চট্টগ্রাম জেলার জন্য কোন কাজটি সবচেয়ে বেশি জরুরি? অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোন কাজটিকে সবার আগে প্রাধান্য দেওয়া উচিত? এ রকম প্রশ্নের জবাবে অনেকেই বিভ্রান্ত হবেন। ধন্দে ও দ্বন্দ্বে পড়ে যাবেন।
আসন্ন বৃষ্টির মৌসুমের কথা ভেবে অনেকেই জলাবদ্ধতা প্রকল্প দ্রুত সম্পন্ন করার কথা বলবেন। কেউ কেউ বলবেন কালুরঘাট সেতুর কথা। কেউ কেউ হয়তো বলবেন অসহনীয় যানজট দূর করতে। ফুটপাত ও নদী দখলমুক্তও করতে বলবেন। নদীদূষণ বন্ধ ও পাহাড় কাটা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়াকে অনেকেই অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা নিশ্চয়ই বলবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পদক্ষেপ নেওয়া সবচেয়ে জরুরি কাজ বলে মনে করেন বেশির ভাগ মানুষ।
জলাবদ্ধতা, কালুরঘাট সেতুর দুই পাড়ে প্রতিদিন শত শত গাড়ির ভিড়, যানজট, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাসহ সব ভোগান্তিকে ছাপিয়ে যে কষ্ট, যে বেদনা মানুষকে কাঁদায়, মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, সেটাই লাঘবের কথা মানুষ নিশ্চয় সবার আগে বলবে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু মহামারিকবলিত এলাকার চেয়েও ভয়াবহ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে ২৭টি দুর্ঘটনায় ৪২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫৬ জন। এর আগে ২০২০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ৪ বছরে মারা গেছেন ২২৪ জন।
সম্প্রতি ঈদের ছুটিতে এই মহাসড়কের চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় ৩টি দুর্ঘটনায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। শুধু জাঙ্গালিয়া এলাকা নয়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা। ১৫৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক এখন এক সাক্ষাৎ মৃত্যুফাঁদ।
একেকটি দুর্ঘটনা একেকটি পরিবারকে তছনছ করে দিচ্ছে। একটি দুর্ঘটনা চিরদিনের হাহাকার বয়ে আনছে পরিবারগুলোয়। পত্রিকায় পাতায় দুর্ঘটনার একটি ছবি কিংবা সংবাদ উঠছে, তার পরদিন আরেকটি নতুন দুর্ঘটনার খবরে আগের দিনের কথা সবাই ভুলে যাচ্ছে। কিন্তু যে মানুষ তার স্বজনকে হারাল, তার জীবনে নেমে আসছে ধস। সড়কে বেঘোরে প্রাণ যাওয়ার মতো করুণ নির্মম নিয়তি মেনে নেওয়া খুব কঠিন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ প্রয়োজন।
এখন এই মুহূর্তে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় সড়ক দুর্ঘটনা। মানুষের এই মুহূর্তের দাবি মরণফাঁদ থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনার বেশ কিছু কারণ রয়েছে—অপ্রশস্ত সড়ক, লোনাপানিতে মহাসড়ক পিচ্ছিল থাকা, অদক্ষ চালক, বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক বাঁক, ওভারটেকিং, মহাসড়কে নিষিদ্ধ ছোট যানবাহন চলাচল, ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চলাচল এবং সড়কের দুপাশে উঁচু-নিচু জায়গা। কিন্তু দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ অপ্রশস্ত সড়ক।
এ জন্যই সম্প্রতি কক্সবাজার–চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার দাবি দিন দিন জোরালো হচ্ছে। এই দাবিতে সর্বস্তরের মানুষ মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ সভা-সমাবেশ করছে। চার লেনের সড়কের দাবিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়, সাতকানিয়া, লোহাগাড়ায় মানববন্ধন করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।
দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার যাওয়ার একমাত্র সড়কটি বেশির ভাগ অংশের প্রশস্ততা মাত্র ১৮ থেকে ৩৪ ফুট। ১৫৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত গাড়িগুলোর সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টার বেশি। এই সড়কে ঘন ঘন বাঁক, দুই পাশে প্রচুর হাটবাজার, উপজেলার শহর। সড়কের সঙ্গে মিশেছে অনেক উপসড়ক।
এসব কারণে সড়কের অধিকাংশ এলাকা হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে লোহাগাড়া শহর, চুনতি, জাঙ্গালিয়া এলাকা, চকরিয়ার ইসলামনগর, ইমাম বুখারি মাদ্রাসা, চকরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এলাকা, লক্ষ্যারচর জিদ্দা বাজার টার্নিং পয়েন্ট, মালুমঘাটের ছগিরশাহকাটা ঢালা, ডুলাহাজারার পাগলিরবিল, খুটাখালী জাতীয় উদ্যান, নাপিতখালী, রামু রাবারবাগান মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা শুধু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে, তা নয়, যাঁরা আহত হচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই চিরজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করছেন, অনেকেই কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন। শত শত মানুষকে, পরিবারকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রশস্ত করার কাজ এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি বলে মনে হয়।
চট্টগ্রামবাসীর এই দাবিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে বারবার। অথচ দেশের অর্থনীতির স্বার্থে, প্রধান পর্যটনকেন্দ্রে কক্সবাজারে পর্যটনের বিকাশ ঘটাতে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের লাখ লাখ মানুষের ভোগান্তি কমাতে এই সড়কের উন্নয়ন খুব জরুরি।
৫ এপ্রিল প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটিকে চার লেনে উন্নীত করার দাবি পূরণে সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সড়ক ও জনপথ বিভাগ সম্ভাব্যতা সমীক্ষার পরেও শেষ পর্যন্ত প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এখন নতুন করে আবার সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ চলছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, এই মহাসড়কে যান চলাচলের বাধা দূর করতে ৮ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকায় একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় পটিয়া, দোহাজারি, লোহাগাড়া ও চকরিয়ায় বাইপাস এবং সাতকানিয়ার কেরানীহাটের একটি এলাকায় উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হবে। অনুমোদনের পর দেড় বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনো মাঠপর্যায়ে কাজই শুরু হয়নি। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে যেত বলে অনেকের ধারণা।
চার লেনে উন্নীতকরণ কিংবা বাইপাস ও উড়ালসড়ক নির্মাণ—কিছুই হলো না। শুধু সমীক্ষাতেই বছরের পর বছর পার করছি। আর দিন দিন বাড়ছে কেবল মৃত্যুর হাহাকার। বাড়তে বাড়তে দুর্ঘটনা মহামারির মতো প্রাণ কাড়ছে।
এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। মানুষের জীবন রক্ষা প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। তাই এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রশস্ত করার কাজটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা উচিত।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক