কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় যেভাবে বদলে যাচ্ছে চিকিৎসাসেবা

টাইম ম্যাগাজিন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনার নতুন যুগ’ শীর্ষক এ বিশেষ সংখ্যার সন্নিবেশিত লেখাগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রথম আলোর জন্য ধারাবাহিকভাবে লিখছেন ইশতিয়াক মান্নান। মূল লেখার সারাংশ, ভাষান্তর ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-ব্যাখ্যা যুক্ত করেছেন তিনি। আজকের মূল লেখাটি লিখেছেন এনাবেল ভেরেড, যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্রিপ্স ক্লিনিকের হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ এবং ‘ডিপ মেডিসিন: হাউ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ক্যান মেক হেলথ কেয়ার হিউম্যান এগেন’ বইয়ের লেখক এরিক টপোলের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে। আগামী সপ্তাহের লেখা, ‘শ্রেণিকক্ষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’

চিকিৎসক–রোগীর আন্তসম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে আলোচনা সব দেশেই আছে। প্রায় সবাই চায় ‘মানুষ’ ডাক্তারকে দেখতে—তিনি মনোযোগ দিয়ে কথা শুনবেন, সহমর্মিতা দেখাবেন, রোগীর ব্যথায় দুঃখ পাবেন, সেই সঙ্গে যত্ন করে রোগ নির্ণয়ও করবেন, চিকিৎসাও দেবেন। যন্ত্রের হাতে এ দায়িত্ব মানুষ দিতে চায় না। মাত্র ১৩ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন, এআই চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্ক উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে।

এরিক টপোল অবশ্য আশাবাদী। তিনি মনে করেন, এআই চিকিৎসাসেবার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রশাসনিক বা অন্য করণিক কাজগুলোকে সম্পাদন করে চিকিৎসকদের সময় ও শ্রম অনেকখানি বাঁচিয়ে দিতে পারে। একদিকে রোগীরা অনেক বেশি স্বাধীন ও সক্ষম হবে—চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়, এমন অনেক কাজ এআই সেগুলো করে দেবে। এ সময় চিকিৎসকেরা দিতে পারবেন জটিল রোগ নির্ণয় ও তার উন্নততর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে।

আমাদের দেশে না হলেও পশ্চিমের দেশগুলোয় চিকিৎসকদের দিনের একটা বিরাট পরিমাণ সময় ব্যয় করতে হয় রোগীর অবস্থা, চিকিৎসা ইত্যাদি তথ্য লিপিবদ্ধ করতে। এখন এআই চেম্বারে কিংবা ওয়ার্ড রাউন্ডের সময় রোগী ও সহকর্মীদের সঙ্গে কথোপকথন থেকে চমৎকার ও পুঙ্খানুপুঙ্খ রোগের সারাংশ তৈরি করে দিচ্ছে। শুধু কি সারাংশ?

এই কথোপকথন থেকে এআই চিকিৎসকদের তৈরি করে দিচ্ছে ব্যবস্থাপত্র, ইনস্যুরেন্স কোম্পানির জন্য প্রাক্‌-অনুমতি, ল্যাব পরীক্ষার নির্দেশ, এমনকি রোগীকে তাঁর রক্তচাপ মাপার কথা মনে করে দেওয়ার কাজটুকুও। চিকিৎসকেরা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন, কারণ দীর্ঘ সময় তাঁদের আর কি–বোর্ড ও স্ক্রিনের সামনে বসে থাকতে হবে না। এখন থেকে চিকিৎসাসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এভাবেই হতে যাচ্ছে।

চিকিৎসকদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট না পেয়ে কিংবা তাঁদের ব্যবস্থাপনায় সন্তুষ্ট না হয়ে চ্যাটজিপিটির দ্বারস্থ হওয়ার বেশ কিছু চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা শোনা গেছে। যেমন চ্যাটজিপিটি চার বছর বয়সী এক শিশুর অত্যন্ত জটিল ‘টিথার্ড কর্ড সিনড্রোম’ রোগ নির্ণয় করতে পেরেছে, যা অনেক চিকিৎসক মিলেও নির্ণয় করতে পারেননি। আবার এরিকেরই একজন রোগী, যে অসুস্থতা থেকে কিছুতেই সেরে উঠছিল না, তাকে বলা হলো তার দীর্ঘস্থায়ী কোভিড হয়েছে। একে একে সাতজন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো হলো, কিন্তু কাজ হলো না।

অবশেষে অনেকটা খেয়ালের বশে রোগের লক্ষণগুলো চ্যাটজিপিটিকে জানালে উত্তর এল, ‘লিম্বিক এনকেফেলাইটিস’, যা দীর্ঘস্থায়ী কোভিড নয়। সেইমতো চিকিৎসা হলো, রোগের নিরাময় হলো। এরিকের মতো অনেক চিকিৎসকই কৌতূহলের বশে জটিল রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নিজেদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে চ্যাটজিপিটির সিদ্ধান্ত মিলিয়ে দেখেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এআই সঠিক সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছে।

তবে এখনো বলার সময় আসেনি যে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমরা এআইয়ের ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারব। এআই সেই পর্যায়ে যাচ্ছে, অসংখ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে এ কাজ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।

অবশ্যই যেকোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সেটা যখন চিকিৎসাসেবা–সংক্রান্ত, দায়িত্ব নেওয়ার একটা বিষয় আছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বা সবচেয়ে উপযোগী চিকিৎসা ঠিক করার ক্ষেত্রে যদি কোনো দ্বিধা থাকে, তাহলে চিকিৎসকেরা এখন কী করেন? তাঁরা বই ঘাঁটেন, গুগল সার্চ করেন, সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেন অথবা ওয়েবএমডির মতো অ্যাপ্লিকেশনগুলোর সাহায্য নেন।

এআইয়ের সাহায্যে বিনা খরচে একটা দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ মত নিলে খারাপ কী? অবশ্যই অন্য সব উপায়ের মতো এখানেও ভুলের আশঙ্কা থাকে, কিন্তু এআইকে তো শেখানোই হয়েছে সম্ভাব্য সব তথ্য বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে, সে এ কাজ মানুষের চেয়ে অনেক বিস্তৃত পরিসরেই করতে পারে।

যত রোগী তত টাকা—স্বাস্থ্যসেবার এই মুনাফার দৌড়ে চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কের মধ্যে সহমর্মিতা ও মানবিকতার যে দিকগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে, এআই তা ফিরিয়ে আনতে পারে (যুক্তরাষ্ট্রে রোগীপ্রতি চিকিৎসকেরা গড়ে সাত মিনিট সময় দেন)। প্রযুক্তি মানবিকতা ফিরিয়ে আনবে—শুনতে অদ্ভুত শোনালেও এ সম্পর্ক গড়ে ওঠা না–ওঠার পেছনে সময়ের নিদারুণ স্বল্পতা একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে। এআই এই মহামূল্যবান সময় ফিরিয়ে দেবে দুই তরফেই।

বিষাক্ত তরিতরকারি (যেমন মাশরুম) খাওয়া রোগীদের চিকিৎসার একজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি রোগী যা খেয়েছে, তার ছবি দেখেই বুঝতে পারি কী ব্যবস্থা নিতে হবে। এআই এখনো পুরোপুরি নির্ভুলভাবে তা পারে না। কিন্তু অসংখ্য রোগী থেকে এআই বেছে বলে দিতে পারে, কোন রোগীদের আমার মতো বিশেষজ্ঞের কাছে দ্রুত পাঠানো দরকার।’

এরিক টপোল বলছেন, তিনি হরহামেশাই এখন ‘স্মার্টফোন আলট্রাসাউন্ড’ ব্যবহার করেন রোগীর হৃদ্‌যন্ত্রের ভেতরটা দেখার জন্য, ‘মুঠোয় বহন করা যায়—এমন প্রোব ফোনের সঙ্গে লাগিয়ে আমি রোগীদেরও তাদের হৃদয়ের অবস্থাটা দেখাই।’ তিনি বলছেন, একবার তাঁর পেটে ব্যথা হলে তিনি এটা দিয়ে নিজের আলট্রাসাউন্ড করলেন। এআই বলল যে তাঁর কিডনি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়ে আছে।

পরে হাসপাতালে গিয়ে ‘ক্যাট স্ক্যান’ করে দেখা গেল যে সত্যিই কিডনিতে পাথর হয়েছে, সে কারণেই কিডনির স্ফীতি। আপনি যদি ইকোকার্ডিওগ্রাম করতে চান, প্রোবটাকে বুকের ওপর ধরবেন, তারপর এআইযুক্ত এই মেশিন আপনাকে ডানে-বাঁয়ে সরাতে, সঠিক দিকে ঘোরাতে নির্দেশ দেবে। যে মুহূর্তে প্রয়োজনমতো ইমেজ পাওয়া যাবে, সে বিশ্লেষণ করে মতামত জানাবে। ব্যাপারটা এমনই সহজ।

এআই হতে পারে আপনার ঘরের চিকিৎসক, পুষ্টিবিদ, সুস্থতার কোচ। আপনার যদি অ্যাজমা অথবা হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি থাকে, তাহলে এআই আপনার উপযোগী করে নিয়মিত খাবার, ব্যায়াম ও অভ্যাস বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে যাবে এবং সে রকম ঝুঁকি তৈরি হলে আপনার চিকিৎসককেও নিজে থেকেই জানাতে পারে। প্রয়োজন না হলে যেমন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় না, রোগীর ঘরে থাকা সেন্সরগুলো দিয়ে এআই সেই সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের কাজটাই করতে পারে—ঠিক যেন সবার ঘরেই আইসিইউর সুবিধা।

গত কয়েক বছরে মেয়ো ক্লিনিক একটা অভূতপূর্ব উদ্যোগ নিয়েছে, যার উদ্দেশ্য দুনিয়াজোড়া একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা, যার মাধ্যমে চিকিৎসকেরা সর্বোত্তম চিকিৎসাসেবাটা দিতে পারবেন এবং তার সুফল পাব দেশ–জাতিনির্বিশেষে আমরা সবাই। যেহেতু বয়স, লিঙ্গ, জাতি ইত্যাদির ভিন্নতা রোগের রকমফেরে প্রভাব ফেলে, তাই এ উদ্যোগের লক্ষ্য হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যত বেশি সম্ভব রোগীর তথ্য সন্নিবেশিত করা (অবশ্যই রোগীর পরিচিতি সংক্রান্ত তথ্য বাদ দিয়ে)।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রায় ১০ মিলিয়ন রোগীর প্রায় সব ধরনের রোগের তথ্য দিয়ে এআই অ্যালগারিদম প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে। তার পর থেকে দ্রুতগতিতে মেয়ো ক্লিনিক যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, কানাডা, ইসরায়েলসহ এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন ক্লিনিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে অংশীদারত্ব তৈরি করে চলেছে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩০ মিলিয়ন রোগীর তথ্য যুক্ত হয়েছে এই তথ্যভান্ডারে, লক্ষ্য ৪ বিলিয়ন রোগী। এই অ্যালগারিদমের শক্তি ও দক্ষতা হবে অভাবনীয়।

আগের এক পর্বে আমরা বলেছিলাম কীভাবে জেনারেটিভ এআইয়ের ভেতর পক্ষপাত ঢুকে আছে এবং তা কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা যেহেতু মানুষের জীবন ও ভালোভাবে বেঁচে থাকার প্রশ্ন, তাই এই ঝুঁকি মোটেও নেওয়া যায় না। এ কারণেই ইন্টারনেটভিত্তিক অন্যান্য তথ্যভান্ডার থেকে মেয়ো ক্লিনিকের এই উদ্যোগকে অত্যন্ত সতর্কভাবে সুরক্ষিত রাখা হচ্ছে। যদিও এর ব্যবহার হবে বিশ্বব্যাপী, কিন্তু প্রতিটি দেশের নিজস্ব আইনের সঙ্গে সংগতি রেখেই ব্যবহার বিধিমালা তৈরি করতে হবে।

এআই যখন এই বিশাল তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করছে, তখন নানান রোগের সেই ধরনের প্রবণতা বা প্যাটার্নগুলো বেরিয়ে আসছে, মানুষ যা কোনো দিনই দেখতে বা বুঝতে পারত না। এই তথ্যভান্ডার যেহেতু অগুনতি মানুষের পুরো জীবনের সুস্থতা, অসুস্থতা, চিকিৎসা, ফলাফল এবং তাদের জীবনযাপনের বিভিন্ন অনুষঙ্গের তথ্য ধারণ করে, তাই রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার বহু আগে থেকেই এআই সতর্কবার্তা দিতে পারে। যেমন বৃহদন্ত্রের খুব ছোট পলিপগুলো এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে দেখার ক্ষেত্রে খুব ভালো বিশেষজ্ঞরাও ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ধরতে পারেন না। কিন্তু মেয়ো ক্লিনিকের এআইয়ের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ৩ শতাংশ।

তবে এআইর বিশ্বজনীন ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট সংযুক্তির একটা বড় ভূমিকা আছে। উত্তর ভারতে, যেখানে ভালো ব্যান্ডউইথ আছে, একজন স্বাস্থ্যসেবা মাঠকর্মী ইকেজি, পালস কিংবা ঘুমের তথ্য পরিমাপের যন্ত্রকে খুব সহজেই মুঠোফোনের সঙ্গে যুক্ত করে এআইয়ের বিশ্লেষণ নিয়ে নিতে পারছে।

অন্যদিকে সাবসাহারান আফ্রিকার কোনো দেশে একই রকম ব্যান্ডউইথ না থাকায় এআই অ্যালগারিদম ফোনে বা কম্পিউটারে ডাউনলোড করে নিতে হবে, পরে ইন্টারনেট সংযোগ করে বৃহত্তর নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে হবে। এভাবে গ্রামেগঞ্জে প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসকেরাও এআইয়ের সাহায্যে বিশেষজ্ঞ সেবার অনেকখানি ব্যবহার করতে পারবেন।

মেয়ো ক্লিনিক প্ল্যাটফর্মের প্রেসিডেন্ট জন হালামকা বলছেন, ‘তার মানে কিন্তু এই নয় যে চিকিৎসকদের কাজ আমরা যন্ত্রকে দিয়ে দিচ্ছি। এআই আমাদের সাহায্য করতে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্যের নির্যাস থেকে ভালো ও সঠিক বিশ্লেষণ মুহূর্তে হাজির করছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক কিন্তু মানুষই।’

  • ইশতিয়াক মান্নান আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ