশ বাদ দিতে পারেন।
তাহলে এই চাকরিজীবী পৌনে দুই লাখ টাকা বাদ দিলে তাঁর করযোগ্য আয় হবে সাড়ে তিন লাখ টাকা। যখনই তাঁর এই টাকা আয় হয়ে গেল, তখন থেকেই কিন্তু তাঁকে প্রতিবছর বাধ্যতামূলকভাবে ন্যূনতম কর দিতে হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনটি সিটি করপোরেশনে ন্যূনতম করের পরিমাণ হলো পাঁচ হাজার টাকা।
বর্তমান করব্যবস্থায় একজন বেসরকারি চাকরিজীবী যদি ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন পান, তাহলেও তাঁর আয়কর পাঁচ হাজার টাকাই হবে। এর কারণ হলো, একজন বেসরকারি চাকরিজীবী প্রথমে তাঁর মোট আয়ের এক-তৃতীয়াংশ বাদ দিতে পারেন যে একটু আগে জেনেছেন এবং তারপর তিনি কর রেয়াত সুবিধা পান।
এসব বিবেচনায় নিয়ে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা থেকে ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত যাঁরা বেতন পান, তাঁদের আয়কর পাঁচ হাজার টাকাই আসে। তাহলে আপনি করযোগ্য আয়ের পরিমাণ সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে চার লাখ টাকা এবং করহার হ্রাস করলেও নিম্ন আয়ের মানুষের কোনো সুবিধা হবে না। যাঁদের বেশি আয় আছে, তাঁরাই কেবল এর ফলে সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন।
এখানে শুধু একজন চাকরিজীবী করদাতার একটা উদাহরণ দেওয়া হলো। এমন অনেক উদাহরণ আছে, যার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ এই আয়করের বৈষম্যের শিকার হন। আয়কর আইনে ন্যূনতম করের বিধান আছে। এই ন্যূনতম করের ব্যাপ্তি বিশাল এবং এর ফলে আপনার করযোগ্য আয়ের ওপর আয়কর না হলেও বাধ্যতামূলকভাবে কর দিতে হয়।
সঞ্চয়পত্র, স্থায়ী আমানত, সঞ্চয়ী আমানত, লভ্যাংশ ইত্যাদি খাতে যে আয় হয়, তা থেকে উৎসে কর কর্তন করে রাখা হয়। একজন গৃহিণী যাঁর কোনো উপার্জন নেই বা একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি যিনি জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে কিছু বিনিয়োগ করেছেন, তাঁর করযোগ্য আয় না থাকা সত্ত্বেও বাধ্যতামূলকভাবে এসব খাতের আয় থেকে কর দিতে হচ্ছে।
যেখানে একের পর এক নতুন করে এই ন্যূনতম করের আওতা বাড়ানো হচ্ছে, সেখানে করহার হ্রাস এবং করযোগ্য আয়ের সীমা বাড়িয়ে নিম্নবিত্ত মানুষের কোনো উপকার হবে না। একদিকে প্রতিনিয়ত জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, আরেক দিকে প্রতিবছর বাজেটে নতুন করে আয়করের আওতা প্রসারিত করা হবে এবং এসবের প্রভাব এসে পড়বে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। তাঁদের জন্য না থাকবে করের সুষম ব্যবস্থা আর না থাকবে কোনো আর্থিক সুবিধা।
জসীম উদ্দিন রাসেল অস্ট্রেলিয়ায় কর্মরত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট