বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উপস্থাপিত বাজেট নিয়ে এযাবৎ আলোচনায় সবচেয়ে বেশি উল্লেখিত বিষয় হচ্ছে দেশের দরিদ্র মানুষের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া কর। সরকারি সেবা নিতে গেলে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা করের বিধানকে সরকারিভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় চাঁদাবাজি বলেও কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন।
এই বিধানের অনৈতিকতা সংশয়াতীত। কিন্তু এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেছেন, ‘আয়কর হিসেবে দুই হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে দিয়ে উন্নয়নে শামিল হওয়া গর্বের ব্যাপার।’ প্রতিদিন বিভিন্নভাবে সরকারি কোষাগারে অর্থ দিয়েও যেন গর্বের সুযোগ হচ্ছে না নাগরিকদের!
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটি জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা গেছে, ধারদেনা করে জীবন চালানো এখন স্বাভাবিক বিষয়। তা ছাড়া ১৮ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবারের কখনো কখনো পুরো দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে, ৭১ শতাংশ পরিবার প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবার খেয়েছে।
৩৭ শতাংশ পরিবার মাঝেমধ্যে কোনো এক বেলা খাবার না খেয়ে থেকেছে (যুগান্তর, ৩১ মার্চ ২০২৩)। তাঁদের এক বড় অংশকেই কোনো কোনো কারণে সরকারি সেবার জন্য যেতে হয় বা হবে। আর সে জন্য আয়কর দেওয়ার নম্বর (টিআইএন) লাগবে এবং এই নম্বরের জন্য তাদের দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে।
এ বাজেটের আলোচনায় অনেকেই একে ‘নির্বাচনের বছরের বাজেট’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু যে নির্বাচনী ব্যবস্থা এখন বহাল, সেখানে ক্ষমতাসীনেরা কী ধরনের বাজেট করলেন, তার প্রভাব কতটুকু থাকবে, সেটাও ধর্তব্যে নেওয়া দরকার। যে শাসনব্যবস্থায় লোকদেখানো অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং নাগরিকদের বেঁচে থাকার জন্য কী দরকার বিবেচ্য নয়, সেখানে জবরদস্তিমূলক করের প্রস্তাব থাকবে, এটা বিচিত্র নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই বাজেটে এটাই কি জবরদস্তিমূলক একমাত্র বিধান? এই বাজেটের মূল বিষয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো যোগাযোগ নেই, নাগরিকদের কী হলো না হলো, তাঁরা কীভাবে জীবন যাপন করেন, সেটি ধর্তব্যের বিষয় নয়। অর্থনীতির বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে স্বপ্ন দেখানোকে কল্পনাবিলাস বলে, তাকে আদৌ পরিকল্পনা বলা ঠিক কি না, সেটাই প্রশ্ন।
আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের যে কল্পনা করা হয়েছে, তার ভিত্তি কী? এনবিআর গত বছরের লক্ষ্যমাত্রার ৬১ শতাংশ কর আদায় করেছে ১০ মাসে। সেই জায়গায় আগামী বছরের জন্য এই এনবিআরকে বলা হচ্ছে গত বছরের লক্ষ্যমাত্রা চেয়ে সাড়ে ১৬ শতাংশ বেশি আদায় করতে। এই কথার কারণ হচ্ছে আইএমএফকে বোঝানো, সরকার রাজস্ব বাড়াতে চেষ্টা করছে, যাতে করে আইএমএফ ডিসেম্বরে যে অর্থ ছাড় করার কথা, সেটা ছাড় করে। রাজস্ব বাড়ানোর জন্য আইএমএফ ‘পরামর্শ’ দিয়েছে।
এই বাজেটে সরকার বলছে, আগামী বছরে বেসরকারি বিনিয়োগ দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ, গত বছরে এই হার তার আগের বছরের চেয়ে কম ছিল। আগামী বছরে তা কেন বাড়বে, কীভাবে বাড়বে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকারের ভরসার জায়গা হচ্ছে ঋণ নেওয়া। এর একটি অংশ আসবে বৈদেশিক ঋণ থেকে, আরেকটি দেশের ভেতরের ব্যাংক থেকে।
বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। এই বছরে তা ছিল ৮৩ হাজার কোটি টাকা। দেশের ব্যাংক থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ১৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। গত কয়েক বছরে সরকার ব্যাংক থেকে লাগামহীনভাবে ধার নিয়েছে, এখন লক্ষ্যমাত্রাই দাঁড়িয়েছে গত দুই বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। অভ্যন্তরীণভাবে এই ঋণ নেওয়ার পরিণতি হয়েছে বেসরকারি খাত ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছে না।
আগামী বছর সরকার আরও বেশি ঋণ নেবে; আর সেই অর্থ দিয়ে সরকার তার ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি করবে (জ্বালানি, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি)। এতে সাধারণ মানুষের জন্য দরকারি জিনিস কম আমদানি হবে, জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। কিন্তু সেই হিসাবে না গিয়ে বাজেট বলছে, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা হবে। কীভাবে কমবে, তার কোনো নির্দেশনা নেই।
এই হারে ঋণ নেওয়ার পরিণতিতে বেসরকারি খাতের সংকোচন ঘটবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও কম হবে। গত কয়েক বছরে তার লক্ষণ দেখা গেছে। ডলার-সংকটের কারণে বেসরকারি খাতের অবস্থা খারাপ হয়েছে। আশু সেই অবস্থা বদলাবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই।
সরকারের লাগামহীন ঋণ নেওয়ার পরিণতি হচ্ছে সুদ পরিশোধের হার বেড়ে যাওয়া। চলতি বছরের বাজেটে সুদ পরিশোধে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৮০ হাজার কোটি টাকা; আগামী বছরের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৯৪ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। সরকারের পরিচালনা ব্যয়ের ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ যাবে সুদ দিতে।
সরকার দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে ঋণ নেবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। প্রশ্ন হচ্ছে যে হারে তার উল্লম্ফন ঘটছে, তার পরিণতি কী হবে। ঋণ নেওয়া মানেই ভবিষ্যৎকে বন্ধক দেওয়া। সরকারের এই অনিয়ন্ত্রিত ঋণ গ্রহণ নাগরিকদের মাথায় চাপিয়ে দিচ্ছে ঋণের বোঝা। ভবিষ্যতে সুদের জন্য কত ব্যয় হবে, এই হিসাব নিয়েও প্রশ্ন আছে।
আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডি’স বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। তার অর্থ, ভবিষ্যতে বিদেশ থেকে ঋণ নিতে হলে আরও বেশি সুদ গুনতে হবে, যা বরাদ্দ হয়েছে, তাতে না কুলালে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সরকারের পরিচালনা ব্যয়ের এক-পঞ্চমাংশ যাবে সুদ গুনতে, আরেক এক–পঞ্চমাংশ যাবে ভর্তুকি এবং প্রণোদনায়।
গত এক দশকে ভর্তুকির বরাদ্দের সিংহভাগ গেছে জ্বালানি খাতে, তার সুবিধা পেয়েছেন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, যাঁরা ক্ষমতাসীনদের কাছাকাছির মানুষ। জ্বালানি খাতের অবস্থা কী, তা বাংলাদেশের মানুষকে বোঝানোর দরকার আছে বলে মনে হয় না। প্রতিদিন লোডশেডিং মোকাবিলা করছেন তাঁরা, শিল্পকারখানায় উৎপাদন কমছে।
বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা আর পেনশনের জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২৬ শতাংশের ওপরে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন–ভাতা বৃদ্ধি পায়, তার প্রভাব পড়ে বাজারে, যাঁরা সরকারি কর্মচারী নন, তাঁদের জন্য তা হয়ে ওঠে দুঃস্বপ্ন।
বাজেট যে এভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে, তার কারণ হচ্ছে ক্ষমতাসীনেরা শাসন বলতে বোঝেন ধারদেনা করে এখনকার অবস্থার সামাল দেওয়া। কারণ, অর্থনীতির যে সংকট, সেটা নিয়ে বাজেটে কোনো আলোচনাই নেই, যেকোনোভাবে এই অবস্থা সামাল দেওয়াই যেন তাদের লক্ষ্য।
এসব নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা কোনো রকম জবাবদিহির মুখোমুখি হবেন না। কারণ, এখনকার শাসনব্যবস্থার ভিত্তিই হচ্ছে জবাবদিহিহীনতা, এই ব্যবস্থার নির্ভরতা প্রশাসনের ওপরে। জাতীয় সংসদে আগামী তিন সপ্তাহ বাজেট নিয়ে আলোচনায় যতটা প্রশংসার ধ্বনি শোনা যাবে, তার কিয়দংশও প্রশ্ন শোনা যাবে না।
এ বাজেটের আলোচনায় অনেকেই একে ‘নির্বাচনের বছরের বাজেট’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু যে নির্বাচনী ব্যবস্থা এখন বহাল, সেখানে ক্ষমতাসীনেরা কী ধরনের বাজেট করলেন, তার প্রভাব কতটুকু থাকবে, সেটাও ধর্তব্যে নেওয়া দরকার। যে শাসনব্যবস্থায় লোকদেখানো অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং নাগরিকদের বেঁচে থাকার জন্য কী দরকার বিবেচ্য নয়, সেখানে জবরদস্তিমূলক করের প্রস্তাব থাকবে, এটা বিচিত্র নয়।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলে রাখা ভালো, আমার অনুমান, সরকার এই করের বিষয়টি শেষ পর্যন্ত বাদ দেবে। এতে প্রশংসার বন্যা বইবে। কিন্তু এই বাজেটে নাগরিকদের প্রতিদিনের সংকট মোকাবিলার যেকোনো ব্যবস্থাই করা হলো না, তা বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই। সেটা যেন আড়ালে না যায়, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার।
পাদটীকা: কখনো কখনো ছোট ছোট বিষয়কে প্রতীকী বলে মনে হয়। প্রস্তাবিত বাজেটে চশমার দাম বাড়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে, কলমের দামও বাড়বে। এর মধ্যে কি সবকিছু স্পষ্টভাবে না দেখা এবং সব বিষয়ে লেখালেখি না করার ইঙ্গিত আছে?
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট